You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংসদে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

গত শনিবার জাতীয় সংসদে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণের পূর্ণ বিবরণ:

জনাব স্পীকার
আজ আমাদের শাসনতন্ত্রের কিছু অংশ সংশােধন করতে হল। আপনার মনে আছে যখন শাসনতন্ত্র পাস করা হয় তখন আমি বলেছিলাম, এই হাউজ-এর পক্ষ থেকে, এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যদি সরকার হয় তবে এই সংবিধানেরও পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হবে।

জনাব স্পীকার
আপনি জানেন যে যুগ যুগ ধরে বাঙালী জাতি পরাধীন ছিল। দু’শাে বছরের ইংরেজের শাসন, পঁচিশ বছরের পাকিস্তানী শাসন এবং শােষণ বাংলাকে সর্বশান্ত করে দিয়েছিল। পঁচিশ বছর পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম করেছিলাম বাংলার মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। হাজার হাজার বন্দী, নেতা ও জনসাধারণ শধু কারাবরণই করে নাই, তাদের অনেককে জীবন দান করতে হয়েছিল। শাসকগােষ্ঠী অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। আমরা বহু দিন চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে বারবার আমাদের উপর আঘাত এসেছে। তারপর চরম আঘাত তারা করেছে যে আঘাতের বিনিময়ে মানুষেরও চরম আঘাত হানতে হয়। আমাদের মুক্তির দিকে তাকিয়ে আপনারা দেশের মানুষ নিশ্চয় আপনি বলবেন স্পীকার সাহেব, আমরা যে আওয়ামী লীগ পার্টি এক ত্যাগ স্বীকার করেছি। কোন দিন আমরা আমাদের আদর্শ বিচ্যুতি হই নাই।

জনাব স্পীকার
কর্মীরা এবং লক্ষ লক্ষ লােক দেশ ত্যাগ করে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। পরাজিত করি আমরা দুশমন বাহিনীকে। আমি নিশ্চয়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি ভারতবর্ষের জনসাধারণ ও সামরিক বাহিনীকে এবং তার সরকারকে। তারা আমাদের সাহায্য করেছিলেন। এক কোটি লােক দেশ ত্যাগ করে চলে যায়। কোটি কোটি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। তিরিশ লক্ষ লােক জীবন দিতে বাধ্য হয়। তবু আমরা চেষ্টা করেছিলাম ভেবেছিলাম দেশে যারা রাজনীতি করতে চান, দেশকে ভালাে বাসতে চান, নিশ্চয়ই তারা কাজ করবেন এবং তাদের একটা কর্তব্য রয়েছে। কোন দেশে, কোন যুগে বিপ্লবের পরে বা সশস্ত্র বিদ্রোহে ক্ষমতা দখল করে কোন দিন এইভাবে অবাধ অধিকার এবং অন্যান্য দলকে সুযােগ-সুবিধা দেয় নাই। আমরা দিয়েছিলাম। তার প্রমাণ আমাদের শাসনতন্ত্র। আপনি জানেন, স্পীকার সাহেব, কি দেখেছি আমরা, তিন বছর হল স্বাধীনতা পেয়েছি। আপনারা জানেন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা। যারা দেশ ত্যাগ করে গেল তারা দেশে ফিরে আসল। তাদের রিহেবিলিটেট করতে হবে। রাস্তাঘাট সব ধ্বংসপ্রাপ্ত। আমরা একটা সরকার নিয়েছিলাম। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সরকার যেখানে আমাদের মানুষ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তাকে ব্যাক করার মতাে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না আমরা আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল না। পাকিস্তানীরা সবকিছু এখান থেকে নিয়ে যায়। সেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যে কত কষ্টকর সেকথা যারা করেছে তারাই বুঝতে পারে আমরা বুঝতে পারছি না। এ সমস্ত বিবরণের পর দেশ থেকে অনেক দেশে লক্ষ লক্ষ লােক অনাহারে অর্ধাহারে দিনের পর দিন আশ্রয়হীন হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে তাদের পুনর্বাসন করার জন্য। কতটুকু পেরেছি না পেরেছি জানি না। শুধু এইটুকু বলতে পারি আমাদের কর্তব্য পালন করতে ত্রুটি করি নাই।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে আজ আপনার এই এসেম্বলী বা সংসদের চারজন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আগে হত্যা করা হয়েছে – যারা এই কনস্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলীর মেম্বার ছিলেন। হত্যা করা হয়েছে গাজী ফজলুর রহমানকে, হত্যা করা হয়েছে নুরুল হককে, হত্যা করা হয়েছে মােতাহের মাস্টারকে, এমন কি যা কোনদিন আমাদের দেশে আমরা শুনি নাই যে নামাজে -ঈদের নামাজে কোন লােক নামাজ পড়তে যায়, সেই নামাজের সময়ে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের হত্যা করা হয়েছে যারা স্বাধীনতার মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। তাদের হত্যা করা হয়েছে-যারা স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাদের হত্যা করা হয়েছিল-যারা ২৫ বছর পর্যন্ত এই বাংলাদেশে পাকিস্তানী শােষণের বিরুদ্ধে সংসদের বাইরে লড়াই সংগ্রামে লিপ্ত ছিল।

স্পীকার সাহেব,
৩ মাসের সময় দিয়েছি। জনগণ ভােট না দিলে তার জন্য আমরা দায়ী নই। তখন তারা বলেছিল এই সরকারকে অস্ত্র দিয়ে উৎখাত করা হবে। মুখে বলেছে তারা আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করি, নাগরিক অধিকারে বিশ্বাস করি কিন্তু গােপনে গােপনে তারা অন্য যােগাড় করেছে এবং এই সব অস্ত্র দিয়ে যাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়েছি আমরা, যারাই অস্ত্র দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তাদের হত্যা করেছে ঘরের মধ্যে রাস্তার মধ্যে নামাজের মাঠে। আমরা দেখেছি যে প্রত্যেক দেশে নিয়ম আছে যদি আপনাকে অধিকার ভােগ করতে হয়, অন্যের অধিকারকেও রক্ষা করতে হয়। ইফ ইউ হ্যাড এ লিবার্টি-ইউ হ্যাজ রেস্পনসিবিলিটি একথা ভুললে চলবে না। কিন্তু রেস্পনসিবিলিটি একথা ভুললে চলবে না। কিন্তু, রেস্পনসিবিলিটি নেবে না আর সেখানে সরকারী কর্মচারীর মধ্যে গােলযােগের সৃষ্টি করবে, জনগণের মধ্যে বেছে তারা অন্য কথা বলবে এবং তারপর তারা অস্ত্র যােগাড় করবে, রাতের অন্ধকারে মানুষকে হত্যা করবে, সশস্ত্র বিপ্লব করে ক্ষমতা দখল করবে, প্রয়ােজন হলে উৎখাত করে দেওয়া হবে। আমি যদি ইচ্ছা করি।

স্পীকার সাহেব,
স্বাধীনতা নস্যাৎ হতে দেওয়া হবে না। এবং তাদের মনে রাখা দরকার যারা আমরা দীর্ঘদিন পঁচিশ বছর, মাথা নত না করে বাংলার স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য, এদেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছি আমাদের রক্ত থাকতে এদেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার ক্ষমতা কারুর নাই। (হর্যধ্বনি) অস্ত্র আইয়ুব খান নিয়ে এসেছিলেন, অস্ত্র ইয়াহিয়া খান নিয়ে এসেছিলেন, অস্ত্র। ইসকান্দার মির্জা নিয়ে এসেছিলেন, কোনদিন তাদের কাছে মাথানত করি নাই। আজ আমাদের সত্যি অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। আমরা কি নিয়ে শুরু করেছিলাম। ভুললে চলবে না যে সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটা দেশ। লােকসংখ্যা কত বেশি এখানে, চুয়ান্ন হাজার স্কোয়ার মাইল, পঁচিশ বৎসর সমস্ত সম্পদ পাকিস্তান নিয়ে গেছে। এখানে কেন্দ্রীয় সরকার ছিল না, এখানে রেলওয়ে লাইন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এখানে পাের্ট ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, এখানে ব্যাংকের আমাদের কোনাে রিজার্ভ নাই, এখানে ফরেন একচেঞ্জ নাই, এখানে কমুনিকেশন নাই, এখানে খাদ্য নাই এখানে গুদাম নাই।…

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৭ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!