You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

এই তিন বৎসর পর্যন্ত গড়ে এর চেয়ে অনেক বেশি মাল আনতে হয়েছে। প্রথম আনতে হয়েছে ত্রিশ লক্ষ টন। পাঁচশাে চল্লিশ লক্ষ মন খাদ্য যদি ধরুন, গড়ে প্রত্যেক বৎসর আনতে হয় বিদেশ থেকে, কোথায় পাওয়া যাবে, কে দেবে? জাহাজ ভাড়া কোথায়? বিশ থেকে ত্রিশ লক্ষ টন। প্রতিবছর আমাদের আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে এই তিন বৎসরে। বন্ধুরাষ্ট্ররা সাহায্য করেছে। ধার দিয়েছে, লােন দিয়েছে, জানতেছি। খাবার দেবার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। কতকাল দেবে? কদ্দিন দেবে? মানুষ বাড়ছে। বৎসরে ত্রিশ লক্ষ লােক আমার ঘাড়ে। আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল করতে হবে। না হলে বিশ বৎসর পরে ১৫ কোটি লোেক হয়ে যাবে। পঁচিশ বৎসর পরে?
চুয়ান্ন হাজার স্কোয়ার মাইল, বাঁচতে পারবে না। যেই ক্ষমতায় থাকুন বাঁচার উপায় নাই, অতএব পপুলেশন কন্ট্রোল আমাদের করতেই হবে। সে জন্য ডেফিনিন স্টেপ আমাদের দিতেই হবে বাংলাদেশে। প্রােডাকশন বাড়াতে হবে। নাহলে মানুষ বাঁচতে পারবে না। প্রােডাকশন বাড়াবার জন্য শৃঙ্খলাবােধ হতে হবে। বিশৃঙ্খল জাতি কোনদিন বড় হতে পারবে না। উচ্ছংখল হয়ে গেছি আমরা। ফ্রি স্টাইল, এটা হবে না, ওটা হবে না, আর বাজে এ্যারিস্ট করব বলবে যে অমুক পার্টির লােক। খবরের কাগজে বিবৃতি। জিনিসপত্র এক জায়গায় যান একদিন হঠাৎ ১০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা হয়ে গেল। খবরের কাগজে খবর হলাে তাতে গভীরের কি?
কিনতে হবে। ঔষধ সেল্ফসাফি খাবার সিয়েন্ট না। আমরা কলােনী ছিলাম পাকিস্তানীদের। আমাদের সবকিছু প্রতিষ্ঠা করতে হবে, সবকিছু বিদেশ থেকে আনতে হবে। কোথায় পাবেন বৈদেশিক মুদ্রা আপনারা? ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হবে। ইনকাম করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুক জাতির নেতৃত্ব করতে আমি চাই না। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হােক, এবং সে জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে। এবং শৃংখলা দেশের মধ্যে আনতে হবে। আজকের এই সংশােধন কম দুঃখে করি নাই, স্পীকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করেছে, একথা যদি কেউ মনে করে যে জনগণের ভােট অধিকার আমরা কেড়ে নিয়ে গেছি-ননা। আজকে এখানে যে সিস্টেম করা হয়েছে তাতে পার্লামেন্টের মেম্বারদের জনগণ দ্বারা জনগণের ভােটে নির্বাচিত হবে। যে প্রেসিডেন্ট হবে তাকেও জনগণের ভােটে নির্বাচিত হতে হবে। জনগণের ভােটাধিকার আছে। তবে এইটুকু আমরা আজকে একটা কোর্টে বিচারে গেলে একটা যদি সিভিল মামলা হয়, আপনি তাে উকিল স্পীকার সাহেব। আল্লাহর মর্জি যদি একটা মামলা সিভিল কোর্টে হয় বিশ বৎসরেও সে মামলা শেষ হয় বলতে পারেন আমার কাছে। বাপ মরে যাবার সময় বাপ দিয়ে যায় ছেলের কাছে। আর উকিল দিয়ে যায় তার জামাইয়ের কাছে সেই মামলা। আজ ক্রিমিনাল কেস হলে এই লােয়ার কোর্ট , জজ কোর্ট-বিচার নেই। জাস্টিস দ্রুততর কাজ করতে হবে। কাজ করে প্রােডাকশান বাড়াও। নিশ্চয় তােমরা তার অধিকার পাবে। কাজ করবে না, পয়সা নেব, সে পয়সা হবে না। কার পয়সা নেবে? গরীবের উপর ট্যাক্স বসাব? খাবার আছে তার, কাপড় আছে তার? তার ঘর থেকে ধন কোথেকে আনি? পারব না। তােমাদের কাজ করে প্রােডাকশন করতে হবে। ক্ষেতে-খামারে কাজ না করলে তােমরা জমির উপর থাতে পারবে না। আমার সেখানে প্রােডাকশান বাড়াতে হবে। জানি আমাদের অনুবধ্যা আছে। বন্যা আমাদের নিয়ন্ত্রণ হয় নাই। আমাদের বন্যা হয়ে যার প্রত্যেক বৎসর, সাইলেনু না হয় প্রত্যেক বৎসর, ন্যাচারাল প্ল্যামেটি হয় সেটা বােঝা গেল। আজ আমাদের কথা কি-আজ শােষণহীন সমাজ গড়তে হবে। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজকের থেকে নয়। আপনি মেম্বার ছিলেন প্রথম দিন থেকে স্পীকার সাহেব। আপনি জানেন এই দল-এই সংজ্ঞা নিয়ে সংগ্রাম করেছে। কারাে কাছে কোন দিন আপােস করে নাই।, মাথা নত করে নাই। আজ দুর্নীতিবাজ, ঘুষখাের, কালােবাজারী, নতুন পয়সায়লা, এদের কাছে আমার অস্ত্র বিক্রি করতে হবে, এদের অধিকারের নামে আমাদের এদেরকে ফ্রি স্টাইল ছেড়ে দিতে হবে। কখনাে না। কোন দেশে কোন যুগে তা দেয় নাই। দিতে পরে না। যারা আজকে আমার মাল বিদেশে চালান দেয়, চোরাকারবারী করে, যারা দুর্নীতি করে এদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। মানুষেকে যারা পয়সা দেয়, তােমার খাজনা দেয়, তােমার সংসার চালানাের জন্য ট্যাক্স দেয়, তার কাছে তুমি আবার পয়সা দাও। মেন্টালিটি চেঞ্জ করতে হবে। সরকারী কর্মচারী, মন্ত্রী প্রেসিডেন্ট আমরা জনগণের সেবক, আমরা জনগণের মাস্টার নই।
এ পর্যন্ত একটা মাত্র প্রশ্ন করেছি, তােমরা না খেয়ে মরছ, খাবার চাল নাই, গায়ে তােমাদের কাপড় নাই, তােমরা কেন আমাকে দেখতে এসেছ? তােমরা কেন আমাকে ভালবাস? আমি ত বুঝতে পারছি রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার লােক। আমি সহকর্মীদের কাছে বারবার বলেছিলাম যে আমার কাজ করেছি, তােমরা এবার আমাকে ছুটি দাও বলেছি, আমি বহুদিন, পয়ত্রিশ বৎসর আমি এদেশে ১৯৩৮ সালে, আমার যখন বাচ্চা বয়স, তখন আমি জেলে গেছি। তারপর থেকে একদিনও আমি বিশ্রাম করি নাই, আমি রাজনীতি করেছি। অত্যাচার আমি যা সহ্য করেছি সেসব বাদ দেন। যারা, কতলােক মারা গেছে, আমার চেয়ে অনেক মানুষ বেশি ত্যাগ স্পিকার করেছে দেশের জন্য। আমি সংগ্রাম করেছি আমার সহকর্মীদের নিয়ে। কিন্তু, একটা খেলা হয়ে গেল বাজার নিয় গেলে, দাম নিয়ে গেলে, বেশি অসুবিধা হলে গােপনে গিয়ে বলে দেয়, এই নিউজটা একটু ছাপিয়ে দেন।
আর অমনি গােলমাল লেগে গেল। ঐ যে বক্তৃতা আরম্ভ করেছিলাম। ফ্রি-স্টাইল চলে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৫৪ হাজার বর্গমাইলে। বিদেশ থেকে খাবার আনতে হয়, কাপড় আনতে হয়-কোন কিছু চলতে পারে না-এখানে ফ্রি-স্টাইল চলে না। প্রডাকশন বাড়াতে হবে। ক্ষেতখামারে উৎপাদন করতে হবে। মানুষ হতে হবে।
আমি সকলের কাছে আবেদন করব, আমি দেশবাসীর কাছে আবেদন করব আজ যে শাসনতন্ত্র, আজকে আমার দুঃখ হয়, আজ আপনারা আমাকে এই কনস্টিটিউশন অ্যামেন্ডমেন্ট-এর সঙ্গে আমাকে প্রেসিডেন্ট করে দিয়েছেন। আমার তাে ক্ষমতা কম ছিল না। প্রাইম মিনিস্টার হিসাবে সমস্ত ক্ষমতা আপনারা আমাকে দিয়েছিলেন। আমার টু-থার্ড মেজরিটি তবু আপনারা এ্যামেন্ডমেন্ট করে আমাকে প্রেসিডেন্ট করেছেন। এই সীটে আমি আর বসব না। এটা কম দুঃখ না আমার। স্পীকার সাহেব, তবু আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি শাসনতন্ত্রকে। কারণ একটা সুষ্ঠু শাসন এদেশে কায়েম করতে হবে। যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমােতে পারে। যেখানে মানুষ অত্যাচার অবিচার থেকে বাঁচতে পরে। চেষ্টা নতুন, আজ আমি করতে চাই -দিস ইজ আওয়ার সেকেন্ড রেভলিউশন। সেকেন্ড রেডলিউশন। আমাদের। এই রেভলিউশন-এর অর্থ দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে। | এর অর্থ অত্যাচার অবিচার নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। আমি চাই এই হাউজ থেকে, স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে দেশবাসী দলমত নির্বিশেষে সকলকে বলব, দেশকে ভালবাসব, জাতির চারটি প্রিন্সিপলকে ভালবাস। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৮ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!