বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১২ই মে, রবিবার, ২৮শে বৈশাখ, ১৩৮১
অর্থনৈতিক সয়ম্ভরতা অর্জনের জন্য–
চাহিদার সাথে তাল মেলাতে না পারলে আমদানি করতে হয়, উৎপাদন না থাকলে নির্ভরশীল হতে হয় বিদেশের উপর। অর্থনীতির এ হলো স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম। উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্র গুলোর মূল সমস্যাই এই জায়গায়। চাহিদা পূরণ করতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। বহু জিনিসের জন্য পুরোপুরিই নির্ভর করতে হয় বিদেশের উপর। বাংলাদেশ তা থেকে আলাদা নয়। প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনের যথেষ্ট কলকারখানা সরঞ্জামাদি নেই। গড়েও উঠেনি বিগত বছরগুলোতে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর মোটামুটি ভাবে সয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য সামনে রেখে অগ্রসর হলেও তা সময় সাপেক্ষ কিন্তু তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান জনাব নুরুল ইসলাম সম্প্রতি রোটারি ক্লাবে এক সভায় দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি সার্থক ও পূর্ণ কৃষিব্যবস্থা বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি ইতিমধ্যেই প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রধান শর্ত হিসেবে পর্যাপ্ত কৃষি, উৎপাদন দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক সাহায্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপরেই নির্ভর করছে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য।
খাদ্য ঘাটতি আমাদের নয়া সমস্যা নয়। অথচ এ দেশটির অর্থনীতি কৃষি নির্ভরশীল। শিল্পায়ন সম্ভব হয়নি। সে পথে আগাবার জন্যও দরকার প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। সে মুদ্রা আসবে কোত্থেকে? কাঁচামাল রপ্তানি করে? উন্নয়নশীল দেশের চরিত্র অনুসারে কাঁচামাল রপ্তানি করে যতটুকু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি তার অধিকাংশই ব্যয় হয়ে যায় খাদ্য সহ অন্যান্য ভোগ্য পণ্য আমদানি করতে। শিল্প যন্ত্র আমদানি তথা লগ্নিকারবার মত অর্থ খুব কমই এরপর হাতে থাকে।
এ অবস্থায় বেশিদিন চলতে পারেনা। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ধরন। তাই উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও আজ মরিয়া হয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্ব স্ব দেশের সুবিধা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশেতে কৃষিনির্ভর এবং স্বল্প ব্যয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান সেদিকটাতেই সর্বপ্রথম নজর দেয়া দরকার। প্রতিবছর ১৮ থেকে ২২ লাখ টন খাদ্যশস্য আমাদের বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। ব্যয় হয়ে যায় মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং সরকারি অন্যান্য সহযোগিতা এই বৈদেশিক মুদ্রা থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারে।
এরপরেই আসে শিল্পোৎপাদন ক্ষেত্রে যতটুকু সুযোগ সুবিধা রয়েছে তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা। পুনরুৎপাদনে কল-কারখানাগুলো কে নিয়ে যেতে পারলে এবং প্রয়োজনে তার সম্প্রসারণ এর ব্যবস্থা গৃহীত হলে ভোগ্যপণ্য এবং অন্যান্য অনেক জিনিস যার জন্য আমাদের বিদেশের উপর নির্ভর করতে হয়, আমরা নিজেদের দেশের উৎপাদন থেকেই লাভ করতে পারি।
এরপর আসে নয়া শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠা। এজন্য আমাদের মতো দরিদ্র দেশে অবশ্যই বৈদেশিক সাহায্য এবং সহযোগিতার ওপর নির্ভর করতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে তেমন পরিবেশ যাতে বৈদেশিক সাহায্যের গতি শ্লথ না হয়ে আসে। আমাদের অর্থনৈতিক নির্মাণকাজে বিদেশি রাষ্ট্র সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করে।
এ তিনটি দিকে নজর রাখতে হবে। অগ্রসর হতে হবে অতন্ত বাস্তবনির্ভর পরিকল্পনার মাধ্যমে। ব্যবস্থাপনা এবং সাংগঠনিক যে ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে তা অনতিবিলম্বে দূর করা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে স্বয়ম্ভরতা অর্জন শুধু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য নয় বরং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই আজ বিশেষ জরুরী। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরনির্ভর কোন জাতিই নিজেদের প্রকৃত স্বাধীন বলে দাবি করতে পারে না।
বিচারের বাণী যেন নিভৃতে না কাঁদে!
উপরে সৃষ্টিকর্তার বিচার, মর্ত্যে মানুষের তৈরি আদালত। এই দুটো জায়গায় আমরা বিচার পেয়ে থাকি। তবে একটা পারোলৌকিক বিচার, দ্বিতীয়টা লৌকিক বিচার। প্রথম বিধিরীতি আমরা জানি না, শেষের টার বিধিরীতি মানুষের তৈরি। আর মানুষের তৈরি আইন ও আদালত নিয়েই আমাদের জাগতিক জীবন। এই আইন ও আদালতে আমাদের শান্তি, নিরাপত্তা, ন্যায় ও শৃংখলা রক্ষার প্রধান হাতিয়ার। এক্ষেত্রে যদি শোনা যায় যে, বিচার এর অভাবে কোন দেশে প্রায় চার লক্ষ মামলা ঝুলে আছে, তাহলে আতঙ্ক জাগে বই কি?
পত্রিকান্তরের সংবাদে প্রকাশ, বিভিন্ন পদমর্যাদার বিচারকের স্বল্পতার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল ডিভিশন, হাইকোর্ট ডিভিশন, সারাদেশের ফৌজদারি কোর্ট এবং জজ কোর্টের বর্তমানে প্রায় চার লক্ষ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এরমধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে প্রায় এক হাজার, হাইকোর্ট ডিভিশনে ২৪হাজার এবং অন্যান্য আদালতে ৩লক্ষ ৭৫ হাজার মামলা ঝুলছে।
সংবাদসূত্র আরো জানাচ্ছে যে, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে প্রতিদিন গড়ে ২২ টি মামলা দায়ের করা হচ্ছে। এর মধ্যে অর্ধেক মামলা শুনানির পর নিষ্পত্তি হচ্ছে, বাকি অর্ধেকের শুনানির জন্য অন্যদিন ধার্য করা হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতিদিন দায়েরকৃত মামলার অর্ধেক ঝুলে থাকছেই। এবং এভাবে হাইকোর্টে পাঁচ বছর ও তার বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯ হাজারের মতো দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার মামলার নিষ্পত্তি সম্ভব হয়েছে বলে ওই সংবাদ সূত্র আরও জানায়। এবং বিভিন্ন ফৌজদারি কোর্ট এবং জজকোর্টে বিচারাধীন ৩ লক্ষ ৭৫ হাজার মামলার মধ্যে ফৌজদারি কোর্টে এক লক্ষ ৭৫ হাজার এবং জজ কোর্টে ২লক্ষ মামলা রয়েছে।
এরই প্রেক্ষিতে উল্লেখ্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট ডিভিশনের বর্তমানে প্রধান বিচারপতিসহ মোট ১৬ জন বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জন বিচারপতি হাইকোর্ট ডিভিশন এবং তিনজন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের ১২ জন বিচারপতির মধ্যে দুইজন হাইকোর্ট বহির্ভূত দায়িত্ব পালন করছেন। একজন বিচারপতি তদন্ত কমিশন এবং অপর একজন শ্রম আদালতের দায়িত্বে আছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি সহ মোট ৯৫জন বিচারপতি নিয়োজিত ছিলেন। সেখানে সভাপতি বক্তব্য হল একটি সার্বভৌম দেশের নানাবিধ নতুন সমস্যার প্রেক্ষিতে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা তো নিশ্চয় বেড়েছে। সেখানে এত কম সংখ্যক বিচারপতির দ্বারা বিচারালয় গুলির দায়িত্ব নির্ভর করার সম্ভাবনাও নিঃসন্দেহে কমেছে। এবং সম্ভবতঃ প্রতিবেদনের প্রথমেই তাই বিচারপতির স্বল্পতাকে উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা জানি, আইন-শৃংখলার নৈয়ায়িক বোধই মানুষকে সভ্যতার দিগন্তে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এবং এই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে মাধ্যমেই হল বিচারালয় গুলি। সকল সভ্য দেশে এই বিচারালয় গুলির কাজ মহামান্য বিচারকের দাঁড়াই চলে। সার্বিকভাবে একটা দেশের আভ্যন্তরীণ ন্যায়-অন্যায় ভেদে শাস্তি ও পুরস্কারের বিধান দেয়ার ভারও এই বিচারালয় গুলির উপরই। তাই, সভ্য দেশে আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি রক্ষার ব্যাপারে বিচারালয়ের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে।
সকল দেশের যেকোনো কারণে অধিকারবঞ্চিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা প্রতিকারের আশায়ই কোর্টের শরণাপন্ন হয়। সে ক্ষেত্রে আশু বিচার পাওয়াটা তার পক্ষে থেকে একান্ত কাম্য থাকে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে আজ পর্যন্ত একটা শুনানিতেই এদেশে কোনো মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে বলে শোনা যায়নি। ফলে বিচার দাবি করতে এসে অহেতুক অর্থ ও সময় ব্যয়ে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হন। সেই বিলম্বিত বিচার তাদের কাছে তখন অবিচারেরই নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়।
এই পটভূমির প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন–অধিক সংখ্যক বিচারক নিযুক্তির জরুরী প্রয়োজন আছে। শুধু তাই নয়, আমরা জানি আমাদের দেশে বিচার বিভাগ যে সকল বিভাগের সঙ্গে সম্পৃক্ততা নির্ভরশীল ঘাপলা সেখানেও আছে। সময়মতো রিপোর্ট পাওয়া যায় না এবং যথাযথ সহযোগিতার প্রশ্ন ও অবহেলিত। তদুপরি বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগের ঠেলাঠেলি আছে। অর্থাৎ সমস্ত বিচারব্যবস্থাটাই একটা হজবরল নীতিতে চলে। যার ফলে জনজীবনের যথেষ্ট অশান্তি ও নিরাপত্তার বোধহীনতা দেখা যায়। এবং আমরা মনে করি দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্তমানে নৈরাজ্যের অন্যতম প্রধান কারণও এই বিচার বিভাগের ঢিলেমি। বিচার বিলম্বিত হওয়ার অর্থই হলো ন্যায়সঙ্গত বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া। সুতরাং বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক