বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৪শে ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ৮ই পৌষ, ১৩৮১
পবিত্র ঈদুল আযহা
চান্দ্র বছরের নিয়মমাফিক পরিক্রমায় আবার এসেছে ঈদ উল আযহা। সারা মুসলিম জাহানের কাছে বড় পবিত্র দিন এটি। এই ঈদ উৎসবের তিন দিন ধরেই চলে কোরবানির অনুষ্ঠান। আর চান্দ্র বছরের শেষ মাসেই হজ্জব্রত সমাপনের পর ভক্তি ও তাদের আদর্শ নিয়ে আসে ঈদুল আজহা তথা কুরবানীর ঈদ। এসবই আমাদের জানা কথা, চেনা উৎসব।
তবে গতানুগতিক জীবনধারায় আনন্দ উৎসবের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিশ্চয় আছে। প্রত্যেক ধর্মেরই তাই কিছু ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানের প্রচলন আছে। এমনকি উপজাতিদের জীবনেও বিশেষ বিশেষ মৌসুমে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবের প্রচলন আছে। আর উৎসব আনন্দ অনুষ্ঠান মানেই হল কোন একটা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় আদর্শ বজায় রেখেই কিছু বেহিসেবি আমোদ আহ্লাদের মাধ্যমে ঐ উৎসব পালন করা।
মুসলিম জাতির জীবনে ঈদও তেমনি একটা উৎসব। বিশিষ্ট আনন্দের দিন। এই ঈদের ধর্মীয় আদর্শ হল ত্যাগ। পরম করুণাময়ের উদ্দেশ্যে কিছু ত্যাগের নিদর্শন রাখতে গিয়ে খোদার নামে পশু তথা গরু-খাসি, উট বা দুম্বা কোরবানি করে আত্ম ভোগ এর চেয়ে প্রতিবেশী, স্বজন ও গরিব মিসকিনদের মাঝে তা বিলিয়ে দেয়া হয় এই ঈদে। গতানুগতিক আয়-ব্যয়ের হিসাব এর প্রেক্ষিতে এই দিনটি বিশেষ ভাবে খরচের তালিকায় থাকে। ধর্মীয় আদর্শকে অন্তরে লালন করে ধর্মভীরু খোদাভক্ত মুসলমানদের সঙ্গে বহন করেও থাকেন। কিন্তু ক্রমশঃ আয়-ব্যয়ের তালিকায় বিশেষভাবে মন্ডিত এ দিনটিকে অর্থনৈতিক কারণে বাদ দেয়া যে আমাদের তথা মধ্যবিত্তদের জীবনে অপরিহার্য হয়ে পড়ছে তার উপায় কি? এই অসহায় প্রশ্নের উত্তর কোথায় আছে আজ?
আমরা জানি এই ঈদে পশু কুরবানীর নামে প্রকৃতপক্ষে ধর্মপ্রাণ মানুষ তার অন্তরের অন্তঃস্থলে যে পশু থাকে তাকেই খোদার নামে দিতে চায় কোরবানি। এজন্য কোরবানির অনুষ্ঠানে থাকে বিনয়, আত্মসংযম, ভক্তি ও পরম স্রষ্টার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার সানুনয় ঐকান্তিকতা। থাকে মানবিকতা ও সমানানুভূতির স্বহৃদয় সুকোমল মানসিকতা। মহিম অনন্ত অসীম একক ও চিন্ময় আল্লাহর প্রতি বিনয়াবনত আত্মনিবেদনের প্রসন্নতা। তাই বা কই? কারণ আমরা তো দেখছি ঈদে এলেই গো-হাটায় চলে বেশি টাকা খরচ করে কোরবানির গরু বা খাসির অহংকার প্রতিযোগিতা, চলে আভিজাত্যের উদ্ধত্য অনমনীয়তা। ত্যাগ ও আত্মার পশুত্বকে বিসর্জন দেওয়া তো দূরের কথা-সেগুলোকে যেন সযত্ন লালনে রাখার তৎপরতাই সেখানে দর্শনীয় হয় পড়ে। আর তার সঙ্গে আছে হিংসা-দ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, চুরি, রাহাজানি, ফটকাবাজি, চোরাচালান, মুনাফা লুটা, পাচার করা, ভেজাল করণ ইত্যাদির নির্লজ্জ প্রকাশ। বেশ কিছু সংখ্যক লোক তো তারই মধ্যে নিত্য হাবুডুবু খাচ্ছে। আশ্চর্যের বিষয় এদের অনেকেই মুসলমান নামে সুপরিচিত নয়- অনেক ক্ষেত্রে ধর্মের ,ধ্বজাধারী বলেই তারা চিহ্নিত। কাজেই আজ অবশ্য প্রশ্ন রাখবো-কোথায় ঈদুল আজহার আদর্শ? একথা নিশ্চয় অনস্বীকার্য যে, মানব সভ্যতা থেকে আদর্শকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এবং যাবতীয় সমাজবিধি, রাষ্ট্রবিধি ও ধর্মীয় বিধিগুলি প্রণীত হয় প্রচলিত ও মূল্যবোধ ও আদর্শের ভিত্তিতে। সেই আদর্শই তো মানুষকে প্রতিক্ষেত্রে সৎ পথে চালিত করে থাকে। তাই ধর্মীয় আদর্শের অবমাননা করে আমরা যেমন ধর্মের নামে অহংকার প্রদর্শনা দিতে পারি না তেমনি পারিনা রাষ্ট্রবিরোধী ও সমাজ বিধি বা আদর্শকে না মেনে একজন সুনাগরিক পর্যন্ত হতে। তাহলে আমরা কি? কোন আদর্শের অনুসারী বা কোন মানবতাবাদের ধারক?
প্রাসঙ্গিকভাবেই ঈদুল আযহার উৎসব উদযাপনের প্রসঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্যের কথা ও স্বজনদের উপহার ইত্যাদির সংলাপ এসে পড়ে। আর তারই সঙ্গে জড়িত হয় অর্থসংক্রান্ত বৃত্তান্ত। কারণ অর্থনীতিই যে অধুনা জাগতিক জীবনের সাধ, আকাঙ্খা ও লেনদেনসহ জীবনযাত্রার যাবতীয় আনুষঙ্গিক দিককে নিয়ন্ত্রণ করে। সেই কথা স্মরণে রেখে জাতীয় সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির শপথ নিতে হবে ঈদুল আযহার দিনে। কারণ জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা না এলে সাধারণ মানুষের দুঃখ কোনদিনও ঘুচবে না। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের আশা আকাঙ্ক্ষা ও থাকবে অপূর্ণ। অর্থনীতির মেরুদন্ড হবে ন্বুজ।
অতএব আসুন, এই ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা যারা ঈদ উদযাপন করব তারা কোরবানি ঈদের নামে আপন পশুত্বকে বিসর্জন দিয়ে এবং দেশ, সমাজ ও জাতির জন্য ঐক্যনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাই। যাতে অন্যান্যরাও সেই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়। সমৃদ্ধিশালী জাতি হিসেবে সেদিন ঈদুল আযহার উৎসব তথা ত্যাগের আদর্শকে যথার্থই পবিত্র অনুভূতির দ্বারা অভিযুক্ত করা সম্ভব হবে। জাতীয় নৈতিক চরিত্রের মানোন্নয়নেও তা সহায়ক হবে। সেই আশায় অসংখ্য বিক্ষুব্ধ প্রশ্নভারে জর্জরিত মনে এবং এত বাস্তব দুঃখ কষ্টের মধ্যেও তাই ভক্তি নত চিত্র ঈদুল আযহার পবিত্র উৎসবকে প্রতিবছর কর্ম ও ত্যাগ- দীক্ষার আদর্শ প্রতীক হিসেবে স্বাগতম জানাই।
ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান প্রসঙ্গে
আমাদের খাদ্য মন্ত্রী জনাব আব্দুল মোমেন খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করে তোলার জন্য গত ২০শে ডিসেম্বর পচাগরের এক জনসভায় আহ্বান জানিয়েছেন। লেভির ধান দেবার ব্যাপারে কেউ বাধা দিলে তাকে ক্ষমা করা হবে না বলেও তিনি হুমকি দিয়েছেন। রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় পর্যন্ত তাকে তিন লাখ ৫০ হাজার মণ ধান সংগৃহীত হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী সাহেব গত পরশুদিন আবার গোদনাইল এর খাদ্য সংগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছেন, অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করে তোলার জন্য দরকার হলে নতুন আইন পাস করা হবে। ইতিপূর্বে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আশাবাদ প্রকাশ করা হয়েছে ধান-চাল সংগ্রহ করার ব্যাপারে। বস্তুতঃ দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় ধান উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ হয়েছে। সরকার ধার্যকৃত ধান-চালের মূল্যের চাইতে ঐসকল অঞ্চলের বাজারদর অনেক জায়গা কম, অনেক জায়গায় সামান্য কিছু বেশি। ফলে সংগ্রহ অভিযান মোটামুটি বেশ ভালই বলা চলে। তবু আশাতিরিক্ত সংগ্ৰহ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় না। এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে সকল সংবাদ পত্র- পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তাতে আমরা লক্ষ্য করেছি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান মোটেই সন্তুষ্ট হবার মত নয়। দেশের যে সকল অঞ্চলের ধান চালের বাজার দর সরকার ধার্যকৃত দামের চাইতে বেশি সেসকল অঞ্চলের সংগ্রহ অভিযান নিদারুণভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। ক’দিন পূর্বে মাগুরার এমনই একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে একটি কাগজে। মাগুরার বিভিন্ন খোলা বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম সরকার নির্ধারিত মূল্যের ৩৫-৪০ টাকা বেশি। ফলে কৃষকরা সরকারের ক্রয় কেন্দ্র ধান জমা দিতে মোটেই আগ্রহী নয়। অন্যদিকে দিনাজপুরের একটি খবরে জানা গেছে যে, জেলার বহু স্থানে চুয়াল্লিশ সেরে এক মণের হিসাব প্রবর্তন করা হয়েছে। এছাড়া ৬০-৬৫ টাকা মণ দরে ধান কিনে চুয়াত্তর টাকা দেখানো হয়েছে। ময়মনসিংহের শেরপুর এর একটি খবরে জানা গেছে, গত ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৫১৭৮ মণ চাল এবং ১১৬ মণ বিশ সের ধান সংগৃহীত হয়েছে। প্রথমদিকে ধান চাল ক্রয়ের ব্যাপারে যে গতি ছিল তা ধান চালের দাম বেড়ে যাওয়ার জন্য দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাহায্যে গরীব কৃষকদের উপর জুলুম করে ধান সংগ্রহ করা হচ্ছে। এবং এভাবে সংগৃহীত খানের অধিকাংশই বেশি দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পটুয়াখালীতে ও ধান সংগ্রহ অভিযানে তেমন কোনো সাড়া নেই। মোহনগঞ্জে এখনো সংগ্রহের কাজ শুরু হয়নি। দেশের অনেক অঞ্চলে এখনো কাজ শুরু হয়নি। বগুড়ার একটি খবরে জানা গেছে, সেখানে নাকি ৫০ টাকা মণ দরে কৃষকদের দাম দেওয়া হচ্ছে। অথচ বাজারে ধানের দাম প্রতি মণে একশত টাকা। বগুড়া থেকে ধান বাইরে পাচার হচ্ছে বলে সংবাদে জানানো হয়েছে। উল্লেখিত এসকল সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হচ্ছে তা হলো ধান সংগ্রহ অভিযান দেশের সর্বত্র আশানুরূপ ফল হয়নি। সব অঞ্চলেই বাধা সৃষ্টি হয়েছে এবং এই বাধার অন্যতম প্রধান কারণ হলো বাজারে বর্তমানে ধান চালের দাম চলছে সরকারি মূল্য তারচেয়ে অনেক অংশে কম। ফলে কেউই সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে রাজি হচ্ছে না। আমরা ইতিপূর্বে কয়েকবার আমাদের অভিমত পোষণ করে বলেছি-সংগ্রহ অভিযান বাস্তবায়িত হতে পারে না যদি ধান চালের দামের পুনর্বিন্যাস করা না হয়। বিশেষ করে বর্তমান বাজার দরের প্রতি দৃষ্টি রেখে যদি ধান চালের দাম বাড়ানো না হয় তাহলে সরকারের অভিযান ব্যর্থ হয়ে যাবে। এছাড়া সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ করার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ যদি নিশ্চয়তা দান করতে না পারেন তাহলে ধান-চাল পাচার হয়ে যাবে। এবং অন্যান্য ভারতীয় দ্রব্য যা বর্তমানে আমাদের দেশে অধিক মূল্যে বিক্রি হচ্ছে তা পাচার হয়ে চলে আসবে। ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান সার্থক করে তোলার ব্যাপারে অর্থনৈতিক পদক্ষেপ না নিয়ে কর্তৃপক্ষ যদি শুধু গায়ের জোরে অভিযান বা নতুন আইন প্রণয়ন করে ভুলতে চান তাহলে কোনক্রমেই তা বাস্তবায়িত হবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক