বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে দেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান: সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ
জনগণের স্বার্থে জাতির শত্রুদের কঠোর আঘাত হানতে হবে, জাতির শত্রুদের প্রতি কঠোর আঘাত হেনে সাধারণ মানুষের আশা-আকাংক্ষা সফল করে তােলার জন্যে রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদুল্লাহ আহ্বান জানিয়েছেন।
সােমবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনের উদ্বোধন করে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সুযােগ্য নেতৃত্ব ও নির্দেশ একদিন জাতীয় স্বাধীনতার আর্শিবাদ বহন করে এনেছে। আজ সে স্বাধীনতার আস্বাদ লাভের জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিক তারই প্রদর্শিত পথে দেশ গঠনের নতুন সংগ্রামে এগিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, জাতির জনক যে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আনন্দময় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন তার বাস্তবায়নই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। . গতকাল ছিল জাতীয় সংসদের চলতি বছরের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন। প্রথম দিনের এই অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি বিগত বছরগুলির কার্যক্রম ঘটনা প্রবাহের ওপর আলােকপাত করেন। তিনি বলেন, অপরিমেয় সদস্য সত্ত্বেও বিগত বছরগুলিতে অভ্যান্তরিণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্য লাভ করেছে। এই প্রসঙ্গে তিনি ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী বৃদ্ধি, বেতন কমিশনের সুপারিশের পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন, গত বছরে প্রথম পাটসালা পরিকল্পনার অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, যৌথ অভিযানের মাধ্যমে চোরাচালান বন্ধের প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার প্রভৃতির কথা উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান, মধ্যপ্রচ্যের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন এবং বিভিন্ন দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্যে আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফর পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এক নবদিগন্ত উন্মােচিত হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শান্তি, বন্ধুত্ব ও সমঝােতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এবং জোটনিরপেক্ষতার নীতি অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়েছে। ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিদান করেছে।
রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদুল্লাহ বলেন, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতির পূর্ণ সুযােগ সুবিধা জনগণকে দেওয়া হয়েছে। তবে স্বাধীনতার অর্থ যথেচ্ছাচার নয়। একটি নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিকে কঠোর শৃংখলা, সততা, অধ্যবসায়, কর্মপরায়ণতা প্রভৃতি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অগ্রগতির জন্য কাজ করে যেতে হয়। কিন্তু কতিপয় সমাজবিরােধী দুস্কৃতিকারী মজুতদার, কালােবাজারী, চোরাচালানী, ঘুষখাের ও মুনাফাখাের জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় লিপ্ত রয়েছে। তিনি বলেন, দুস্কৃতিকারীদের উৎখাতের জন্যে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তাদের হিংসাত্বক কার্যকলাপ থেকে জনগণের নিরাপত্তা বিধান ও মানুষের অর্থনৈতিক দুর্গতি আবসানে জন্যে ১৯৭৪ সালে জরুরী ক্ষমতা আইন ও দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করতে হয়। জরুরী অবস্থার নিয়মাবলীর আওতায় সমাজবিরােধীদের দমনের সর্বত্মক প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে। এবং পরে সরকার কঠোর মনােভাবের পক্ষপাতি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়ােজনীয়তার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, কৃষির উন্নতি আমাদের সার্বিক উন্নতির চাবিকাঠি। খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্যে প্রথম পরিকল্পনার শেষ নাগাদ ১৫৪ লক্ষ টন খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্য করা হয়েছে। কৃষিখাতে গতবছরে ৪৫ কোটি টাকার বদলে এবছরে ৯৭ কোটি টাকা ধরা হয়েছ এবং ১৩১ লক্ষ্য টন খাদ্য শস্য উৎপাদনের কর্মসুচী প্রণয়ন করা হয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের একটি পটভুমি তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়নের পর থেকেই বাংলাদেশ এক অর্থনৈতিক সংকট তথা অর্থনীতির ক্ষেত্রে কতকগুলি অপ্রত্যাশিত ঘটনা ও সুদুরপ্রসারী পরিণতির সম্মুখীন হয়। তবু তিনি বলেন, কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা সর্বত্র অর্জিত না হলেও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় খাদ্য ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন যথেষ্ট বাড়ানাে সম্ভব হয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার জন্যে যে অসুবিধা দেখা দিয়েছিল বর্তমানে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে চলেছি। বর্তমানে আমাদের গচ্ছিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বেশ আশাপ্রদ।
শিল্পক্ষেত্রের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্টায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বেসরকারী শিল্পখাতে অধিকতর সুযােগ সুবিধা দেওয়ার জন্যে শিল্প বিনিয়ােগ শিল্প বিনিয়ােগ নীতির পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। এই নীতি ঘােষণার পর বেসরকারী শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়ােগে উল্লেখযােগ্য সাড়া পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রপতি শিল্প শ্রমিকদের দেওয়া বিভিন্ন সুযােগ সুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব কিছুরই মূল্য উদ্দেশ্য হলাে শিল্পক্ষেত্রে উত্তরণের উৎপাদন বৃদ্ধি।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরােধের ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন সরকার জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে দ্রব্যমূল্য আনতে বদ্ধপরিকর। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে অবাঞ্চিত ব্যক্তিদের বহিস্কার ও অসাধু তৎপরতা রােধের জন্যে জোর প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে। তিনি বলেন, আমদানী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘ওয়েজ আর্নিং স্কীম’ বিশেষ সাফল্য লাভ করেছে।
যােগাযােগ ক্ষেত্রে অগ্রগতির কথা উল্লেখ করে তিনি বিভন্ন সেতু নির্মাণ ও অন্যান্য কার্যক্রম বর্ণনা করেন।
রাষ্ট্রপতি জনাব মােহম্মদুল্লাহ বিদ্যুৎ উৎপাদন তেল ও গ্যাসসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের কর্মসুচী, সংস্কৃতিক জীবন ধারার মনােনয়ন ও খেলাধুলার উৎকর্ষ সাধন, স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে ও আলােকপাত করেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় আদর্শের সাথে সঙ্গীত রেখে আমাদের সাধারণ শিক্ষা ব্যাবস্থা রূপ নিতে চলেছে। ইতিমধ্যেই শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট পেশ করা হয়েছে এবং সরকার তা পরীক্ষা করে দেখছেন।
গ্রাম বাংলার উন্নয়নের উপর গুরুত্ব আরােপ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, এর উপরই বাংলাদেশের উন্নয়ন বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এই প্রসঙ্গে তিনি সমবায়ের বাস্তব ধর্মী কার্যকারীতার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করে আশা প্রকাশ করেন যে সমবায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ এক নুতন সমাজ চেতনা লাভ করবে এবং ধাপে ধাপে সমাজ তন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে।
বন্য সমস্যার কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা শেষে দেশের মােট ৫১ লক্ষ্য ৪১ হাজার একর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ১২ লক্ষ্য ৫২ হাজার একর এলাকায় সেচ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে।
জনসংখ্যা সমস্যার মােকাবেলায় সরকারী কার্যক্রমের ওপর আলােকপাত করে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রতি বছর ২০ লক্ষ্য শিশুর আগমন ও ১০ লক্ষ্য নতুন বেকার লােকের সমাগম হচ্ছে। সরকারী কার্যক্রমের ফলে প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা শেষ জন্মহার শতকরা ৩ থেকে ২.৮ ভাগে নেমে আসবে বলে তিনি জানান। রাষ্ট্রপতি বলেন, শান্তির সর্থে অভ্যান্তরীণ শৃংখলা ও স্বার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে একটি সশস্ত্রবাহিনী অপরিহার্য। এ ব্যাপারে ও সরকার সম্ভাব্য সকল ব্যাবস্থা অবলম্বন করেছেন।
রাষ্ট্রপতি তার এক ঘন্ট স্থায়ী ভাষণের উপসংহারে বলেন, জাতীয় অভিযাত্রায় আজ আমরা এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। কতিপয় লােকের জনস্বার্থবিরােধী কার্যকলাপের জন্য কঠোর আত্মত্যাগ ও অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। জাতির শত্রুদের প্রতি কঠোর আঘাত হেনে সাধারণ মানুষের সুখ স্বপ্নকে সফল করে তুলতে হবে।
রাষ্ট্রপতি দৃঢ়বিশ্বাষের সাথে বলেন, জাতির সম্মুখে আজ যে সমস্যা তা নিতান্তই সাময়িক। সংসদ সদস্যেদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের ওপর এক মহান দায়িত্ব ন্যাস্ত। তিনি বলেন, পরবর্তী কালে ইতিহাসে যেন প্রমাণিত না হয় যে, আমরা সকলে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। বিশ্বের দরবারে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্যে প্রতিটি নাগরিককে শৃংখলার সাথে ঐক্যস্থাপনের সঙ্গে আত্ম। নিয়ােগের জন্যে তিনি আহ্বান জানান।
সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২১ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত