শীতলক্ষ্যা ব্রহ্মপুত্রসহ ৯টি নদ-নদী মজিয়া যাইতেছে
পলিমাটির স্তর জমিয়া শীতলক্ষ্যা নদীর মােহনা ভরাট হইয়া যাইতেছে। এইভাবে পলিস্তর জমিতে থাকিলে আগামী ৫ বছরের মধ্যেই শীতলক্ষ্যা নদীর মুখ সম্পূর্ণ বন্ধ হইযা নারায়ণগঞ্জ নৌ-বন্দরে অস্তিত্বের বিলােপ ঘটাইতে পারে।
ইতিমধ্যেই চর পড়িয়া নদীর প্রশস্ত দুই-তৃতীয়াংশ হ্রাস পাইয়াছে এবং স্থানে স্থানে তলদেশ জাগিয়া উঠিয়াছে। এই খরা মৌসুমে চট্টগ্রাম হইতে খাদ্যবাহী ‘বালকার’ সমূহের নারায়ণগঞ্জ বন্দরে প্রবেশপথে বাধার সৃষ্টি হইতেছে।
সবচাইতে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হইয়াছে ময়মনসিংহ জেলার পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে। বাহাদুরাবাদ হইতে ভৈরববাজার পর্যন্ত দীর্ঘ ১ শত ১৬ মাইল ব্যাপী পলিস্তর জমিয়া পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দেশের প্রাকৃতিক মানচিত্র হইতে বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছে। কটিয়াদি, কুলিয়ারচর এবং আরও অনেক স্থানে ব্রহ্মপুত্র নদ মজিয়া গিয়াছে। বর্তমান খরা মৌসুমে শাহপুর, নারায়ণখােলা, নালিতাবাড়ি এবং আরও বেশ কয়েকটি স্থানে সম্পূর্ণ শুকাইয়া গিয়াছে। যমুনা নদীর গতিপথে ব্যাপকভাবে পলিমাটির স্তর জাগিয়া উঠিতেছে। পাবনা জেলার নাদু শাহেদপুর, বেল্লাবাড়ি হইতে সােনাপুরা পর্যন্ত বরাল গুয়নী নদীতে ৮০ মাইল পথ এই জেরার শাহজাদপুর হইতে বগুড়া জেলার চাকলাকামল পর্যন্ত জর সাগর নদীতে ৬৮ মাইল পথ, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর জেলার গড়াই মধুমতি নদীতে ৬০ মাইল পথ। ঢাকা জেলার পুঁটুরিয়া হইতে ফতুল্লা পর্যন্ত ধলেশ্বরী নদীতে ৪৮ মাইল পথ মানিকগঞ্জে কালিগঙ্গা নদীতে ২০ মাইল পথ, ফরিদপুরে আড়িয়াল খাঁ নদের মােহনা হইতে ১২ মাইল পথ, সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ, রানীগঞ্জ, গৌরীপুর, ধল আশ্রম ও কাদুরায় সুরমা নদীতে ৪৪ মাইল পথ, বালাগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গােলাপগঞ্জ ও বিয়ানী বাজারে কুশিয়ারা নদীতে ৩২ মাইল পথ ব্যাপকভাবে পলিমাটির স্তর জমিয়া নদীগুলির স্বাভাবিক প্রবাহ গতি হারাইয়া ফেলিয়াছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি বৎসর বিভিন্ন নদ-নদীতে ২ শত ৪০ কোটি টন পলিমাটির স্তর জমা হইতেছে। এই পলিমাটির স্তর অপসারণের যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় বর্ষাকালে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বলিয়াও বিশেষজ্ঞ মহল মত প্রকাশ করিয়াছেন।
বর্তমান খরা মৌসুমে উল্লেখিত নদ-নদীগুলির তলদেশ ড্রেজিং করিয়া পলিমাটি অপসারণের ব্যবস্থা করা না হইলে আগামী বর্ষা মৌসুমে পুনরায় ভয়াবহ বন্যা ঠেকাইয়া রাখা সম্ভব হইবে না। বলিয়া ওয়াফিকহাল মহল মত প্রকাশ করিয়াছেন।
সরকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে তিন হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রাসহ ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন করিয়াছেন। এই দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনায় ৪ হাজার মাইল লম্বা বাঁধ নির্মাণ, ২৪টি নদীর মােহনায় সুইস গেট স্থাপন, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার পানি অভ্যন্তরে প্রবেশের উপর নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হইয়াছে।
পর্যবেক্ষক মহল জানান যে, দীর্ঘমেয়াদী বন্যা নিয়ন্ত্রণ মহাপরিকল্পনার আগে বন্যা প্রতিরােধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। প্রতি বৎসর বন্যায় দেশের যে পরিমাণ সহায়-সম্পদের ক্ষতি সাধিত হইতেছে, স্বল্পমেয়াদী বন্যা প্রতিরােধ পরিকল্পনা গৃহীত হইলে ইহার এক দশমাংশ অর্থ ব্যয়ের প্রয়ােজন হইবে না। ইহা ছাড়া নদ-নদীসমূহের ড্রেজিং পরিকল্পনা গৃহীত হইলে হল্যান্ড সরকার সহযােগিতা করিবেন বলিয়া জানা গিয়াছে।
আগামী ৫ বৎসর মেয়াদে ২৮ কোটি ২০ লক্ষ ঘন-গজ পলি-স্তর ড্রেজিং করার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হইয়াছে। পানি উন্নয়ন বাের্ডের অধীনে একটি ড্রেজিং ইউনিট রহিয়াছে। ড্রেজিং ইউনিটের ২৩টি ড্রেজার মেশিনের বার্ষিক ড্রেজিং করার ক্ষমতা ১ কোটি ৭০ লক্ষ ঘনগজ। তবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণের অভাবে ড্রেজিং ইউনিটকে ‘রাজার হস্তী পালনে’র মত কেবল বসাইয়া বসাইয়া খােরাকি যােগান দেওয়া হইতেছে।
পর্যবেক্ষক মহল মত প্রকাশ করিয়াছেন যে, আগামী বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা হইতে অন্তত: আংশিকভাবে রক্ষা পাইতে হইলেও অবিলম্বে ড্রেজিং ইউনিটের সদ্ব্যবহার করা উচিত।
ড্রেজিংয়ের অভাবে নদ-নদীতে পলিমাটির স্তর জমিয়া ভরাট হইয়া গেলে কেবল নেট চলাচল পথ ও নৌ বন্দর সমূহেরই যে ক্ষতি সাধিত হইবে, ইহাই নহে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনেক জটিলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রকাশ করা হইয়াছে।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত