মেজর জেনারেল এম আই মজিদ (অবঃ)
বাঙালির সামরিক ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় নাম মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইশফাকুল মজিদ। তিনিই প্রথম বাঙালি মুসলিম জেনারেল। ১৯০৩ সালের ১৭ মার্চ আসামের জোড়হাটে তার জন্ম উচ্চশিক্ষিত পরিবারে। তার বাবা আবদুল মজিদ সিআইই ছিলেন আসামের ইংরেজ গভর্নরের প্রথম ভারতীয় নির্বাহী কাউন্সিলর। এম আই মজিদ বাঙালির মধ্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্যান্ডহার্স্ট রয়েল মিলিটারি কলেজের গ্র্যাজুয়েট হিসেবে কমিশন লাভ করেছেন (১৯২৪)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মালয় ও মিয়ানমারের রণাঙ্গনে লড়াই করেছেন। উপনিবেশবাদবিরোধী মানসিকতার কারণে মজিদকে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গা রোধে মুখ্যমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করতেন। ১৯৪৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং সেনাপ্রধান জেনারেল কারিয়াপ্পা মজিদকে অনুরোধ করেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা, জিন্নাহর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। পাকিস্তানে তিনি মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৫১ সালে জেনারেল আইয়ুব খান (পরে প্রেসিডেন্ট) হলেন সেনাবাহিনী প্রধান। মজিদ তার দুই বছরের সিনিয়র। তাই এই পদোন্নতি মেনে না নেয়ায় আইয়ুবের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আইয়ুব খান মে. জে. মজিদকে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে দেন। মজিদ নির্দোষ প্রমাণিত হন এবং বেকসুর খালাস পান। তখন সোহরাওয়ার্দী তাকে আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন। পরে পাক সরকার উচ্চপদে মজিদকে নিয়োগের প্রস্তাব দিলে তিনি অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ১৯৬২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসেন। জীবনের বাকি ১৪ বছর তিনি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় এক গ্রামে কাটিয়ে দেন। ঢাকা শহরে আরামে বাস করার মোহ তার ছিল না। ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনে অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের সংগঠিত করেন। ’৭১ সালের ২২ মার্চ মজিদ ঢাকায় সাবেক সৈনিকদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ২৫ মার্চের কালরাতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কিছু দিন পর জেনারেল মজিদ গ্রেফতার হন। তবে নির্যাতন সত্ত্বেও নতিস্বীকার করেননি। কারণ তিনি আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। আগস্ট মাসে তিনি মুক্তি পান। স্বাধীনতার পর সরকার জে. মজিদকে বিভিন্ন পদ গ্রহণের অনুরোধ জানালে অপারগতা প্রকাশ করেন। দীর্ঘ রোগভোগের পর ১৯৭৬ সালের ৩১ মার্চ এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ইন্তেকাল করেন। আজিমপুর গোরস্থানে তিনি চিরশয্যায় শায়িত। দেশ ও জাতির জন্য বিপুল অবদান থাকলেও জেনারেল মজিদ সম্মান দূরের কথা, যথার্থ স্বীকৃতিও পাননি। সেনাবাহিনীর কাছে জেনারেল মজিদ সম্পর্কে তথ্য নেই। তার পরিবারের অভিযোগ, যিনি বৃদ্ধ বয়সে মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতিত হয়েও মাথা নোয়াননি, স্বাধীনতার পর বেতন-ভাতা বা কোনো সুবিধাই তিনি পাননি সরকার থেকে। বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ চত্বরে প্রাক্তন বাঙালি সামরিক অফিসার ও জোয়ানদের সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মেজর জেনারেল (অঃ) এম আই মজিদ এবং সমাবেশটি পরিচালনা করেন কর্নেল ওসমানী । শপথগ্রহণ করে অন্য অফিসার ও জোয়ানদের কর্মস্থল ত্যাগ করে যুদ্ধে যোগদানের আহবান যানানো হয়। সমাবেশ শেষে শহীদ মিনার হয়ে সবাই বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যান। বঙ্গবন্ধুর লাইব্রেরিতে তারা চারজন বঙ্গবন্ধুর সাথে একান্ত বৈঠক করেন । কর্নেল অঃ ওসমানী সংগ্রামের পতিক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর হাতে একখানা তরবারি তুলেদেন।