You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৩শে ডিসেম্বর, সোমবার, ৭ই পৌষ, ১৩৮১

শিল্প বিনিয়োগ

বিনিয়োগ নীতি ঘোষণার পর শিল্প বিনিয়োগে কতটকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা নিয়ে বৈঠক হয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ে। দেশের বিভিন্ন বণিক সমিতি, সংশ্লিষ্ট দফতরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন শিল্পমন্ত্রী। বৈঠকে শিল্পমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিভিন্ন শিল্প ও বণিক সমিতি এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি শিল্প উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিল্প বিনিয়োগে প্রকৃতপক্ষে আগ্রহী লোকদের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে সম্ভাব্য সকল সাহায্য দেয়ার সিদ্ধান্ত ঐ বৈঠকে নেয়।
শিল্প বিনিয়োগে কতটকু অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সে সম্পর্কে কোন তথ্য সরকারীভাবে জানানো না হলেও প্রকৃতপক্ষে নয়া শিল্প বিনিয়োগ নীতি ঘোষণার পর যে সে ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতিই সাধিত হয় নি তা ওয়াকেবহাল মহল মাত্রই অবগত আছেন। নয়া শিল্প বিনিয়োগ নীতিতে বেসরকারী খাতে শিল্প বিনিয়োগের সিলিং বারো গুণ বৃদ্ধি করা হয়। সিলিং বাড়িয়েই আশা করা হয়েছিল যে, বিভিন্নভাবে অর্জিত সম্পদ উৎপাদনে লগ্নী করার জন্য নয়। এবং পুরোন সম্পদশালী শ্রেণী এগিয়ে আসবে। সরকারের সে আশা পূরণ হয়নি। উপদেষ্টা পরিষদ গঠন এবং বিনিয়োগকারীদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস থেকে অন্ততঃ তাই মনে হওয়া স্বাভাবিক।
আসলে শিল্প বিনিয়োগের জন্য সিলিং যতটা নয় তার চাইতে অনেক বেশী অন্তরায় হিসেবে বিবেচিত হতো দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমজীবি মানুষের ব্যাপারে সুস্পষ্ট সরকারী নীতির অভাব। এ ছাড়া সহজ এবং অস্বাভাবিক বাণিজ্যিক মুনাফা বিত্তশালীদের শিল্প বিনিয়োগের চাইতে বাণিজ্যিক সুবিধা গ্রহণেই অধিকতর আকৃষ্ট করে এসেছে।
সেই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়েছে বলে কেউ নিশ্চয়ই বলবেন না। উপরন্তু দেশে অস্থিরতা, হতাশা আগের চাইতেও অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রতিরোধে সরকার আজ পর্যন্ত কোন সুস্পষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। দেশের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমূল একটি পরিবর্তন আসছে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এমনি বক্তব্যও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের অপেক্ষার নীতি গ্রহণে উৎসাহী করেছে।
এ সবকিছুর পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে সরকারী নীতি যতদিন স্বচ্ছ এবং সুস্পষ্ট না হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যতদিন না সরকারের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে আসছে, সহজ বাণিজ্যিক মুনাফা লুটার মৌশুম যতদিন না শেষ হচ্ছে, সর্বোপরি শিল্প প্রতিষ্ঠা এবং তার পরিচালনায় সরকারী নীতির প্রতি বিনিয়োগ কারীদের আস্থা ফিরে না আসই তত দিন কমিটি অথবা উপদেষ্টা পরিষদ, ঋণ অথবা সাহায্য যা কিছু সুযোগ-সুবিধার উল্লেখই করা হোক শিল্প বিনিয়োগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন সম্ভব নয়। আমরা সরকারকে সেই মৌলিক সমস্যার দিকেই দৃষ্টি দানের আহ্বান জানাচ্ছি।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আইন

বিশ্ব জনবর্ষ উপলক্ষে বাংলাদেশ পরিবার পরিকল্পনা বোর্ড কর্তৃক আয়োজিত জনসংখ্যা সমস্যা ও ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা শীর্ষক ৫ দিনব্যাপী কর্মশিবিরের সমাপ্তি দিবসে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকগণ ঐক্যমতে একটি প্রস্তাব নেন। এতে বলা হয় ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভয়াবহ হার রোধের জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তব প্রয়োগ অত্যাবশ্যক।’ বাংলাদেশের ১৯টি জেলার ৪০টি কলেজ থেকে মোট ১০৩ জন ছাত্র-শিক্ষক পৃথক পৃথক আলোচনা বৈঠককালে এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার রোধ করা সম্ভব। এরই প্রেক্ষিতে জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণকরণে প্রয়োজনীয় আইনের প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে ছেলে ও মেয়েদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা নির্ধারণের ব্যাপারেও আইন করা দরকার। এবং পরিবার গঠনের ক্ষেত্রে একদিকে দুই বা তিনটির বেশি সন্তান হলে পিতা-মাতাকে জরিমানা করা, অন্যদিকে ছোট ও সুস্থ পরিবারকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থাও রাখতে হবে। যদিও জনসংখা হ্রাসের ব্যাপারে আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের কথাটা শুনতে কঠোর তবু মনে হয় অল্প শিক্ষিতের দেশে যুক্তি ও মানবিক আবেদনের পাশে পাশে আইনানুগ বাধ্যবাধকতা থাকা বাঞ্ছনীয়। বাস্তব সমস্যার মুখে এবং বলতে গেলে দেশে এই ব্যাপক খাদ্যাভাবের প্রেক্ষিতে জাতীয় জীবনে যখন জীবন-মরণের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তখনও জনসংখ্যা বৃদ্ধির এমন আতঙ্কিত হার বাস্তবিকই উৎকণ্ঠার বিষয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বহুবিধ অসুবিধার দরুন জনসংখ্যার অনুপাতে খাদ্যোৎপাদনে এখনও তেমন ফলপ্রসূ নিদর্শন আমরা রাখতে পারছিনা। এবং এতগুলো মুখের আহার জোগানোর চিন্তায় অহরহ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। এই পর্যায়ে কার্যকরীভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ আজ নিতেই হবে।
শুধু তাই নয়—যে সব দেশ থেকে আমরা খাদ্য আমদানী করে থাকি তাদেরও বাষিক উৎপাদনে ভাটা পড়ছে। এবং উন্নয়নশীল দেশশুলোর জন্য সে একটা বড় রকমের আতঙ্কও বটে। আর একথা অনস্বীকার্য যে, খাদ্য সমস্যা ও জনসংখ্যা সমস্যা দুটি পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর বেলায় একথার বাস্তবতা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। এ প্রসঙ্গে বিশ্বখাদ্য পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দুদর্শাগ্রস্ত মানুষের হিসেবও বড় মর্মান্তিক। বিশ্বে এখন ১ শত কোটি লোক যথেষ্ট খাবার পায় না, ৫০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত ও ৪০ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা সহ বিশ্বের ৪০ কোটি উন্নয়নকামী দেশে (যেগুলো প্রায় সবই ঘনবসতিপূর্ণ দেশ) খাদ্য সংকট আছে। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশের অবস্থা সংকটজনক দেশগুলির মধ্যে অন্যতম একটি দেশ। অতএব জনসংখ্যা রোধের আন্দোলনে আমাদেরকে আরও সক্রিয় অংশগ্রহণে উদ্যোগী হতে হবে।
এবারের কর্ম শিবিরে সেদিকে লক্ষ্য রেখে আরও ক’টি প্রস্তাব নেয়া হয়। প্রথমতঃ পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য পল্লীক্লাব গঠন এবং সেখানে বইপত্র, প্রচার পুস্তকা ইত্যাদি রাখা, আলোচনা অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রাখা দরকার। এই প্রস্তাবে আমাদের সমর্থন আছে পুরোপুরি। কারণ গ্রামজীবনে অবসর বিনোদনের কোন ব্যবস্থাই নেই। ফলে মানুষ স্বভাবতঃই জৈবিক চেতনায় আচ্ছন্ন থাকার অবকাশ পায়। তদুপরি পুরোপুরি ভাবে গ্রামাঞ্চলের জনসাধারণকে পরিবার পরিকল্পনার গুরুত্ব ও ফলাফল সম্বন্ধে এখনও সচেতন করে তোলার বাস্তব উদ্যোগ নেয়াই হয়নি। অথচ এ সম্বন্ধে যথোচিত বক্তব্য প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে না পারলে জনসংখ্যা রোধ কর্মসূচীর সাফল্য আশাই করা যায় না।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে দেশের প্রতিটি কলেজে জনসংখ্যা বিষয়ক শিক্ষা পরিষদ গঠন করার আহ্বান জানানো হয় । এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বোর্ডের পাঠ্যসূচীতে জনসংখ্যা সম্পর্কিত বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করার কথাও উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবটিতে। এ কথা সত্য যে, শিক্ষা বলতে আগে শুধু বুদ্ধির উৎকর্ষ সাধনকে বুঝালেও এখনকার দিনে সে সংজ্ঞা সম্প্রসারিত হয়েছে। জগত ও জীবনকে সর্বতোভাবে জানা ও বোঝার চেষ্টাকে এখন শিক্ষার পর্যায়ে ফেলা হয়। সেক্ষেত্রে জাগতিক জীবনের পরিধি তথা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন সম্বন্ধেও আজ শিখতে হয় শিক্ষার্থীকে। কাজেই শিক্ষা জগতের এই সুবৃহৎ পরিসরে জন্ম সম্পর্কিত তথা জনসংখ্যা বিষয়ক পাঠক্রম থাকলে তার দ্বারা সুফল পাবারই আশা করা যায়।
অন্যান্য প্রস্তাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক সেমিনার, অনুষ্ঠান ও পুরস্কার দানের ব্যবস্থা, কলেজ লাইব্রেরী সমূহে পরিবার পরিকল্পনা সম্পকিত বই-পত্র, প্রচার পুস্তিকা প্রেরণ ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। পাঁচদিনব্যাপী এই সেমিনারের প্রস্তাবগুলো আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তবে কথা হল আলোচনা সভা ডেকে বা গৃহীত প্রস্তাবের মধ্যে বৈচিত্র্য এনে সত্যিকার কাজ হয়না। জাতিসংঘ ঘোষিত জনবর্ষ কর্মসুচীর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এযাবত বই সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন হয়েছে কিন্তু উল্লেখযোগ্য কাজের নমুনা এখনও দেখা যায় না। তাই আমাদের আবেদন, কর্মশিবিরে গৃহীত প্রস্তাবাবলীর ভিত্তিতে এবার যেন কিছু কাজ হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!