সংসদে বঙ্গবন্ধুর
ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
(গত শনিবার সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছেন তার শেষাংশ আজ প্রকাশিত হল। তার ভাষণের অংশবিশেষ গতকাল প্রকাশিত হয়।)
স্বাধীনতাকে গ্রহণ করে নিশ্চিন্ত থাকো। কিন্তু অনেকের পরিবর্তন হয় নাই। তারা এখনাে। গােপনে বিদেশীদের কাছ থেকে পয়সা এনে বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তারা মনে করে যে খবর রাখি না। এত বড়-যারা আজকে একটা মানুষকে রাতের অন্ধকারে হত্যা করে, যে মনে করেছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় সিরাজ সিকদার? তাকে যদি ধরা যায়, আজ তার যে দলবল-সবাকে যদি ধরা যায়, ধরতে পারব না কোন অফিসার ঘুষ খান? ধরতে পারব না কোন অন্ধকারে যেয়ে বিদেশের পঁয়সা খান? ধরতে পারব না কোথায় তারা পয়সা লুট করেন? ধরতে পারব না কারা মজুতদার আছেন? ধরতে পারব না কারা ব্লাক মার্কেটিংএ আছেন? নিশ্চয়ই ধরতে পারব। সময়ের প্রয়ােজন। যেতে পারবে না কেউ ইনশাআল্লাহ, পাপ একদিন ধরা দেবেই, এটা মিথ্যা হতে পারে না।
আর কোন দিন দুনিয়ার পাপ আর পূণ্য পাশাপাশি চলতে পারে না। পূণ্য চলে একদিকে আর পাপ চলে এক দিকে। পাপ আর পূণ্য যে এক সাথে চলতে পারে না, একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আমরা যাদের ক্ষমা করেছিলাম, তারা গ্রামে গ্রামে বসে আমাদেরকে দুঃখদুর্দশার মধ্যে আজকে কটাক্ষ করে। বন্ধ করে দেওয়া হবে সব। তাদেরকে অধিকার দেওয়া হবে স্বাধীনতা নস্যাৎ করার জন্য? কোন দেশে দেয় নাই, আমরা দিয়েছিলাম মাফ। মাফ যদি করতে
পারা যায় তাহলে কেমন করে কঠোর হস্তে দমন করতে হয় তাও আমরা জানি। আজ আমাকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে একথা বলতে হচ্ছে।
আজকে সংশােধিত সংবিধান যে নতুন সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি এটাও গণতন্ত্র। শােষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভােটাধিকার থাকবে। এখানে আমরা সমাজতন্ত্র করতে চাই। এখানে আমরা শােষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে কোনদিন আসতে পারবে না, আমরা এলাও করব না। বাংলাদেশকে ভালবাসব না, বাংলার মাটিকে ভালবাসব না, বাংলা ভাষাকে ভালবাসব না, বাংলার কালচারকে ভালবাসব না, আর এখন পর্যন্ত বিকল্প আমি ফ্রি স্টাইল দিয়ে দিয়েছিলাম যার যা ইচ্ছে তার তা লেখে। কেউ এ নামে বাংলাদেশকে তাকে বেনামে বাংলাদেশকে ডাকে, বাংলাদেশের নাম পর্যন্ত বলতে তারা লজাবােধ করে। তাদের অধিকার নাই বাংলার মাটিতে থাকার। যেমন নাই চোরাকারবারী, ঘুষখাের, যেমন নাই দুর্নীতিবাজদের, তেমনি নেই এ সমস্ত সন্ত্রাসবাদী যারা মনে করে, ভুলে যান, ভুলে যান, ভুলে যান, ভুলে যান। বাংলার মাটি, বাংলার আজকে এই অবস্থার মধ্যে দেশকে চলতে দেওয়া যায় না। আমাদের পরিবর্তন দরকার। কিন্তু শুধু না যদি মানুষের মেন্টাল পরিবর্তন না হয়। এবং সে জন্য আজকে শুধু আমরা যারা এখানে উপস্থিত আছি, যারা জনগণের প্রতিনিধি, জনগণের ভােটের মাধ্যমে এসেছি, আমাদের কর্তব্য সঙ্গে সঙ্গে জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে, দলমত বাংলার জনগণ যে যেখানে আছেন আজকে থেকে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, স্পীকার সাহেব, যে আমরা নতুন জীবন শুরু করব, আমরা নতুন বিপ্লব শুরু করব, কেন করতে পারব না? পারি নাই? পহেলা মার্চ থেকে পঁচিশ মার্চ পর্যন্ত আমার ঘরে বসে তিন-চারজনকে নিয়ে সমস্ত বাংলার মানুষের মুভমেন্ট আমরা চালাই নাই। একটা চুরি হয় নাই, একটা ডাকাতি হয় নাই, ভলানটিয়াররা কাজ করেছে। নতুন জীবন সৃষ্টি করতে হবে। মানুষকে মােবিলাইস করতে হবে। মানুষ ভাল। বাংলার মানুষের মত মানুষ কোথায়ও নাই। বাংলার গরীব ভাল, বাংলার কৃষক ভাল, বাংলার শ্রমিক ভাল। যদি খারাপ হয়, তবে আমরা তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ। যত গােলমালের মূলে এই তারাই। যত অঘটনের মূলে তারাই। কারণ তারা হলেন ভােকাল শ্ৰেণী। তারা বক্তৃতা করেন, তারা কাগজে লেকেন। তারা এখানে করেন, তারা ওখানে করেন। তারা একটা বেশ, এ অবস্থায় দেশ চলতে পারে না। সেই জন্যই শাসনতন্ত্র আমাদের পরিবর্তন (এমেন্ড) করতে হয়েছে। এখন আমাদের সামনে কাজ কী? এক, দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে, উৎপাদন বাড়তে হবে। ফলে কারখানায় সব জায়গায়। পপুলেশান স্প্যানিং আমাদের করতে হব। আপনাদের দুর্নীতি, ঘুষ, চোরাকারবারী, মুনাফাখখারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। আমাদের কী করতে হবে। আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বাঙালী জাতি যে প্রাণ, যে অনুপ্রেরণা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিল, সেই প্রাণ সেই অনুপ্রেরণা সেই মতবাদ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। দেশের দুঃখী মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য, তাদের মুখে হাসি ফোটাবার জন্য। স্পীকার সাহেব, এজন্য আজ আপনার মাধ্যমে যারা যেখানে আছেন, যারা দেশকে ভালবাসেন, সকলকে আমি আহবান করব আসুন, দেশ গড়ি। আসুন, দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাই। আসুন আমরা দেশের মানুষের দুঃখ দূর করি। তা না করতে রিলে ইতিহাস আমাদেরকে মুখে কলঙ্ক লেপন করবে। স্পীকার সাহেব, বড় দুঃখ, এই হাউজের, আমি লিডার ছিলাম পার্টির আমি লিডার, তখন আমি এখানে এই সিটে আমি বসতাম। আমার সকর্মীরা আজ আমাকে-আমার ফেবারশীপ কেড়ে নিয়ে গেছে, আমি মেম্বার থাকতে পারলাম না। আমাকে তারা প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছে এবং আজকে নতুন সিস্টেমে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। সিস্টেম পরিবর্তন করেই আমরা সাকসেসফুল হতে পারব না। যদি আপনারা চেষ্টা না করেন এবং আপনারা যদি নিঃস্বার্থভাবে যেভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছিলেন, নিঃস্বার্থভাব পঁচিশ বছর সংগ্রাম করেছিলেন; সেই সংগ্রাম আপনারা না করেন, অন্যায় অবিচার দুর্নীতির বিরুদ্ধে, গঠনমূলক কাজে, দেশ গড়ার কাজে, উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে, তাহলে খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি এ অনুরােধ করব, চলুন, আমরা অগ্রসর হই। বিসমিল্লা করে আল্লাহর নামে অগ্রসর হই। ইনশাল্লাহ আমরা কামিয়াব হবাে। খােদা আমাদের সহায়। আছেন। এত বড় দুর্ধর্ষ, এত বড় শক্তিশালী, এত বড় বন্দুক, এত কামান, এত মেশিনগান, এত পাকিস্তানী সৈন্য, এত বড় তথাকথিত শক্তিশালী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, ইসকান্দার মীর্জা, চৌধুরী মােহাম্মদ আলী, বাংলার মানুষকে অত্যাচার করতে চেষ্টা করেছে বন্দুক দিয়ে, তার বিরুদ্ধে বিনাঅস্ত্রে আপনাদের নিয়ে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত যদি উৎখাত করতে পারি তাহলে কিছু দুর্নীতিবাজ, কিছু ঘুষখাের, কিছু শােষক, কিছু লােক মার্কেটার্স বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে পারব না-এ বিশ্বাস আমি করি না। যদি সকলে মিলে আপনারা নতুন প্রাণ, নতুন মন নিয়ে খােদাকে হাজির নাজের করে নিজের আত্মসমালােচনা করে, আত্মসংশােধন করে, আত্মশুদ্ধি করে যদি ইনশাল্লাহ কাজে অগ্রসর হন, বাংলার জনগণ আপনাদের সাথে আছে, বাংলার জনগণ আপনাদের পাশে আছে, জনগণকে আপনারা যা বলবেন তারা তাই করবে। আপনাদের অগ্রসর হতে হবে। ইনশাল্লাহ আমি কামিয়াব হব। আর আপনাদের সকলকে আমি মােবারকবাদ জানাই। আমার পার্টি আছে এবং আপনারা পার্টির সদস্য। বহু দুঃখের দিন আপনাদের নিয়ে চালিয়েছি। সুখের মুখ আমরা দেখি নাই। এই ক্ষমতায় যে আমরা আছি-এই ক্ষমতা সুখ নয়। এ বড় কষ্ট, বড় কষ্টকাকীর্ণ এই ক্ষমতা। তবু আমাদের আজ কাজ করতে হবে।
স্পীকার সাহেব, আমি সকলকে ধন্যবাদ দিই, স্টাফকে ধন্যবাদ দিই, যারা কর্মচারী তাদের ধন্যবাদ দিই, সহকর্মীদের ধন্যবাদ দিই, সকলকে ধন্যবাদ দিই। আমি আপনাদের একজন এবং একজন হিসাবে থাকব। আমি আপনাদের পাশে থাকব। আপনাদের মধ্যে থাকবাে। এবং আপনাদের দিয়ে কাজ করব। বিশেষ, আমাদের সেই গবর্নমেন্ট থাকবে, মন্ত্রী থাকবে, সব থাকবে, কাজ কম করবে, কোন অসুবিধা হবার কারণ নেই। তবে কথা হল এই, যে সবচেয়ে বড় কাজ আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষের মুক্তির জন্য আন্তরিকতা ও সততার সাথে কাজ করতে হবে। আমি আপরাতের আপনাদের আবার ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি।
জয় বাংলা
সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত