You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাষ্ট্রপতি পদে বঙ্গবন্ধু: প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতীয় সংসদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংবিধান সংশােধন করা হয়েছে: বাংলাদেশে প্রবর্তন করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। নতুন ব্যবস্থায় প্রজাতন্ত্রের শাসনক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হতে ন্যস্ত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। তিনি একজন উপ-রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদ নিয়ােগ করবেন। মন্ত্রিসভার একজন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। জাতীয় পরিষদে গৃহীত সংশােধনী আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি দেশে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল রাখার আদেশ দিতে পারবেন।
জাতীয় সংসদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে দেশের রাজনৈতিক জীবনে যে বিশাল পরিবর্তন সংঘটিত হল তা আপামর মানুষের জীবনে শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে বলে প্রতিটি মানুষের মনে দৃঢ় প্রত্যাশা রয়েছে। বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলায়, শৈথিল্য থেকে কর্মতৎপরতার অবক্ষয় থেকে সৃজনশীলতার হতাশা থেকে আশার উত্তরণের জন্যে এই তাৎপর্যমণ্ডিত পরিবর্তন। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এই পরিবর্তন হচ্ছে তার দ্বিতীয় বিপ্লব। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তােলাই এই বিপ্লবের লক্ষ্য। শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে এই নতুন পদক্ষেপ।

আজকের এই পরিবর্তনের পটভূমি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শনিবার রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেছেন। সংসদ ভবনের বারান্দায় বেলা ১-১৫ মিনিটে এক সংক্ষিপ্ত ও অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শপথ গ্রহণপর্ব শেষ হয়। রাষ্ট্রপতির শপথবাক্য পাঠ করান সংসদের স্পীকার জনাব আবদুল মালেক উকিল।
এর আগে সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী বিল পাসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হন। উক্ত বিল পাসের ফলে বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠিত হলাে। রাষ্ট্র পরিচালনায় মূলনীতিসমূহ অধিকতর কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত করার উদ্বেগ সংবিধান সংশােধন করা হয়েছে।
গতকাল সকালে জাতীয় সংসদে সংবিধান (চতুর্থ সংশােধনী) বিল, ১৯৭৫, সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। বিলের পক্ষে ২৯৪ জন সদস্য ভােট দেন বিপক্ষে কেউ ভােট দেননি।
সংশােধনী বিলে রাষ্ট্রপতি সংক্রান্ত বিশেষ বিধানে বলা হয় যে এই আইন প্রবর্তনের অববাহিত পূর্বে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির পদে থাকবেন না এবং রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং রাষ্ট্রপতির কার্যভার গ্রহণ করবেন এবং উক্ত আইন প্রবর্তন হতে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন কেননা তিনি এই আইনের দ্বারা সংশােধিত সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন।
সংশােধিত সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি ও একজন উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন। রাষ্ট্রপতি প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। উপরাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।
রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে ৫ বছরের মেয়াদে স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পূর্বে অপসারিত না হলে উপরাষ্ট্রপতিও কার্যভার গৃহণের তারিখ হতে ৫ বছরের জন্য স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি তাদের কার্যকাল সময়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন না। কোন সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি হলে কার্যভার গ্রহণের দিনে সংসদে তার আসন শূন্য বলে গণ্য হবে।
প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে থাকবে। তিনি প্রত্যক্ষ তবে অথবা তার অধীনস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে এই ক্ষমতা প্রয়ােগ করবেন। রাষ্ট্রপতি তার আদেশের মাধ্যমে যে ক্ষমতা নির্ধারণ করবেন উপরাষ্ট্রপতি সে ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারবেন।
রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব পালনে সাহায্য ও পরামর্শ দানের জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ থাকবে। রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য হতে কিংবা সংসদ সদস্য হওয়ার যােগ্য এরূপ ব্যক্তিদের মধ্য হতে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং আবশ্যক মনে করলে অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়ােগ করতে পারবেন।
প্রত্যেক মন্ত্রী সংসদে বক্তৃতা করতে এবং কার্যাবলীতে অংশ নিতে পারবেন। তবে তিনি যদি সংসদ সদস্য না হন তাহলে ভােটদান করতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা তার নির্দেশে উপরাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী ঐ সভায় সভাপতিত্ব করবেন। মন্ত্রিগণ রাষ্ট্রপতির সন্তোযানুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন।
সংশােধিত সংবিধা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেশে শুধু একটিমাত্র রাজনৈতিক দল গঠন করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে যা জাতীয় দল নামে অভিহিত হবে। | এই সংশােধনীর ফলে জাতীয় সংসদের মেয়াদ গতকাল হতে ৫ বছর করা হলাে। এখন থেকে প্রতি বছর সংসদের অন্তত: দুটি অধিবেশন হবে।

উপরাষ্ট্রপতি

উল্লেখ্য সংবিধানের সংশােধনী অনুযায়ী বাংলাদেশের একজন উপরাষ্ট্রপতি থাকবেন। তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। ৩৫ বছরের কম বয়স্ক হলে অথবা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যােগ্য না হলে অথবা সংবিধানের অধীন উপরাষ্ট্রপতির পদ হতে অপসারিত হয়ে থাকলে কোন ব্যক্তি উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হওয়ার যােগ্য হবেন না। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক তার পদ হতে পূর্বে অপসারিত না হয়ে থাকলে উপরাষ্ট্রপতি কর্মভার গ্রহণের তারিখ হতে পাঁচ বছরের মেয়াদে তার পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। উপরাষ্ট্রপতি তার কার্যভারকালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যােগ্য হবেন না এবং কোন সংসদ সদস্য উপরাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হলে উপরাষ্ট্রপতিরূপে তাঁর কার্যভার গ্রহণের দিনে সংসদে তাঁর আসন শূন্য বলে গণ্য হবে।
সংবিধানের ৫৩ অনুচ্ছেদের হানি না ঘটিয়ে বিধান করা হয়েছে যে উপরাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বা অনুরূপ বিবেচনায় কোন কাজ করে থাকলে সে জন্যে কোন আদালতে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে না। তবে, এই দফা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যধারা; গ্রহণে কোন ব্যক্তির অধিকার ক্ষুন্ন করবে না। উপরাষ্ট্রপতির কার্যভারকালে তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কেন ফৌজদারী কার্যধারা দায়ের করা বা চালু রাখা যাবে না এবং তার গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্যে কোন আদালত হতে পরােয়ানা জারি করা যাবে না।
সংবিধানের সংশােধনী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা ও
পরামর্শ দান করেছেন কিনা এবং করে থাকলে কি পরামর্শ দান করেছেন, কোন আদালত সে সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবেন না।
সংবিধানের সংশােধনী অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি তার বিবেচনায় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে অথবা সংসদ সদস্য হওয়ার যােগ্য ব্যক্তিদের মধ্য হতে একজন প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি যেরূপ আবশ্যক মনে করবেন সেরূপ অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়ােগ করবেন। তবে কোন প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রী পরিষদের সদস্য হবেন না।
মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির সন্তোষ অনুযায়ী সময়সীমা পর্যন্ত নিজ পদে বহাল থাকবেন। রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা তিনি এসব সভায় উপরাষ্ট্রপতি অথবা প্রধানন্ত্রীকে সভাপতিত্ব করতে নির্দেশ দান করতে পারবেন। রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযােগে কোন মন্ত্রী স্বীয় পদত্যাগ করতে পারবেন।

বিদ্রোহী কবিকে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কবির সাহিত্য কর্মের জন্যে তাঁকে এই ডিগ্রি প্রধান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সাবেক রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদুল্লাহ গতকাল এক জাঁকজমকপূর্ণ সমাবর্তন উৎসবে কবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিজ্ঞান পত্র অর্পণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড: আবদুল মতিন চৌধুরী রেজিস্টার, বিভিন্ন অনুষদের ডীনগণ সমাবর্তন পােশাকে সজ্জিত হয়ে কবিকে নিয়ে মােটর মিছিল করে বঙ্গভবনে আসেন। কলা অনুষদের ডীন প্রফেসর আহমেদ শরীফ কবিকে অভিজ্ঞানপর পদানের জন্যে উপস্থাপন করেন।
উল্লেখযােগ্য যে, এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক বিশেষ সম্যাবর্তন অনুষ্ঠানে আটজন বিশিষ্ট শিক্ষব্রতী ও শিল্পী সাহিত্যিকদের সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধি দেওয়া হয়। কবি নজরুল অসুস্থ বিধায় তাঁকে পৃথক অনুষ্ঠানে এই অভিজ্ঞানপত্র দেওয়া হলাে।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!