বাংলা বানী
ঢাকাঃ ১৩ই ডিসেম্বর, শুক্রবার, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১
ঢাকা-ত্রিপোলি কূটনৈতিক সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও তেলসমৃদ্ধ লিবিয়া রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংবাদে প্রকাশ, তেহরানস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক ফার্স্ট সেক্রেটারি ও বর্তমানে লিবিয়া আরব প্রজাতন্ত্রে বাংলাদেশ চার্জ দ্যা অ্যাফেয়ার্স সেখানে বাংলাদেশ মিশন খুলতে ইতিমধ্যেই ত্রিপোলি পৌঁছে গেছেন। লিবিয়া ও শীঘ্রই বাংলাদেশে একজন আবাসিক রাষ্ট্রদূত পাঠাচ্ছেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফির বিশেষ দূত জনাব আলী গাদামসী গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাত করেন এবং বাংলাদেশের বন্যা দুর্গতদের জন্য ১০ লাখ ডলারের একটি চেক অর্পণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎকারকালে জনাব গাদামসী লিবিয়ার সরকার ও জনগণের সহানুভূতি ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
বাংলাদেশ ও লিবিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন আরব দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের আন্তরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নেরই প্রতীক। স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র তিন বছর সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ আরব বিশ্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে যে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধন করেছে তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশ সম্পর্কে আরব বিশৃবে অপপ্রচার চালিয়েছিলো এবং তারই ফলশ্রুতিতে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়েছে বাংলাদেশের গতিশীল পররাষ্ট্রনীতির জন্য। বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান জোট নিরপেক্ষতা নীতি এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী সংগ্রামের প্রতি একাত্মতাবোধের জন্য বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জোট নিরপেক্ষ দেশগুলির বন্ধুত্ব, সাহায্য সহযোগিতা ও সহানুভূতি পেয়েছে জন্ম লগ্ন থেকেই।
আরব বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলজিয়ার্স সম্মেলনে যোগদানের পরপরই। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু উদাত্ত কণ্ঠে সংগ্রামী আরো ভাইদের প্রতি সমর্থন জানান। শুধু তাই নয়, তিনি এ কথাও ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশে সব সময়েই নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পাশে রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। পরবর্তী পর্যায়ে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে ও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরব বিশ্বের নেতৃবৃন্দের অন্তরঙ্গ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে যে শুধুমাত্র সৌজন্যে রক্ষার জন্য আরো বিশ্বের প্রতি সমর্থন জানায়নি তারই প্রমাণ হলো তিয়াত্তরের অক্টোবরে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধরত আরব ভাইদের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চা প্রেরণ। বাংলাদেশের এ দান যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন তাদের মনে গভীর রেখাপাত করেছিল সেদিন। আরব বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশ যে বন্ধুত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করতে আগ্রহী তারই প্রমাণ হলো জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর বঙ্গবন্ধুর ইরাক, মিশর ও কুয়েত সফর। শুধু তাই নয়, এ মাসেই বঙ্গবন্ধু যাচ্ছেন আবুধাবি সফরে।
বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ও আরব বিশ্বের মধ্যে বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছার যে সেতুবন্ধন স্থাপিত হয়েছে তা আরো সুদৃঢ় হলো বাংলাদেশ-লিবিয়া কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ও লিবিয়ার মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। লিবিয়া সমৃদ্ধশালী দেশ। লিবিয়ার প্রয়োজন রয়েছে প্রকৌশলী ও কারিগর এর। বাংলাদেশ তা সরবরাহ করতে পারে। পারস্পরিক লেনদেন, ভালবাসা ও বন্ধুত্বের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন স্থাপিত হতে যাচ্ছে তা অমর হোক এই কামনাই আমরা করছি।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রকৌশলীদের ভূমিকা
রাষ্ট্রপতির জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ জনগণের কল্যাণে কারিগরি প্রজ্ঞা ও সৃজনশীল প্রতিভাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রকৌশলীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অফ ইঞ্জিনার্স-এর অন্যতম সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেছেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে আমাদের অর্থনীতি বারংবার সংকটাপন্ন হয়েছে। এই সংকট আকীর্ণ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হচ্ছে আপামর জনসাধারণের অনলস পরিশ্রম।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে জনজীবনের সমৃদ্ধি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। কিন্তু খরা, বন্যা, প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য ঘাটতি একটি ফি বছরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণ করার জন্য প্রতিবছর কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি খাতে ব্যয়িত হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাই উচ্চারণ করেছেন যে, ‘এ অবস্থা দীর্র্ঘদিন চালু থাকলে আমাদের অর্থনীতি কখনোই স্বনির্ভর হয়ে গড়ে উঠতে পারবে না।’ রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘তাই আজ প্রয়োজন, প্রকৌশল ও কারিগরী দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন।’ বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক কৃষি ব্যবস্থার প্রবর্তন করে দেশের খাদ্য ঘাটতির অপসারণ করার প্রতি রাষ্ট্রপতি জোর দিয়েছেন। কৃষি ব্যবস্থায় প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যবহার করলে আমাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি যে সুদৃঢ় হবে, তাতে দ্বিমত প্রকাশের অবকাশ নেই। আমরা একটি কৃষি প্রধান দেশের অধিবাসী। কিন্তু শতাব্দীর শোষণ-বঞ্চনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠে আমরা অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারছিনা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা এবং উন্নয়নের ক্রমোন্নতি সাধনের ব্যাপারে প্রযুক্তিবিদ্যা এবং ফলিত বিজ্ঞান এর ফলপ্রসূ ব্যবহার একান্ত আবশ্যক। এ ব্যাপারে দেশের প্রকৌশলীদের দায়িত্বকেও একেবারে তুচ্ছ বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। দেশের উন্নয়ন কাজে প্রকৌশলীদের অংশগ্রহণ অনায়াসে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। কেমন করে জমির উৎপাদন বাড়ানো যাবে, সুষ্ঠু সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বা কী করণীয় আছে, বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ কেমন করে চালু করা যায়, সে ব্যাপারে দেশের প্রকৌশলীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভূমিকার প্রাধান্যকে কিছুতেই খাটো করে দেখা চলে না। প্রকৌশলীরা যদি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন কিংবা কারিগরি দক্ষতা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হন, তাহলেই বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক অবদানকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
নবজাগ্রত জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিটি নাগরিকের জীবন ব্যবস্থাকে সুখী-সমৃদ্ধশালী করার জন্য প্রকৌশলীদের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রপতি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘মেধার দিক দিয়ে আমাদের প্রকৌশলীরা বিশ্বের যে কোন প্রকাশনীর সমতুল্য।’ কিন্তু তবুও আমরা দেশের বিভিন্নমুখী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার ব্যাপারে বিদেশি প্রকৌশলীদের উপর নির্ভরশীল। বিদেশি প্রকৌশলীদের উপর আমাদের নির্ভরশীলতা যে কোন উপায়েই হোক না কেন কাটিয়ে উঠতে হবে। বিদেশি প্রকৌশলীদের খাতে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য ব্যয়িত হবার মতো ব্যাপারকে দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখা কোন জাতির পক্ষেই মঙ্গলকর হতে পারে না। আমাদের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন প্রয়োজন। সেজন্য প্রকৌশলীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের প্রতি যেমন নজর দিতে হবে তেমনি শিক্ষানবিস প্রকৌশলীদের যত্ন ও নিষ্ঠার সঙ্গে যাদের কাজ আয়ত্ত করার প্রতি আগ্রহী হতে হবে। নইলে বিদেশি প্রকৌশলীদের উপর থেকে নির্ভরশীলতার ভূতকে তাড়ানো সহজ হবে না। প্রকৌশলীদের সমস্যা সম্পর্কে সরকার সদাজাগ্রত রয়েছেন। কিন্তু সরকার জাগ্রত থাকলেই সমস্যার সমাধান হবে এমন মনে করার কারণ নেই। সমগ্র প্রকৌশলী সমাজকেই সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এবং নিজেদের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রকে সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। প্রকৌশলীরা যদি জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনে এগিয়ে আসেন তাহলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির দৈন্যদশা বিদূরিত হতে পারে। রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ প্রকৌশলীদের প্রতি যে আহ্বান জানিয়েছেন, তার প্রতিপালন করার ব্যাপারে আমাদের প্রকৌশলীরা নিশ্চয়ই সচেতনতা অবলম্বন করবেন বলে আমরা আশা করি। দেশের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করার জন্য কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব সাধন একান্ত জরুরী। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার সম্প্রদায় পন্থা অনুসরণ করতে প্রযুক্তিবিদ্যা এবং ফলিত বিজ্ঞান এর প্রয়োগকে ত্বরান্বিত করা দরকার। পুরনো মান্ধাতা আমলের কৃষি ব্যবস্থায় উৎপাদন বাড়ানোর অভিযান সফল হতে পারেনা। কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করা তাই একটি অবশ্য কর্তব্য হিসেবে বিবেচিত হওয়াই বাঞ্ছিত। আমরা আশা করি -আমাদের প্রকৌশলীরা তাদের গুরু দায়িত্ব পালন করার ব্যাপারে কোনো রকম হেরফের করবেন না। দেশের উন্নয়নের জন্য তারা সুচিন্তিত কর্মসূচি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক