শনিবার সংসদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
আজ শনিবার সংসদে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধুর অংশবিশেষ গতকাল সােমবার দৈনিক বাংলার প্রকাশিত হয়েছে। আজ বাকী অংশ প্রকাশিত হল।
রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে বড় বড় অর্থশালী লােক, বিদেশ থেকে ডেল্ট কেনার জন্য টাকা পায় তাদের জন্য গণতন্ত্র নয় গবীরের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহু পুরানাে কথা আমাদের। এবং সেজন্যই আজকে আমাদের গণতন্ত্র পরিবর্তন করতে হয়েছে।
জনাব স্পীকার
আমরা আজকে আমাদের কঠিন কর্তব্য পালন করেছি। আমাদের দেশের মানুষ দুঃখী, না খেয়ে কষ্ট পায়। গায়ে কাপড় নাই। শিক্ষার সুযােগ তারা পায় না। রাতে একটু আলাে জ্বালাতে পারে না। নানা প্রকার কষ্টে দিন চলছে।
আমরা আমাদের কতগুলাে কর্তব্য পালন করেছি আজ। যারা আজকে আমরা শিক্ষিত, এম, এ পাস করেছি, বিএ পাস করেছি, স্পীকার সাহেব, আপনি জানেন, এই দুঃখী বাংলার মানুষের জনসমাবেশ, তারাই হয়েছে, আমাদের লেখাপড়া শেখার একটা অংশ। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন, পড়ে পাস করেছেন, আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে পাস করেছি, আজ যারা লেখাপড়া শিখেছেন তাদের একটা লেখাপড়ার অংশ দেয় কে? আমার বাপ-দাদা নয়, দেয় বাংলার দুঃখী জনগণ। কি আমি তাদের ফেরত দিয়েছি তাদের আমি রি-পে করেছি কতটুকু? তাদের প্রতি কতটুকু কর্তব্য পালন করেছি। এটা আজকে আমাদের সমালােচনার প্রয়ােজন আছে। আজ যে একজন ডাক্তার হয়, একজন ডাক্তার ডাক্তারী পাস করতে বাংলার দুঃখী মানুষে না হলেও এক লক্ষ টাকা ব্যয় করে। একটা ইঞ্জিনিয়ার করতে না হলেও এক লাখ টাকা খরচ করে। একজন এগ্রিকালচার এক্সপার্ট করতে না হলেও এক লক্ষ টাকা খরচ পড়ে। একজন এ দেশের দুঃখী মানুষ, যাদের পেটে খাবার নাই তাদের অর্থেই এদের লেখাপড়া শেখানাে হয়েছে। আজ সময় এসেছে আজকে আমাদের বিবেচনা করতে হবে কি তাদের কতটুকু বা ফেরৎ দিয়েছে, যার অর্থে তুমি ইঞ্জিনিয়ার হয়েছ, যার অর্থে তুমি আজ গ্র্যাজুয়েট হয়েছ যার অর্থে তুমি আজকে ডাক্তার হয়েছে, যার অর্থে তুমি সায়েন্টিস্ট হয়েছ, যার অর্থে তুমি সমস্ত দেশে মানুষ হয়েছ, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর হয়েছে, যারা লেখাপড়া শিখতেছ তাদের প্রত্যেকটা শিক্ষার জন্য একটি অংশ বাংলার দুঃখী জনগণ দেয়। সেইটার সরকারের টাকা এবং সেই টাকা ব্যয় করে। আজ। আত্মসমালােচনার দিন এসেছে। আমরা কতটুকু কর্তব্য পালন করেছি। আমরা কতটুকু তাদের দিয়েছি। শুধু আমাদের দাও। কে দেবে বাংলায় দুঃখী জনগণকে, তােমরা কি ফেরৎ দিয়েছ। এটা আজ প্রশ্ন। আজ আত্মসমালােচনার প্রয়ােজন রয়েছে। দেশকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে হবে। না হলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না। আজ এদের কর্তব্য বুঝতে হবে। আমি আমার কি কর্তব্য পালন করেছি। দুঃখের বিষয় আজ শুধু আমরা বলি আমরা কি পেলাম। তােমরা কি পেয়েছ। তােমরা পেয়েছ শিক্ষার আলাে, যে শিক্ষা দিয়েছে বাংলার জনগণের টাকায়। তুমি কি ফেরৎ দিয়েছ বাংলার দুঃখী মানুষকে? যে দুঃখী মানুষ না খেয়ে মরে যায়। যে মানুষের কাপড় নাই, যে মানুষ বন্ধু খুঁজে পায় না, যার বস্ত্র নাই, শার্ট নাই, বুকের হান্ডি পর্যন্ত দেখা যায় তাকে আজকে তােমরা কি দিয়াছ? এ প্রশ্ন আজ এখন জেগে গেছে। আজকে বহুদিন পর্যন্ত বার বার বলেছি। আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশান আমার বাংলার কৃষক করে না। করাপশান আমার বাংলা মজদুর করে না। করাপশান করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন করাপশন দেখবেন, আমাদের রাস্তা খুড়তে যান করাপশান, ফুড কিনতে যান করাপশান, জিনিস কিনতে যান করাপশান, বিদেশে গেলে টাকার উপর করাপশান। তারা কারা? আমরা যে ৫ পারসেন্ট শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপট পিপল আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে। আমরাই বড়াই করি। আজ আত্মসমালােচনার দিন এসেছে। এসব চলতে পারে না। মানুষ একদিন মরতে হবে, কবরে যেতে হবে। কিছুই সে নিয়ে যাবে না। তবু মানুষ ভুলে যায়-কি করে এ অন্যায় কাজ করতে পারে।
বহু দুঃখ নিয়ে একাজ করতে হয়েছে। বহুদিন পর্যন্ত বিবেকের দংশনে জুলছি। আপােষ করি নাই কোন অন্যায়ের কাছে। মাথা নত করি নাই কোন অন্যায়ের কাছে। জীবন ভরে সংগ্রাম করেছি আর এই দুঃখী মানুষ যে রক্ত দিয়েছে, স্বাধীনতা এনেছে, তাদের রক্তে বিদেশ থেকে খাবার আনবাে, সেই খাবার চুরি করে খাবে, অর্থ আনবাে সেই অর্থ চুরি করে যাবে, টাকা আনবাে তা বিদেশে চালান দিবে। বাংলার মাটি থেকে এদের উৎখাত করতে হবে।
এই বক্তৃতা থেকেই আমি ওয়াদাবদ্ধ হয়েছি। আজ আমাদের কি অবস্থা। আজ আমার পপুলেশন কন্টোল করে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। ভিক্ষুকের জাতের কোন উজ্জত আছে? দুনিয়ায় জীবন ভরা ভিক্ষা পাওয়া যায়? স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সে জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়ােজন রয়েছে। কাজ করবাে না ফাকি দিব, অফিসে যাব না ফাঁকি দিক, ফ্রি-স্টাইল। ফ্রিস্টাইল মানে গণতন্ত্র নয়। অফিসে ১০টার আগে যাব না। পাঁচটায় ছুটি হলে ৩টায় ফিরে আসতে হবে। কারখানায় কাজ করবাে না। পয়সা দিতে হবে। আমার শ্রমিকরা খারাপ না। আমার শ্রমিকরা কাজ করতে চায়। আমার কৃষকরা আজকে কাজ করতেছে।
ফুড প্রডাকশন এগিয়ে গেছে। আমরা ব্যাঘাত সৃষ্টি করি, আমরা ষড়যন্ত্র করি। আমরাই ধোকা দেই। আমরাই লুট করে খাই জমি দখল করে নিয়ে যাই। এ সকল কাজ করে কারা? আমরা এই দেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ, এই দেশের তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষ। যাদের পেটের মধ্যে দুই অক্ষর বৃদ্ধি বাংলার এইসব দুঃখী মানুষের পয়সায় এসেছে তারা আজকে এ কথা ভুলে যায়। কথা হলাে কি ছিলাম? আমি কি পেলাম আজ আমি কি দিলাম। আজ সেই খানেই প্রশ্ন। আমি বারবার বলেছি আজকে আমাদের আত্মসমালােচনার প্রয়ােজন, আজকে আমাদের আত্মসংযমের প্রয়ােজন। আজকে আমাদের আত্মশুদ্ধির প্রয়ােজন। নচেৎ দেশকে ভালবাসা যায় না। এবং দেশের উন্নতি করা যায় না। ফলে কারখানায়, ক্ষেত-খামারে আমাদের প্রডাকশন বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশ বাঁচাতে পারে না।
সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত