You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.01.26 | দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানােই লক্ষ্য | দৈনিক বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানােই লক্ষ্য

সাংবিধানিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এটা আমার দ্বিতীয় বিপ্লব। এর লক্ষ্য দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা।
গতকাল জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী বিল পাস হবার পর প্রদত্ত নীতিনির্ধারণী ভাষণে দেশের বর্তমান অবস্থাকে সংকটজনক অভিহিত করে আশু কর্মসূচী হিসেবে তিনি চারটি কর্মসূচির কথা ঘােষণা করেন। এগুলি হচ্ছে: উৎপাদনের ভিত্তিতে দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি, ঘুষ,কালােবাজারী, চোরাচালান প্রভৃতি সমাজবিরােধী কার্যকলাপ দমন এবং দায়িত্ব পালনের জন্যে কাজ করা।
বঙ্গবন্ধু বলেন, এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য শােষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এ কাজে সকলের সহযােগিতা, কামনা করে তিনি দলমত জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশবাসীর প্রতি এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, প্রেসিডেন্ট পদ্ধতিতে জনগণের পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চয়তা রয়েছে। তারা প্রত্যক্ষ ভােটে অবাধে রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্যদের নির্বাচিত করতে পারবে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ের মত ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গঠনের কাজে এগিয়ে আসার জন্যে সকলের প্রতি উদ্বত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, দেশকে যারা ভালবাসেন, দেশের জন্যে যারা কাজ করতে চান, চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে যারা বিশ্বাস করেন তারা এগিয়ে আসুন।

সাধারণ মানুষ দুর্নীতি করে না
যে কারণে এই সাংবিধানিক পরিবর্তন করতে হলাে তার পটভূমিকা বিশ্লেষণ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রায় ৪০ মিনিট স্থায়ী বক্তৃতায় দুর্নীতিবাজ, চোরাচালানী কালােবাজারী এবং বিদেশী শক্তির এজেন্টদের কঠোর সমালােচনা করে বলেন, এদেরকে উৎখাত করতে হবে। এই প্রসঙ্গে এক শ্রেণীর শিক্ষিত মানুষের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের কৃষক বা সাধারণ মানুষ দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে দেশের শতকরা ৫ ভাগ এই শিক্ষিত মনুষেরা। এরা রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে দুর্নীতি করে, খাদ্য বিতরণে দুর্নীতি করে, বিদেশ থেকে খাবার আনলে চুরি করে খায়, টাকা বিদেশে চালান দেয়। তিনি বলেন, এই সব দুর্নীতির মুলােৎপাটন করতে হবে।

সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারী
সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, এদের অনেকেই বাংলাদেশকে এখনও অন্য নামে ডাকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে যারা স্বীকার করে না বা চায় মূলনীতিতে বিশ্বাস করে না, তাদের স্থান এদেশে নেই। এই সাথে ক্ষমাপ্রাপ্ত পাকিস্তানী দালালদের তৎপরতার সমালােচনা করে তিনি বলেন, এদের সব খবরই আমরা রাখি। তিনি বলেন, এদেরকে ক্ষমা করেছিলাম। বলেছিলাম দেশকে ভালবাসাে কিন্তু এদের অনেকেরই কোন পরিবর্তন হয়নি।

বিদেশি এজেন্ট
বঙ্গবন্ধু বলেন, সংবিধানে প্রথম থেকেই ভােটের মাধমে সরকার পরিবর্তনের সুযােগ দেওয়া হয়েছে। বিপ্লবের পর কোন দেশে যেসব গণতান্ত্রিক অধিকার দেওয়া হয় না আমরা তা দিয়েছি। কিন্তু এসবের সুযােগ নিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক চক্রান্তের একটি উত্তপ্ত ক্ষেত্রে পরিণত করার চেষ্টা চলেছে। তিনি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, বিদেশের টাকায় তাদের এজেন্ট হিসেবে যারা আমাদের সার্বভৌমত্ব নস্যাতের চেষ্টা করছে তাদেরকে দেশের মাটি থেকে উৎখাত করা হবে। তিনি বলেন, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ত দিয়েই রক্ষা করবাে। স্বাধীনতাকে নস্যাৎ হতে দেব না। সমাজবিরােধী দমন। বঙ্গবন্ধু, বলেন, গণতন্ত্র মানে ফ্রীস্টাইল’ নয়। যা ইচ্ছে তাই করা নয়। গভীর ক্ষোভের সাথে তিনি বলেন, একদিকে মানুষ যখন অনাহারে মরছে আর্থিক সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অপরদিকে তখন এক শ্রেণীর লােক দুর্নীতি, মুনাফাবাজী, মজুতদারী।, চোরাচালানি ও গুপ্তহত্যায় লিপ্ত রয়েছে। তিনি বলেন, এই অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। এই ফ্রী স্টাইলের অবসান ঘটতে হবে। এই ধরনের সমাজবিরােধীদের কঠোর হাতে দমন করা হবে বলে তিনি ঘােষণা করেন।
এই প্রসঙ্গে জাতির জনক বলেন আমাদের আত্মসমালােচনা ও আত্মশুদ্ধির প্রয়ােজন মানসিক পরিবর্তনের। আমাদের নিজেদেরকে জনগণের প্রভু হিসেবে মনে করলে চলবে না। আমাদেরকে হতে হবে জনগণের সেবক।
উৎপাদন বাড়াতে হবে। দেশকে সার্বিক লক্ষ্যে এগিয়ে নেবার জন্যে কঠোর শৃঙ্খলাবােধের ওপর গুরুত্ব আরােপ করে জাতির জনক বলেন, কলে-কারখানার ক্ষেতে-খামারে আমাদের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কৃষকদের উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, তারা উৎপাদন বাড়াতে চায়। খাদ্য উৎপাদন বা বেড়েছে তা তাদেরই জন্যে। তিনি বলেন, আমরা কোন কিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নই। উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলাদেশের ওপর ইংরেজ ও পাকিস্তানীদের দীর্ঘদিনের শােষণের পরিণতির কথা উল্লেখ করে বলেন, আমাদেরকে ভিক্ষুকে পরিণত করা হয়েছে। আমাদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ভিক্ষুকের কোন সম্মান থাকে না। তিনি বলেন, একটা ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব আমি করতে চাই না।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালের ধ্বংসকারী ভয়াবহ বন্যা প্রভৃতির কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, শূন্য হাতে শুরু করলেও দায়িত্ব পালনে আমরা ব্যর্থ হই নাই। দেশকে আমরা প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি। এই প্রসঙ্গে তিনি বিদেশ থেকে সাহায্য সংগৃহ ও সরকারি তহবিল থেকে জনগণকে সাহায্য দানের একটি হিসাব এবং একের পর এক দুর্যোগ মােকাবিলায় সরকারী কর্মতৎপরতার বিবরণ দেন।

ঔপনিবেশিক কানুন চলতে পারে না
ঔপনিবেশিক আমলের আইন-কানুন স্বাধীন দেশে চলতে পারে না। বলে তিনি মন্তব্য করেন। এই পর্যায়ে তিনি বিচার বিভাগের কথা উল্লেখ করে বলেন, বিচার ব্যবস্থাকে তরান্বিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, ‘জাস্টিস ভিলেড-জাস্টিস, ডিনাইড।’
জনগণের সেবায় নিঃস্বার্থ ও আন্তরিকভাবে আন্তঃনিয়ােগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একথা মনে রাখতে হবে যে সরকারী কর্মচারীরা যে বাড়িতে থাকেন যে গাড়িতে চড়েন জনগণের পয়সা দিয়েই তার ব্যবস্থা করা হয়।
মনুষ্যত্বের মর্যাদার ওপর গুরুত্ব আরােপ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, মানুষ পশু নয়। তাকে মানুষের মতই আচরণ করতে হবে।
দুঃখী মানুষের জন্যে তার সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৩৮ সালে সেই স্কুল আজ পর্যন্ত তিনি বিশ্রাম নেন নাই। আজও পর্যন্ত তিনি দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করে চলেছেন। আবেগ জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এই দুঃখী মানুষের জন্যেই সংবিধানের এই পরিবর্তন করতে হলাে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যথেষ্ট ক্ষমতা আমার ছিল। দুইতৃতীয়াংশ শুধু নয় তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা আমার ছিল। কিন্তু, শােষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এই অবস্থার পরিবর্তন করে নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হলাে। জাতির জনক বলেন, আমরা এখন এক জাতীয় সরকার সংগঠিত করতে চলেছি।
সমাজবিরােধীদের দমনের ব্যাপারে দৃঢ় আশা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, যে জাতি পাকিস্তানীদের পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছে তারা এদেরকেও দমন করতে অবশ্যই সক্ষম হবে। তিনি বলেন, সিরাজ শিকদার ও তার দলের লােকদের যদি ধরা সম্ভব হয় তবে এদেরকে ধরা যাবে না কেন? বিদেশীর কাছ থেকে ছােটখাট উপঢৌকনের বিনিময়ে যারা তাদের কাছে রাষ্ট্রবিরােধী প্রচারণা চালায় বঙ্গবন্ধু তাদেরও তীব্র সমালােচনা করেন। | দেশগঠনের কাজে আত্মনিয়ােগের যথেষ্ট সুযােগ রয়েছে বলে উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু, সকলের প্রতি শােষণহীন সমাজ গঠনের কাজে আন্তরিকভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত