You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.03.10 | সমবায় প্রসঙ্গ: শহর ও গ্রামে চেতনা ও তৎপরতার চরিত্র ও চিত্র | সংবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সমবায় প্রসঙ্গ: শহর ও গ্রামে চেতনা ও তৎপরতার চরিত্র ও চিত্র
আবু আল সাঈদ

সম্প্রতি ভােলা, ময়মনসিংহ জামালপুর, শেরপুর প্রভৃতি এলাকায় নিভৃত গ্রামাঞ্চলগুলাে ঘুরে ফিরে দেখেছি। এ অঞ্চলগুলাের কৃষি, সেচ ব্যবস্থা, বীজ ইত্যাদিসহ খাস ভূমি, বনাঞ্চলের আবাদী ভূমি, কৃষক, কৃষকদের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে যতদূর সম্ভব লিখেছি। একটা ব্যাপারকে আমি সরাসরি এড়িয়ে গেছি, তাহল এই সব গ্রামাঞ্চলের “সমবায় আন্দোলন।”
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলগুলাের সমবায় আন্দোলন সম্পর্কে কিছু তুলে ধরা একান্তই প্রয়ােজন বলে আমার মনে হচ্ছে। সত্যি বলতে কি আমরা আমাদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রামাঞ্চলের সমবায় আন্দোলন সম্পর্কে লিখে থাকি। সেসব লেখার মধ্যে মূলত: সমবায় আন্দোলন কেমনটা হচ্ছে, বর্তমান সমবায়ের মধ্যে কি কি দোষগুণ রয়েছে, সমবায় সমিতিগুলাের চেহারা কেমনটা হওয়া উচিত, ইত্যাদিই থাকে। আমি বেশ কিছু দিন যাবৎ দেশের বুদ্ধিজীবী ও সমবায় বিভাগের কর্মকর্তাগণ কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, বুলেটিন সাময়িকী ইত্যাদি পড়ে দেখেছি, (যত দূর সম্ভব)। তাতে উল্লেখিত আলােচনা সমালােচনাগুলােই দৃষ্টিগােচর হয়েছে। আসলে বাংলাদেশের নিভৃত গ্রামাঞ্চলগুলােতে আমাদের জাতীয় সমবায় আন্দোলন কতখানি সত্যি কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝতে পারিনি। ফাইল পত্তরে যেসব হিসাব-নিকাশ, রিপাের্ট, বর্ণনা রয়েছে সেগুলাে আমার কাছে বৃটিশ আমলের বিখ্যাত জোক সাড়ে চব্বিশটা গরুর হিসাবের মতই মনে হয়। মনে হয় কারণ, যখন হয়তাে খুব হাঁকডাক শুনে অমুক গ্রামে গেলাম সমবায়ীদের সাথে আলাপ করতে, আলাপে অতি সাধারণ হয়তাে কেউ বললে, কি জানি বাবা এর নাম-টামতাে তেমন শুনিনি, ওতে কি হয় তাও তেমন। জানি না মাঝে মধ্যে চাঁদা না কি কি দিতে হয়, তাই দেই। কেউ বললে, আমরা তাে সমিতি করি, কিন্তু আমাদের থানার সমবায় অফিসার সাহেব তাে কোনদিন থানার থাকেন না।
কেউ বললে, আছি আর কি সমিতির মধ্যে, কিন্তু আসলে ওটা বড়মিয়াদেরই কারবার। আবার হয়তাে, কোনাে গ্রামের কেউ বললে, সমিতি আছে বলেই তাে গ্রামের এত উন্নতি।
শহরে যখন সমবায় ইত্যাদি বিষয়ে কোনাে সেমিনার হয়, সভা হয়, তখন ভাষণ-টাষণ শুনে আমি গ্রামাঞ্চলের এই সব মানুষের সাথে তার কোনাে সঙ্গতি খুঁজে পাই না। আমার কাছে যেন মনে হয়, গ্রাম উন্নয়ন, পরিকল্পনা ইত্যাদির মতই সমবায় আন্দোলনও ঢাকাকেন্দ্রিক ব্যাপার। সাংবাদিক হিসাবে যখন সমবায় বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছে যাই, টুকিটাকি দু’চারটে তথ্য জানতে চাই, তারা এমন ভাবে বলে দেন, যেন যা যা বল্লেন, সব কিছু গ্রামেগঞ্জে হয়ে আছে (হয়তাে তাঁরা মনে করেন সাংবাদিকরা কি আর ঐসব গ্রামে যাবেন নাকি অত খোঁজ-খবর নিতে)।
সত্যি বলতে কি অদ্যাবধি আমি সমবায় বিভাগের খুঁটিনাটি আইন, প্রশাসন, প্রশাসনিক কাঠামাে, গঠনতন্ত্র ইত্যাদি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। বাংলাদেশের কত প্রকার কৃষি সমবায় রয়েছে, এ জন্যে কতগুলাে সরকারী সংস্থা, বিভাগ, আধাসরকারী সংস্থা রয়েছে, হঠাৎ করে বুঝে ওঠা বিষম দায়। সমবায় গঠন থেকে সেটাকে চালানাে, অথবা সাধারণ একজন সদস্য হিসাবে টিকে থাকা, ব্যাংক থেকে কর্জ আনা, পাওয়ার পাম্প, সার, বীজ, কীটনাশক ওষুধ আনা (এই সব আনা-আনির ব্যাপারেই সমবায় সমিতিগুলাে গঠিত হয়েছে। গ্রামে গেলে প্রায়শঃই এমনটা মনে হবে) আসলে সমবায় কি ও কেন, এ সম্পর্কে সত্যিকারের ধারণা গ্রামাঞ্চলের সহজ সরল মানুষকে যথাযথ দেওয়া হচ্ছে বলেও প্রায় ক্ষেত্রেই আমার মনে হয় না। এবং ইদানীং যেটা শুনছি সেটা হল গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা নিজেদের শ্ৰেণী সম্পর্কে নানান দুঃসহ নিদারুণ জীবিকা সংঘাতের মধ্যে অভিজ্ঞতা সঞ্চার করছেন, এবং দু’একটি কৃষক সংগঠন যা দাবী তুলছেন তাহল: তেলে মাথায় আর কত তেল? অর্থাৎ যাদের জমি আছে, তাদের তাে সবই আছে, তাদের ঐ জমি থেকেই আরাে অধিক পুঁজি গঠন করার সুযােগ-সুবিধা এনে দিচ্ছে ঐ সমবায় আন্দোলন। আর যাদের জমি নেই, যারা ভূমিহীন ক্ষেতমজুর বর্গাচাষী এবং সত্যি বলতে যাদের মেহনতের ঘামে জমির মালিকরা ধানে তাদের গােলা ভরে সমবায়ে তাদের কোন স্থান নেই, এ নিয়ম বদলাতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া এ শুভ খবরে জানা যায়, সম্প্রতি সমবায় মন্ত্রীসহ সমবায় বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নেতৃবৃন্দ নিয়ে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কতখানি কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এখনাে জানা যায়নি।
যা হােক, বাংলাদেশের কোনাে একটি অঞ্চলের সমবায় আন্দোলন সম্পর্কে সদা সর্বদাই উদাহরণ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু সে সম্পর্কেও ভুক্তভােগীগণ বলছেন, ঐ অঞ্চল যে বিশেষ পদ্ধতিতে সমবায় আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তাতে মূলত: জোতদার মহাজনগণই বেশি লাভবান হয়েছে। আর সামান্যতম পুঁজি নিয়ে যারা এ আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, তাঁদের অবস্থা ক্রমেই শােচনীয় হয়েছে। সেটা সে অঞ্চলে ফুলানাে-ফাঁপানাে যে কোন পুরনাে সমবায় সমিতির সদস্য সংখ্যা প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী থেকে এ যাবৎ গুনলে অনেক ঘাটতি পাওয়া যাবে। কারণ গরীবরা চিরকারের মত অল্প পুঁজি খাটিয়ে শেষাবধি শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে দিয়েছেন, এবার শেয়ারগুলাে জোতদার, মহাজন সমবায়ীগণ খরিদ করে নিয়েছেন ক্রমেই।
এখানে মূল বক্তব্য, যেটা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ইদানীং বুদ্ধিজীবী চিন্তাবিদগণও দিচ্ছেন, তা হল: সমবায় যতদিনে না দরিদ্র এবং ভূমিহীন কৃষকদের স্বার্থে ব্যবহার না করা হবে, ততদিনে বর্তমান প্রচলিত সমবায় নিয়ে জাতীয় উন্নয়ন তেমন সম্ভব নয়, কয়েকজনের পুঁজি গঠন ছাড়া। আগেই উল্লেখ করেছি এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা চলেছে। প্রচলিত সমবায়ের উপর কোন আঘাত না হেনে, এবং এর ধারাটিকে না বদলে ক্রমেই এই সমবায়কে সাধারণ মেহনতি মানুষের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে।
সারা বাংলাদেশে গত ১৯৭২-৭৩ সনের হিসাব অনুসারে জানা যায় (১৯৭৩-৭৪-এর হিসাব সংগৃহীত হয়নি) ইউনিয়ন মালটিপারপাস সমবায় সমিতিয়ে রয়েছে ১৭৪টি, মােট মালটিপারপাস সমবায় সমিতি, মােট ৪,২৮১টি।
কৃষি সমবায় সমিতির সংখ্যা মােট ২৫,৮৬০টি। বাণিজ্যিক সমবায় সমিতি মােট ১,১৪২টি। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সংখ্যা ২৭৬৭টি। মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য সংখ্যা ২,৯৫,৬১৫ জন। তাঁতী সমবায় সমিতির সংখ্যা ১৯৯৩টি। তঁতী সমবায় সমিতির সদস্য সংখ্যা মােট ২,৭৩,৯১৮ জন।
এটা হল ১৯৭২-৭৩ সনের হিসাব। খুব সম্ভব, ১৯৭৩-৭৪ ও ১৯৭৪-৭৫ সনে বিভিন্ন সমবায় সমিতিগুলাের সংখ্যা এবং সদস্যের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। কিছু কিছু কৃষি সমবায় সমিতিতে উল্লেখযােগ্য দৃষ্টান্তমূলক উৎপাদন হচ্ছে। প্রসঙ্গত: উল্লেখ্য, উল্লেখিত ২৫৮৬০টি কৃষি সমবায় সমিতিগুলাের মাঝে ১৯৭৪ সনের সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন সংস্থার ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসের হিসাব পর্যন্ত জানা যায়, প্রাথমিক কৃষি সমবায় সমিতি রয়েছে ১৬,৪২৬টি। তাহলে দেখা যাচ্ছে ২৫ হাজার ৮ শ’ ৬০টি কৃষি সমবায়ের মধ্যে ১৬ হাজার ৪শ’ ২৬টি প্রাথমিক কৃষি সমবায় সমিতি পল্লী উন্নয়ন সংস্থার আওতাধীন। বাকী ৯ হাজারের ঊর্ধ্বে কৃষি সমবায় সমিতিগুলাে তবে কোন, বিভাগের আওতাভুক্ত? সেগুলাে সরাসরি সমবায় বিভাগ, স্থানীয় উদ্যোগ, ইরি স্কীমের জন্য বিশেষভাবে গঠিত সমবায় সমিতি এমনি নানান পর্যায়ে গঠিত হয়েছে। তবে আবার প্রত্যেকটি সমবায় সমিতিকেই সমবায় বিভাগ থেকে গঠনতন্ত্রের চূড়ান্ত অনুমােদন নিতে হয়ে থাকে।

সূত্র: সংবাদ, ১০ মার্চ ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত