You dont have javascript enabled! Please enable it!

চির অম্লান মহান একুশে

“শােকের গান নয়,
বরং দুহাতে
আগুনে ঝলসানাে রক্ত পতাক
উড়াও নীলিমায় ; এবারে একুশে সাহসী সংগীতে
ডাকছে তােমাকে।”
আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারী। ঋতু পরিক্রমণের অমােঘ নিয়মে আমাদের সমস্যা সংক্ষুব্ধ জীবনে আর একটি একুশের পদার্পণ। আজ হইতে তেইশ বৎসর পূর্বে উনিশ শ’ বায়ান্নর এই দিনে বরকতসালাম-রফিক-জব্বার-শফিউর রহমানসহ আরও অসংখ্য নাম না জানা বীর স্বৈরাচারী শােষকচক্রের ক্রুর জাকুটির মুখে প্রাণপ্রিয় মুখের ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বুকের রক্ত ঢালিয়া ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করিয়াছিলেন। সেদিন তরুণমনে দেশপ্রেমের যে মহামন্ত্র মঞ্জুরিত হইয়াছিল সেই মহামন্ত্রই সময়ের পরিবৃদ্ধিতে সংগ্রামের সােপান অতিক্রমণের পর মহাজাগরণের বলিষ্ঠ শপথে রূপান্তরিত হইয়া বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করিয়াছিল শিকল ভাঙ্গার যুদ্ধে। বায়ান্নর একুশের রক্তবিন্দু মুক্তির সূর্যে পরিণত হইয়াছিল একাত্তরে।
শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, সারা দুনিয়ার ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারী এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়াছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের দুর্জয় প্রতিরােধের শক্তিতে-শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করিয়াছে তরুণদের বিশ্বঐতিহাসিক আত্মত্যাগে।
একুশে ফেব্রুয়ারী শুধু বাংলা ভাষাকে স্বমর্যাদায় আসীন করার বিচ্ছিন্ন সংগ্রাম নয়, আত্মসচেতনাসমৃদ্ধ জাতীয় জাগরণের উন্মেষমুহূর্ত-শােষকের শুভকে দুমতে মুরতে দেবার অনুপ্রেরণার উৎস। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবন ওতপ্রােতভাবে জড়িত।

প্রথম প্রহরে
পঁচাত্তরের শহীদ মিনার। আলপনা অঙ্কিত চত্বর, রাস্তা। মিনারের পিছনে লাল সূর্যের প্রতিকৃতি। আলােকমালায় উদ্ভাসিত। স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যস্ততা।
ক্রমান্বয়ে ঘড়ির কাটা বিশে ফেব্রুয়ারীর সীমানা অতিক্রম করিয়া স্পর্শ করিল অমর একুশের প্রথম প্রহর। রাত্রি বারটা এক মিনিট। মহান একুশের সূচনা। রাত্রির বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া মর্মরিত হইল অমর সঙ্গীত: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানাে একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি।’ শহীদ মিনারে নিবেদিত হইল প্রথম শ্রদ্ধার্ঘ্য একটি ফুলের মালা অতঃপর স্তবক-এই পস্পস্তবকটি অর্পণ করিলেন ভাষা আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক স্বাধীন বাংলাদেশের জনক প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাত্রি ১২টা ১৫ মিনিটে। ইহার পূর্বে ১২.১০ মিনিটে শহীদদের মাজারে নিবেদন করিলেন পুস্পার্ঘ ফাতেহা পাঠ করিলেন। সেখান হইতে শহীদ মিনার। তাঁহার সঙ্গে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী জনাব মনসুর আলী, প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী জনাব তােফায়েল আহমদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মান্নান, বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী জনাব সেরনিয়াবত। শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হইল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ হইতে। বিরাট পুষ্পস্তবক বহন করিয়াছেন সংগঠনের সভাপতি শিল্পমন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান, সাধারণ সমপাদক জনাব জিল্লুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবদুর রাজ্জাক সিনিয়র সহসভাপতি জনাব মহিউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। বঙ্গবন্ধু শহীদ মিনারে উচ্চারণ করেন ‘শহীদ স্মৃতি অমর হােক। ইহার পর মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় রক্ষী বাহিনী, বাংলা একাডেমী, ভারতীয় সাহিত্যিক গােষ্ঠী, আওয়ামী যুবলীগ।
শহীদ মাজার ও শহীদ মিনারে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এত কঠোর ছিল যে, সাংবাদিকরাও সেখানে প্রবেশের সুযােগ পান নাই। স্বেচ্ছাসেবকদের ইস্যুকৃত বিশেষ ছাড়পত্র ছাড়া কাহারও প্রবেশের অধিকার ছিল না-অথচ এসব ছাড়পত্র পত্রিকা অফিসেও পাঠানাে হয় নাই।

সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!