You dont have javascript enabled! Please enable it!

এবারের ৭ই মার্চ সর্বস্তরে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে
শােষণহীন সমাজ কায়েমের শপথ নাও: প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী জনাব এম, মনসুর আলী এবারের সাতই মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বস্তরে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে দেশে শােষিতের গণতন্ত্র ও শােষণহীন। সমাজ কায়েমের জন্যে নতুন করে শপথ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের উদ্যোগে একাত্তর সালের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ স্মরণে গতকাল শুক্রবার বিকেলে দলের অন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়ােজিত আলােচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দানকালে এই আহ্বান জানান।
আলােচনা সভায় একাত্তরের ৭ই মার্চকে বাঙালি জাতির জীবনে একটি উল্লেখযােগ্য স্বণাক্ষরে লেখা দিন হিসেবে অভিহিত করে ও এ দিনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করে অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ ম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আব্দুর রাজ্জাক, অনুধালুপ্ত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অন্যতম সহ-সভাপতি সৈয়দ আলতাফ হােসেন ও অধুনালুপ্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক জনাব মােহাম্মদ ফরহাদ। আলােচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন অধুনালুপ্ত আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি জনাব মহিউদ্দীন আহমদ। আলােচনা সভাশেষে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। |
উল্লেখ্যাগ্য যে, ১৯৭১ সালের সাতই মার্চের সংগ্রামমুখর অগ্নিক্ষরা দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাক ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সগ্রামের জন্যে বাঙালি জাতিকে ডাক দেন। তিনি বজ্রকণ্ঠে বলেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তিনি এদিন হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সগ্রামের জন্যে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলার আহ্বান জানান।
গতকালের আলােচনা সভায় মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, কূটনীতিক, জাতীয় রাজনৈতিক নেতা, সশস্ত্র বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মচারী এবং মহিলাসহ বিপুলসংখ্যক ছাত্র, যুব ও রাজনৈতিক কর্মী উপস্থিত ছিলেন।[৪৫]
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ: প্রধানমন্ত্রী এম, মনসুর আলী বলেন, একাত্তর সালের সাতই মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঐতিহাসিক দিন। কারণ এ দিনই বাঙালি জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে। এই দিন নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটু এদিক ওদিক হলে ইতিহাস অন্যরকম হতাে, তাই সাতই মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্যে অগ্নিপরীক্ষার দিন। তিনি সকল প্রলােভনের উর্ধ্বে থেকে এই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল চিন্তা-ভাবনা করে চরম আত্মত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হয়েই সাতই মার্চে ডাক দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন রক্ত না দিলে স্বাধীনতা আসবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ হয়েছে, কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়নি। তাই জাতির তাগিদেই যেদিনের মত আজও বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কর্তৃক দ্বিতীয় বিপ্লবের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিলের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে অভিহিত করে বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র দ্বিধা ও বিভেদ সৃস্টি করে। শােষিতের গণতন্ত্রই একমাত্র জনগণের সঠিক কল্যাণের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষম।
পরিশেষে তিনি স্বাধীনতা বিরােধী অশুভ শক্তি-সমূহের চক্রান্তের কথা উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য, শােষিতের ঐক্য তথা কৃষক-শ্রমিক আপামর জনসাধারণের ঐক্যের লৌহদৃঢ় দুর্গ গড়ে তােলার আহ্বান জানান।
জিল্লুর রহমান: জনাব জিল্লুর রহমান বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালি জাতির বিভিন্ন সংগ্রামের পটভূমি বর্ণনা করে বলেন, একাত্তরে যেদিন জাতির জনক বুঝতে পারলেন নিয়মতান্ত্রিক পথে চলবে না, সেদিনই তিনি জনগণের মনের প্রতিধ্বনি করে স্বাধীনতার জন্যে প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেন। সাতই মার্চ হল সেই দিন।
তিনি বঙ্গবন্ধু যে দ্বিতীয় বিপ্লবের আহ্বান জানিয়েছেন তাকে সফল করার জন্যে একাত্তর সালের ন্যায় ঐক্যবদ্ধভাবে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
আব্দুর রাজ্জাক: জনাব আবদুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরােধীরা বিদেশী ও সাম্রাজ্যবাদীদের সহায়তায় যখন দেশের প্রগতি ও স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার চক্রান্ত শুরু করেছে তখন এদের প্রতিহত করাতে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের জন্যে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন।
তিনি বলেন, একাত্তরের সাতই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা অনুযায়ে স্বাীনতা এসেছে, কিন্তু মুক্তি আসেনি।
এবারের স্বাধীনতার শত্রুদের প্রতিহত করার সাথে সাথে দ্বিতীয় বিপ্লবের মা্যমে সেই অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম শুরু করতে হবে। মনে রাখতে হবে একমাত্র সমাজতন্ত্রের মাধ্যমেই সেই মুক্তি আসবে।
আলতাফ হােসেন: সৈয়দ আলতাফ হোেসেন সাতই মার্চকে একটি ঐতিহাসিক জাতীয় সংগ্রামের প্রত্যয় গ্রহণের দিন বলে অভিহিত করেন। তিনি গত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কারা বাঙালি জাতির পক্ষে এবং বিপক্ষে ছিল তা থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে ভবিষ্যতে শত্রু-মিত্র নির্ধারণের মাধ্যমে নতুন পথে যাত্রা শুরুর আহ্বান জানান।
মােহাম্মদ ফরহাদ জনাব মােহাম্মদ ফরহাদ একাত্তর সালের সাতই মার্চের তৎপর্য বিশ্লেষণ করে বলেন, এই ঐতিহাসিক দিনে সমগ্র বাঙালি জাতি তাদের নেতার কাছ থেকে জাতীয় সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে স্পষ্ট পথনির্দেশ লাভ করেছে। যে নির্দেশ অনুসারে বাঙালি জাতি সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা বিস্ময়কর নয় মাসে যে স্বাধীন পেয়েছি, তার মূল জনগণেরও ঐক্য এবং ভারত ও সােবিয়েত ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল বিশ্বের সমর্থনও সহযােগিতা। কিন্তু শুধু এই থাকলেই শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না-চাই সঠিক ও দূরদর্শিতা সম্পন্ন প্রজ্ঞামণ্ডিত নেতৃত্ব, যােগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব ও সেনাপতি সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, এইদনিই বঙ্গবন্ধু জাতির জনক হিসেবেও বেরিয়ে এসেছেন।
তিনি দেশের সাম্প্রদিক মৌলিক প্রশাসনিক পরিবর্তনের পটভূমি বর্ণনা করে বলেন, বঙ্গবন্ধু যে জাতীয় দল গঠন করেছেন এর মধ্যে প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মাত্র লক্ষ্য, কর্মপন্থা, ও নীতি নির্ধারিত করে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবকে সফল করব, এবারের সাতই মার্চে এই হােক আমাদের শপথ।
তিনি এ প্রসঙ্গে বিভেদকামী শত্রুদের সম্পকে সর্তক থেকে কৃষক-শ্রমিক ছাত্র-জনতার সার্বিক জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলারও আহবান জানান।
মহিউদ্দীন: আলােচনা সভায় সভাপতির ভাষণে জনাব মহিউদ্দীন আহমদ বলেন, দেশের নতুন পটভূমিকার সাতই মার্চ আরও অর্থবহ হয়ে উঠেছে। এবারের সাতই মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশে শােষিতের গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে নতুন যাত্রা শুরু করতে হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে সাম্রাজ্যবাধকে সমাজতন্ত্রের প্রধান শত্রু বলে অভিহিত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অভিজ্ঞতার আলােকে জনগণকে শত্রু-মিত্র সম্পর্কে হুশিয়ার করে দেন।
রাজশাহী: রাজশাহী, ৭ই মার্চ (বাসস)- বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ রাজশাহী শাখার উদ্যোগে আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ পালন করা হয়।
এই উপলক্ষে সংগঠনের জেলা কার্যালয়ে এক আলােচনা সভায় আয়ােজন করা হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংসদ সদস্য ডা: আলাউদ্দিন। এতে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক সংসদ সদস্য জনাব জাফরউল্লা, অধুনালুপ্ত ন্যাপনেতা জনাব আতাউর রহমান এবং অধুনালুপ্ত বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জনাব এ,এইচ,এম জালাল উদ্দিন। অনুষ্ঠানে নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা প্রসঙ্গে চার বছর আগে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যে মনােভাব নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা হয়েছিল সেই মনােভাব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিপ্লব সফল করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়।

সূত্র: সংবাদ, ৮ মার্চ ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!