You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

গতকাল সােমবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি জনাব মুহম্মদুল্লাহ তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেন:
১। বাংলাদেশের জনগণের আশা আকাংখার রুপায়ণ এবং স্বাধীনতার সুফল তাদের কাছে পৌছে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব আপনাদের উপর অর্পিত। জনগণের সুন্দর ভবিষৎ গড়ে তুলতে আপনারা অনন্য ভূমিকা পালন করছেন। এই সংসদের সদস্য হিসেবে আপনারা জাতীয় জীবনে নানাবিধ সমস্যার সমাধান করে দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য ব্রতী রয়েছেন। আমি আপনাদের আন্তরিক শুভকামনা ও অভিনন্দন জানাই।
২। আজ শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মদানকারী লাখাে শহীদের অমর স্মৃতির কথা স্মরণ করি। সালাম জানাই স্বজন-সন্ত্রম-সম্পদ হারানাে অগণিত দেশবাসীকে, যারা ত্যাগের অম্লান আদর্শ স্থাপন করে মুক্তিকামী জাতি হিসাবে মানব-ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় সৃষ্টি করেছেন। জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞতার সাথে তাদের ঋণ স্বীকার করবে।
৩। নিঃস্ব ও রিক্ত অবস্থায় পাকিস্তানীদের রেখে যাওয়া ঋণের বােঝা মাথায় নিয়ে কিভাবে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যাত্রা আরম্ভ হয়-সে কথা আপনারা জানেন। অপরিমেয় সমস্যা স্বত্ত্বেও বিগত বছরগুলােতে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যথেষ্ট সাফল্যলাভ করেছে। নানাবিধ ও প্রতিকুলতার মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে যে সকল যে সকল ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে, তা হচ্ছে-২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরী বৃদ্ধি, বেতন কমিশনের সুপারিশের পর্যায়ক্রমিক বাস্তবায়ন ইত্যাদি। এছাড়া, বিগত বছরে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, যৌথ অভিযানের মাধ্যমে চোরাচালান বন্ধের প্রয়ােজনী ব্যবস্থা গ্রহণ, বেআইনী অস্ত্র উদ্ধার,-প্রভৃতি বিশেষ ভাবে উল্লেখযােগ্য। পররাষ্ট্রক্ষেত্রে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন এবং বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। বিশেষভাবে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফর পররাষ্ট্রনীতি ক্ষেত্রে এক নবদিগন্ত উন্মােচিত করেছে।
৪। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতির পূর্ণ সুযােগ সুবিধা জনগণকে দেওয়া হয়েছে। তবে স্বাধীনতার অর্থ যথেচ্ছাচার নয়। একটি নব্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জাতিকে কঠোর শৃংখলা, সততা, অধ্যাবসায়, কর্মপরায়ণতা প্রভৃতি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের অগ্রগতির জন্য কাজ করে যেতে হয়। কিন্তু কতিপয় সমাজবিরােধী, দুস্কৃতিকারী, মজুতদারী, কালােবাজারী, চোরাচালানকারী, ঘুষখাের ও মুনাফাখখার জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় লিপ্ত হয়েছ। জনগণের আশাআকাংক্ষা ধুলিসাৎ করে এরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে তৎপর রয়েছে এবং জনজীবনের নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বারবার সাবধানবাণী উচ্চরণ সত্ত্বেও এদের বােধােদয় ঘটেনি। এইসব দুস্কৃতিকারীদের উৎখাতের জন্য সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে জনগণের নিরাপত্তা বিধান এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দুর্গতি অবসানের জন্য ১৯৭৪ সালে স্পেশাল পাওয়ার্স এ্যাক্ট জারি করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত সরকারকে শাসনতন্ত্রের ১৪১-ক (১) ধারা অনুযায়ী দেশে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করতে হয়। ১৯৭৫ সালের ইমার্জেন্সী পাওয়ার্স অর্ডিন্যান্স ও ইমার্জেন্সী নিয়মাবলীর আওতায় অপ্রতিহত গতিতে এসব সমাজবিরােধীদের দমনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানাে হচ্ছে। এ-ব্যাপারে সরকার কঠোর মনােভাবের পক্ষপাতী।

যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি
৫। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির পূণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অমরা নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দখলদার সৈন্যের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতিপুরণ এখনও হয়নি। সম্পদের স্বল্পতার মধ্যে কাজ করতে হলেও উন্নয়ন প্রকল্পগুলাে বাস্তবয়নের জন্য সাধ্যমতাে অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে। স্বধীনতাযুদ্ধে শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছিল। শিল্পে ব্যবহার্য কাঁচামাল ও খাদ্য শস্য আমদানী নিমিত্তে বৈদেশিক মুদ্রার একটি বৃহৎ অংশ ব্যয় করতে হয়। তাছাড়া আমাদের আমদানীর পরিমাণ রফতানীর তুলনায় বেশি হওয়ায় আমাদের পক্ষে সর্বদা বৈদেশিক আয়ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। রফতানীর উপার্জিত মুদ্রার অধিকাংশ আমদানীকৃত দ্রব্যের মূল্য পরিশােধে ব্যস্ত হওয়ায়, আমাদের সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ এক সময়ে নিম্নতম পর্যায়ে নেমে এসেছিল। এই প্রতিকূল অবস্থার মােকাবিলার জন্য আমদানী নীতির উপর কিছু বাধানিষেধ আরােপ এবং আরাে কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বর্তমানে আমাদের গচ্ছিত বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ বেশ আশাপ্রদ। এখন আমরা আমদানীকৃত দ্রব্যের মুল্য পরিশােধের দায়িত্ব ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিশ্রুতিসমুহ রক্ষা করতে সক্ষম হবাে। বিশেষভাবে, আন্তর্জতিক অর্থ তহবিল, বিশ্ব ব্যাংক, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংক ও এশিয়ক্লিয়ারিং ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক গুরুত্বপুর্ণ সংস্থাসমুহের সদস্য পদ লাভ অদূর ভবিষ্যতে আমাদের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের বেশ সহায়ক হবে।
৬। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রনয়নের পর থেকেই বাংলাদেশ এক অর্থনৈতিক সংকট-তথা অর্থনীতির ক্ষেত্রে কতগুলি অপ্রত্যাশিত ঘটনা সুদুরপ্রসারী পরিণতির সম্মুখীন হয়। বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্যের অভাবিত উর্ধ্বগতি, খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং গত বছরের প্রলয়ংকরী বন্যা আমাদের উন্নয়নও অগ্রগতিতে সৃষ্টি করে বিরাট প্রতিবন্ধকতা। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রারম্ভিক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণও বৈদেশিক সম্পদের সল্পতাহেতু এবং অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতির জন্য চলতি বছরের উন্নয়ন কর্মসুচী গতবছরের সমপর্যায়ে রাখা হয়েছে। অর্থনীতির প্রশস্ত করার নিমিত্তে আমরা কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করেছি ঃ
(ক) খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা ও উদ্বৃত্ত খাদ্য সংগ্রহের অভিযান চালানাের সাথে সাথে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানীর ব্যাবস্থা।
(খ) খাদ্য শস্য ও কষি সরঞ্জামের ভর্তকি হাস এবং অন্যান্য উপায়ে অর্থিক বাজেটের ঘাটতি পূরণের ব্যাবস্থা গ্রহণ ও মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের প্রচেষ্টা।
(গ) দ্রুতবর্ধমান আমদানী মূল্য ও দায় পরিশােধ সংকট মােকাবিলার জন্য বর্হিবিশ্ব থেকে অতিরিক্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি লাভ।
(ঘ) কাচামাল ও খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানী বিনিয়ােগ নীতি, পুনবিন্যাস, কলকারখানায় শান্তির পরিবেশ আনয়ন ও অন্যান্য উপায়ে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি।
সর্বত্র কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলেও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় খাদ্য ও শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদন যথেষ্ট বাড়ানাে সম্ভব হয়েছে। শিল্পক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতার জন্য যে অসুবিধা দেখা দিয়েছিল, বর্তমানে আমরা তা কাটিয়ে উঠতে চলেছি। কৃষিক্ষেত্রে উন্নতমানের বীজ ব্যবহার, সেচ ব্যবস্থা চালু ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের মাধ্যমে অধিক ফলনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
৭। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্প প্রসারের গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার যুদ্ধোত্তরকালে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলি নতুন করে সংগঠনের ব্যবস্থা করেন। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পক্ষেত্রে এই সময় উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু গত বৎসরের এক দুর্ভাগ্যজনক বিপর্যয়ে ঘােড়াশাল সার কারখানায় উৎপাদন বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। কারখানাটি মেরামতের কাজ চলছে এবং আশা করা যায় অচিরেই তা পুনরায় চালু হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানাের উদ্দেশ্যে দ্রুত শিল্পোন্নয়নের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বেসরকারী শিল্পখাতে অধিকতর সুযােগ-সুবিধা দেওয়ার জন্য শিল্প বিনিয়ােগ নীতির পুনর্বিন্যাস করা হয়। বিনিয়ােগে ব্যাপকতর সুবিধা প্রদান করে বেসরকারী খাতে পূর্বের বিনিয়ােগের সীমা বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত নির্ধারিত করা হয়। এছাড়া, সরকারী ও বেসরকারী সহযােগিতায় বৈদেশিক বেসরকারী বিনিয়ােগেরও বিশেষ সুযােগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এই বিনিয়ােগ নীতি ঘােষণার পর বেসরকারী শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়ােগের উল্লেখযােগ্য সাড়া পাওয়া গেছে। এখানে উল্লেখ করতে চাই যে সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ সম্পর্কে যথেষ্ট সজাগ রয়েছেন এবং শিল্প মঞ্জুরী কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহের শ্রমিকদের বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি বর্ধিত করা হয়েছে। এ সকল সুযােগ-সুবিধাদানের মূল উদ্দেশ্য হল শিল্পক্ষেত্রে উত্তরােত্তর উৎপাদন বৃদ্ধি। যে কোন অবস্থাতেই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলির উৎপাদন বৃদ্ধির মাত্রা অব্যাহত রাখার জন্য সরকার দৃঢ় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন উদ্দীপনায় শ্রমিকদের এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি।

খাদ্যশস্য
৮। খাদ্যশস্যসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা সমগ্র বিশ্বে সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ বয়ে এনেছে। বাংলাদেশেও নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যের উর্ধ্বগতি জনগণের কষ্টের বােঝা বাড়িয়ে তুলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার অপ্রতুলতা, অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের স্বল্পতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ বৃদ্ধি সম্ভব হয় নাই। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করতে ও জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে সরকার বদ্ধপরিকর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রয়ােজন অনুযায়ী দ্রব্যাদির সুষ্ঠু বিতরণের উদ্দেশ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের বহিষ্কার ও অসাধু তৎপরতা বন্ধের জন্য বিভিন্ন সরকারী সংস্থাসমূহ সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আমদানী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওয়েজ আর্নিংস স্কীম বিশেষ সাফল্য লাভ করে। এছাড়া, বর্তমান বছরের প্রথমার্ধে আমদানী নীতিতে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানীর ব্যবস্থাসহ সুষ্ঠু বাজারজাতকরণ ও বিতরণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। অন্যদিকে, রফতানিকারকগণকে নগদ ভর্তুকিসহ তাদের আয়কর ও আমদানী শুল্কের আংশিক রেহাই দিয়ে রফতানী ব্যবস্থা আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। একক বৃহত্তম বাণিজ্য জোট হিসাবে ইউরােপীয় সাধারণ বাজারে আরও সহজ শর্তে আমাদের কতকগুলি দ্রব্য রফতানীর উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই সাধারণ বাজারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে শুল্ক রহিতকরণ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবং বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক আদান-প্রদান আরও সম্প্রসারণকল্পে একটি দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি সম্পাদনের চূড়ান্ত ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

যােগাযােগ ব্যবস্থা
৯। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থায় প্রায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। অতি অল্প সময়ের মধ্যে রেল ও সড়ক যােগাযােগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সঙ্গে জেলাসমূহের যােগাযােগ ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। যােগাযােগ ব্যবস্থার উল্লেখযােগ্য অগ্রগতির নিদর্শন বহন করেছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের উপর মীরপুর, বংশী ও কালীগঙ্গা সেতু। এই তিনটি সেতু নির্মাণের ফলে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাসমূহের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযােগ সাধিত হয়েছে এবং জনগণের অশেষ কষ্টের অবসান ঘটেছে। ঢাকা-টাঙ্গাইল রােডে…ও বাইমাইল সেতুর নির্মাণ কাজ সমাপ্তপ্রায়। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই সেতুদ্বয় জনসাধারণের যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। কাঁচপুরে শীতলক্ষা নদীর উপর সেতু নির্মাণের কাজ পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের যােগাযােগ ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক প্রয়াস যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা। সরকার ইতিমধ্যে যমুনা সেতুর প্রাথমিক সম্ভাব্যতা রিপাের্ট লাভ করেছেন। সড়ক যােগাযােগের সাথে সাথে বিধ্বস্ত রেল যােগাযােগেরও পুনরুজ্জীবন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত রেলপথের পুনঃনির্মাণ এবং রেলপথের সুযােগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য যাত্রী ও মালবাহী গাড়ী এবং ইঞ্জিন সংগ্রহের প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়ােজন, তার সংস্থানের জন্য সরকার বিশেষভাবে সচেষ্ট রয়েছেন। জাতীয় যােগাযােগ ব্যবস্থার অপর গুরুত্বপূর্ণ দিক হল আকাশপথ ও জলপথ। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করায় বাংলাদেশ বিমানের সাফল্য উল্লেখযােগ্য। বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক বিমান যােগাযােগের ক্রমবর্ধমান প্রয়ােজনীয়তা পূরণের জন্য কুর্মিটোলায় নির্মাণাধীন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর বিশেষ সহায়ক হবে। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনও ইতিমধ্যে কোস্টারসহ ১৪টি সমুদ্রগামী জাহাজ সংগ্রহ করে সমুদ্রপথে ১ লক্ষ ১৯ হাজার ৩ শ ৫৯ টন মাল পরিবহনের ক্ষমতা অর্জন করেছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ-পরিবহন এবং নদীপথসমূহ সুষ্ঠু পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়ােজনীয় সংখ্যক জলযানের ব্যবস্থা করে নদীমাতৃক বাংলাদেশের যােগাযােগের আশু চাহিদা পূরণে কর্তৃপক্ষ সজাগ রয়েছেন। ডাক, তার ও টেলি যােগাযােগের ক্ষেত্রেও পাঁচশালা পরিকল্পনাধীনে যথার্থ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নতি, আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণের সাথে সাথে বহির্বিশ্বের সঙ্গে টেলিযােগাযােগ স্থাপনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্র স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই কেন্দ্র চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক টেলিযােগাযােগ ব্যবস্থার এক বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হবে।
১০। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ শক্তির অপরিসীম অবদানের কথা স্মরণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর সমধিক গুরুত্ব আরােপিত হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বিদ্যুৎ উৎপাদন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ পূর্বের অবস্থায় ফিরে এসেছে। খুলনায় নবনির্মিত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনক্ষম হওয়ায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পোন্নয়নের প্রধান অন্তরায় দূরীভূত হয়েছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য পরিবহন লাইনও যথেষ্ট বাড়ানাে হয়েছে। গভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সংযােজন, চা-বাগানে ও কৃষি প্রকল্পসমূহে বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা, গ্রাম পর্যায়ে বিদ্যুতায়ন ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে গ্রাম বাংলার মানুষের প্রভূত উপকার সাধিত হবে।
১১। তেলও গ্যাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান আমাদের অগ্রগতির জন্য বিশেষ প্রয়ােজন। মাটির অতলে যে সম্পদ সম্ভার লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করে জনগণের সুখ সমৃদ্ধির কাজে লাগাতে হবে। উৎপাদন ভাগাভাগির ভিত্তিতে যে সকল বিদেশী তেল কোম্পানীর সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, তারা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় আমাদের নিজস্ব সংস্থা অনুসন্ধান তথা খনন কার্য অব্যাহত রেখেছে। অন্যান্য খনিজ সম্পদের উন্নয়নে, বিশ্বেষত সিমেন্ট ও চুনাপাথর উৎপাদনে বিগত বছরে অধিকতর সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আমরা আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।
১২। রাষ্ট্রীয় আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আজ আমাদের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থা রূপ নিতে চলেছে। ইতিমধ্যেই শিক্ষা কমিশনের রিপোের্ট পেশ করা হয়েছে এবং সরকার তা পরীক্ষা করে দেখেছেন। শিক্ষার মান উন্নয়ন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় প্রকারান্তরে জাতীয় বিনিয়ােগ এবং তা উৎপাদনশীল। এজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় অর্থের সংকুলান সার্থক হবে। গতবছর বাংলাদেশের সমুদয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনার দায়িত্ব সরকার গ্রহণ করেছেন। এর ফলে প্রাথমিক শিক্ষকগণ সরকারী কর্মচারী হিসেবে গণ্য হবেন। সুষ্ঠু শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করে জনশক্তিকে উদ্বোধিত ও সঞ্জীবিত করতে পারলে দেশে এক নবজাগরণের সূত্রপাত হবে।
১৩। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বকীয়তা সর্বজন বিদিত। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপুষ্টি থেকেই আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রাণশক্তি আহরিত হয়েছিল। বিশ্বসভায় এই সংস্কৃতি তুলে ধরতে এবং অন্যান্য দেশের সাথে সাংস্কৃতিক সহযােগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারণের জন্য এ যাবৎ ৯ টি বন্ধু-রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। জাতীয় সংস্কৃতির সম্যক প্রতিফলনের জন্য সংস্কৃতি ঢাকায় শিল্পকলা একাডেমী স্থাপিত হয়েছে। আমি আশা করি, বাঙালীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জাতীয় সংস্কৃতির উন্নয়ন ও প্রতিফলনে এই একাডেমী উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করবে। সংস্কৃতিক জীবনধারার পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ বিধানে খেলাধুলার প্রয়ােজনীয়তা যথেষ্ট। জাতীয় জীবনে খেলাধুলার সার্বিক উন্নয়নে সরকার সচেতন রয়েছেন। এজন্য শিক্ষায়তনগুলিতে ছাত্রছাত্রীদের ক্রীড়ানুরাগী করে গড়ে তােলার জন্য প্রচেষ্টা, চালানাে হচ্ছে। খেলাধুলার অনুশীলনন প্রতিযােগিতা ও অন্যান্য ব্যাবস্থা করে বাংলাদেশ ও স্পাের্টস কাউন্সিল সুষ্টভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

গ্রামবাংলার উন্নয়ন
১৪। বাংলাদেশের উন্নয়ন গ্রামবাংলার উন্নয়নে উপর বিশেষ ভাবে নির্ভরশীল। গ্রামীণ অর্থনীতির পুনবিন্যাস ও গ্রামীণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের সত্যিকার সমৃদ্ধি। তাই যে কোনাে উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রারম্ভে কৃষিজীবীদের কথাই সর্বাগ্রে মনে আসে। আধুনিক জীবনের সুযােগসুবিধা পল্লীর জনগণের কাছে পৌছে দিতে না পারলে অগ্রগতির মুল লক্ষ্য ব্যার্থই হয়ে যাবে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, দেশের শাসন ব্যবস্থায় আর ও ঘনিষ্ঠভাবে জনগণে অংশগ্রহণের জন্য গণমুখী স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এ ব্যবস্থায় জনগণের সক্রিয় সহযােগিতায় দেশের যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কাজ ত্বরান্বিত হবে। সমন্বিত পল্লীউন্নয়ন কর্মসূচীর অধীনে গ্রামীণ সমাজ-ব্যবস্থার নবরুপায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। এই মহৎ প্রচেষ্টায় গ্রামভিত্তিক সমবায় আন্দোলনের নীতি অনুসৃত হয়েছে। সমবায়ের বাস্তবধর্মী কার্যকারিতার জন্য এবং এই আন্দলােনকে অধিকতর গণমুখী করার উদ্দেশ্যে, এর গঠনপদ্ধতি পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য সম্প্রতি একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি নিয়ােগ করা হয়েছে।
সমবায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন সমাজ-চেতনা লাভ করবে এবং সমাজতন্ত্রের ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে-এই আমার বিশ্বাস।
১৫। জনগণের অভিষ্ঠ সমাজতন্ত্র প্রবর্তনে ভুমিসংস্কারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ও কৃষি জমির স্বলপতাহেতু পরিবার প্রতি জমি সীমা একশত বিঘা নির্দিষ্ট করা হয়। এর ফলে উদ্বৃত্ত জমি ও খাস জমি ভুমিহীন ও প্রায়-ভুমিহীন চাষীদের মধ্যে বন্টনের ব্যবস্থা অনুযায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। সরকারের ভুমি সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য সাধারণ চাষী পরিবারগুলিকে সহায়তা করা, উপকুলী এলাকায় গুচ্ছবদ্ধ পল্লী স্থাপন করে সমবায়ের মাধ্যমে চাষাবাদ প্রবর্তনে উৎসাহিত কার এবং সামগ্রীকভাবে সমাজতান্ত্রিক রুপরেখায় পল্লী-অর্থনীতির সংস্কার সাধন করা।
১৬। আমাদের অর্থনীতি একান্তভাবে কৃষিনির্ভর। কৃষির উন্নতি আমাদের সার্বিক উন্নতির চাবিকাঠি। দেশের মাটি ও জলবায়ু খাদ্য উৎপাদনে খুবই উপযােগ্য হওয়া সত্ত্বেও চাষাবাদের প্রয়ােজনীয় যন্ত্রপাতি ও কৃষি উপকরণের অভাব পরিবহন সংকট ইত্যাদির কারণে উৎপাদন। ক্ষমতাকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করা এখনাে সম্ভব হয়নি। সে জন্য আমরা সংবৎসর খাদ্যঘাটতির বােঝা বয়ে চলছি। উপরন্তু বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিপুল পরিমাণ শস্যহানি হয়েছে। | খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জন করার জন্য প্রথম পরিকল্পনার শেষ নাগাদ ১৫৪ লক্ষ্য টন খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে। গতবছরে কর্মসূচীতে কৃষিখাতে বরাদ্দ ৪৫ কোটি টাকার স্থলে বর্তমান বছরে ১৭কোটি টাকা করা হয়েছে এবং উন্নত বীজ, সেচ ব্যাবস্থা, সার, কীটনাশক ঔষধ, যন্ত্রপাতি এবং যথাসময়ে কৃষিঋণ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করে ১৩১ লক্ষ টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের কর্ম সূচী প্রণয়ন করা হয়েছে। শীতকালীন উচ্চ ফলনশীল বােরাে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গত বছরের ব্যাহত ৩৫ হাজার যন্ত্রচালিত পাম্পের সংখ্যা বৃদ্ধিকরে এ বছরে ৪০ হাজার পাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে ২৬ লক্ষ্য একর জমিত চাষ সম্ভব হবে এবং প্রায় ৩০ লক্ষ টন বােরাে ধান উৎপাদিত হবে। আশা করা যায় এতে আমাদের খাদ্য ঘাটতি অনেকটা কমবে।
সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত করা ও কৃষি উন্নয়নে কৃষকদের উদ্বৃদ্ধ করার মানসে সরকার সর্বাপেক্ষা সফল, নিষ্ঠাবান ও উৎসাহী কৃষকদের জন্য বঙ্গবন্ধু পুরস্কার’ নামে জাতীয় পর্যায়ে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ঘােষণা করেছেন।
১৭। পাট আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ড। দেশের অর্জিত মােট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পাট থেকে। বর্তমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কম পক্ষে ৭০ লক্ষ বেল পাট উৎপাদন করা দরকার। এজন্য পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে চাষী ভাইদের আগ্রহী করে তােলা সরকারের বিশেষ লক্ষ্য। অন্য দিকে বিশ্বের পাট ও কৃত্রিম আঁশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযােগিতায় পাটের রফতানী নিশ্চিত করার জন্য সরকার ন্যায়সঙ্গত রফতানিমূল্য নির্ধারন করার পক্ষপাতি। বিশ্বব্যপী মুদ্রাস্ফীতি, কৃত্রিম তন্তুর উৎকর্ষ ও অন্যান্য কারণে বিশ্বের কয়েকটি প্রধান বাজারে আমাদের গতানুগতিক পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা সাময়িকভাবে হ্রাস পেয়েছে। তবে আনন্দের বিষয় যে, একদিকে গতানুগতিক বাজার সংকুচিত হলেও অন্যদিকে আমরা সাফল্যের সাথে অগ্রসর হচ্ছি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলােতে অদূর ভবিষ্যতে আমরা ক্রমবর্ধমান হারে পাট রফতানির আশা রাখি। নানাবিধ প্রতিকূলতা স্বত্ত্বেও পাটের ভবিষ্যৎ উজ্জল রাখতে সরকারের সর্বাত্বক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

বন্যা সমস্যা
১৮। পানি নদীমাতৃক বাংলাদেশের সম্পদ এবং সমস্যা দুই-ই। আমাদের কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি পানি সম্পদের উন্নয়ন ও পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানাের উপর নির্ভরশীল। প্রতি বছর প্রায় এককোটি একর জমি জলমগ্নন হওয়ায় আমাদের দেশে শস্য, সম্পদ ও প্রাণের প্রচুর ক্ষতি হয়। অন্য দিকে বর্ষার কয়েক মাস ছাড়া কৃষিকার্যকে মাটির অবশিষ্ট আর্দ্রতা ও সেচ ব্যাবস্থার উপর নির্ভরশীল হতে হয়। গ্রীষ্মকালে পানির অতি প্রাচুর্য এবং শীতকালে পানির স্বল্পতা আমাদের প্রধান সমস্যা। প্রতি বৎসর বন্যার তাণ্ডবলীলা আজ আমাদের জাতীয় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে।
গত বছর বন্যায় চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। বিগত এপ্রিল-মে মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপর্যপুরি ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাজনিত সমস্যাবলী যখন আমরা সাহসের সঙ্গে মােকাবিলা করছিলাম ঠিক তখনি দেশ এক ভয়াবহ বন্যায় পতিত হয়। যার ফলে ২২ হাজার ৪২ বর্গমাইল এলাকা ৪ মাস যাবৎ পানিতে নিমজ্জিত থাকে। ৪০ লক্ষ ১০ হাজার একর জমির আনুমানিক উৎপাদন ১০ লক্ষ ৮১ হাজার টন চাল এবং ০.৫১ লক্ষ টন পাট সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়। এ ছাড়া প্রাণ ও অন্যান্য সম্পদের যে অবর্ণনীয় ক্ষতি সাধিত হয়, স্মরণার্থীতকালে তার কোনাে নজির নাই। আমাদের সীমিত সম্পদের মধ্যে বন্যাজনিত সার্বিকক্ষতিপুরণের জন্য সরকার সাধ্যমত প্রচেষ্টা চালান। তবু দেশের দুর্ভিক্ষাবস্থাকে রােধ করা সম্ভব হয়নি। অনাহার-অর্ধাহারক্লিষ্ট মানুষের জন্য ৫ হাজার ৮শ ৬২টি লঙরখানা স্থাপন করে ৪২ লক্ষ ৪৫ হাজার ২৭৭ জন মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা হয়। রােগ, মহামারী ইত্যাদি থেকে অব্যহতি পাওয়ার জন্য ও যথাযােগ্য তৎপরতা চালানাে হয়। বন্যাকবলিত এলাকায় বিমান যােগে খাদ্য প্রেরণ, দুঃস্থ মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রী বন্টন এবং জনগণকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরিতকরণের জন্য সংসদ সদস্য, সশস্ত্র বাহিনী, সরকারীবেসরকারী কর্মচারী, রাজনৈতিক সমাজকর্মী এবং সেচ্ছাসেবীবৃন্দ একযােগে ত্রাণকার্যে আত্মনিয়ােগ করেন। বহু বিদেশী রাষ্ট্র ও বৈদেশিক স্বেচ্ছাসেবী কল্যাণ সংস্থা আমাদের আপৎকালীন আহ্বানে সাড়া দেয়। তারা কেবল ত্রাণসামগ্রীই প্রদান করেননি, বরং দুঃস্থ এলাকায় রিলিফের কাজে এগিয়ে আসেন।
সর্বনাশা বন্যার কবল থেকে উদ্ধার লাভের জন্য পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বাস্তবভিত্তিক কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। প্রথম পরিকল্পনা শেষে বাংলাদেশে মােট ৫১ লক্ষ ৪১ হাজার একর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ১২ লক্ষ ৫৭ হাজার একর এলাকায় সেচ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। এর জন্য যে প্রচুর পরিমাণ সম্পদ ও বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়ােজন, সরকার তা মেটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। আমি আশা করি এ বিষয়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পসমুহ বাস্তবায়িত করে পর্যায়ক্রমে বন্যানিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।
১৯। বিশ্বের সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের বাংলাদেশ আজ প্রায় জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সম্মুখীন। দারিদ্র, নিরক্ষরতা, খাদ্য সংকট ও স্বাস্থ্যহীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তির সকল প্রচেষ্টাকে নিষ্ফল করে দিতে পারে জনসংখ্যার এই ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতি। প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ শিশু আগমন ও ১০ লক্ষ বেকার লােকের সমাগম হচ্ছে। এই বিপুল জনবৃদ্ধি রােধ করতে না পারলে অচিরেই আমাদের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়াবে। এতে দেশের অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার উপর যে প্রবল চাপের সৃষ্টি হবে, তা মােকাবিলা করা কারাে পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠবে না। ভূমি অনুপাতে বাংলাদেশের জনবহলতা আজ বিপদসীমায় এসে পৌচেছে। দেশের সার্বিক অগ্রগতি এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হল জনসংখ্যা বৃদ্ধির উর্ধ্বগতিকে প্রতিরােধ করা ও নিয়ন্ত্রণে আনা। তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যবশ্যক হয়ে উঠেছে। সেই জন্য সরকার বিশ্বব্যাংক, কতিপয় বন্ধুরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহয্যে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, যার ফলে প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার শেষে জন্ম হার ৩% থেকে কমে ২.৮% এস দাড়াবে।

জনসংখ্যা
২০। আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ৩.। কিন্তু বার্ষিক খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন পর্যন্ত তার চেয়ে কম। কাজেই খাদ্য ঘাটতি পূরণ হওয়া দুরে থাক, বরং এ যাবৎ তা বেড়েই চলেছে। এই অবস্থা জাতীয় অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য কঠিন সমস্যা হয়ে দড়িয়েছে। বিশ্বে বর্তমান মূল্য বৃদ্ধি ও সাধারণ খাদ্য ঘাটতি আমাদের জন্য আরও মারাত্মক হয়ে উঠেছে। বছরে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানী করতে হলে বর্তমান মূল্যে প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার দরকার। নিজস্ব অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা থেকে খাদ্যশস্য ক্রয়ে এত টাকা খরচ হলে আমাদের পক্ষে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য আমদানী করা প্রায় অসম্ভব। দেশে খাদ্য ঘাটতির এই অসাভাবিক অবস্থা আমাদের সামগ্রীক উন্নয়ন পরিকল্পনার পরিপন্থি। আজ তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের গুরুত্ব সর্বাধিক। খাদ্য ঘাটতির শােচনীয় পরিণতি থেকে অব্যাহতি লাভের জন্য প্রাণপণ পরিশ্রম করে ফসল ফলানাে একান্ত আবশ্যক। এব্যাপারে ক্ষেতে খামারে উৎপাদন বৃদ্ধির অন্য কোন বিকল্প নাই। খাদ্য উৎপাদনের সাথে সাথে খাদ্য সংগ্রহ এবং সুষম বন্টন ব্যবস্থা একান্ত অপরিহার্য। বর্তমান খাদ্য ঘাটতির সমাধানকল্পে এবং জরুরী অবস্থা মােকাবিলার জন্য প্রয়ােজনীয় মজুত রাখতে সরকার বাধ্যতা মূলক খাদ্যসংগ্রহ অভিযান শুরু করেছেন। আশা করা যায় সরকারের অনুসৃত খাদ্যনীতিতে ভবিষতে খাদ্য ঘাটতির মােকাবিলা করা সম্ভব হবে।
২১। জাতীয় জীবনে সুখদুঃখর সমৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলাে স্বাস্থ্য। বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার সমস্যা অনেক। জনস্বাস্থের উন্নতির পরিপন্থী তিনটি মৌলিক সমস্যা হচ্ছে-জনবহুলতা, পুষ্টিহীনতা ও সংক্রামক ব্যাধি। সরকার এই তিনটি সমস্যাই যুগপৎ সমাধানের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুরুচিসম্পাদন জীবন ধারা গড়ে তুলতে সুস্থ দেহ ও সুন্দর মানসিকতার প্রয়ােজন। উন্নত জীবন বােধের বিকাশ সাধনের ও সৃজনশীল প্রচেষ্টা চালানাের জন্য দরকার সুখী ও স্বাস্থ্যবান জনসমষ্টি। এদিকে লক্ষ্য রেখে দেশের স্বাস্থ্য কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানাে হয়েছে। কেবল শহরেই নয়, স্বাস্থ্য রক্ষার আধুনিক সুযােগ-সুবিধা গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে পৌছে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে।।
২২। আমরা শান্তিতে থাকতে চাই এবং অন্যান্য সকলে শান্তিতে থাকুক, এটা আমাদের কাম্য। তা হলেও যে কোনাে স্বাধীন জাতির অভ্যন্তরিণ শৃংখলা ও তার সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে একটি সশস্ত্র বাহিনী আপরিহার্য। দেশরক্ষার অপরিসীম দায়িত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণ গড়ে তুলতে সরকার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন। একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোেলা ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ। আমাদের সশস্ত্র বাহিনী বিডিআর সরকারী কর্মচারীবৃন্দ, রাজনৈতিক ও সমাজকর্মী এবং জনগণের সাহায্য ও সহযােগিতায় চোরাচালানীরােধ অভিযানে ও ১৯৭৪ সালে বন্যা অধ্যুষিত অঞ্চলে দুর্গত মানুষের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ করার কাজে যে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে, তা প্রশংসনীয় কৃতিত্বের পরিচায়ক।
২৩। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সাফল্যের চাবিকঠি এর অনুস্ৰত আদর্শ। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শান্তি, বন্ধুত্ব ও সমঝােতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এবং জোটনিরপেক্ষতার নীতি অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তি বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাসমুহের সদস্যপদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের ফলশ্রুতি। ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় সকল রাষ্ট্র বাংলাদেশকে অনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিদান করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন ও সৌদি আরবের সরকার এবং নেত্রিবৃন্দের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে আমাদের যােগাযােগ ও মতামত বিনিময় ঘটেছে। গতবছর প্রলয়ংকরী বন্যার পর অন্যান্য বন্ধুদেশের মত এ দুটো দেশ ও বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আমরা আশা করছি যে, অচিরেই এ দুটো দেশের সাথে আমাদের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। বন্যায় ক্ষতিসাধন এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির চাপে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাহায্যদান এবং অব্যাহতভাবে সহানুভুতি প্রদর্শনের জন্য আমরা বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্রসমুহ, সংস্থা এবং জাতিসংঘ ও তার মহাসচিবের কাছে কৃতজ্ঞ।
২৪। বিগত বছরে অনেক বন্ধু রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিবিড়তর হয়েছে এবং অনেক নতুন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সুপ্রষ্টিত হয়েছে। নিকটতম প্রতিবেশী দেশ সমুহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মুল লক্ষ্য। ভারতের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি। ভি ভি গিরির বাংলাদেশে শুভাগমন এবং বঙ্গবন্ধুর ভারত সফর দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান মৈত্রী সম্পর্ক ও সহযােগিতা, আরও দৃঢ়তর করেছে। উভয় দেশের অর্থনৈতিক সহযােগিতা ও সীমান্ত চিহ্ন উপকরণ চুক্তি এ বিষয়ে একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং দূর প্রাচ্যের দেশ সমুহের সাথে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ব্রহ্মদেশের প্রেসিডেন্ট, মালয়েশিয়ার রাজা ও রানির এবং ভুটানের রাজার বাংলাদেশ সফর এ সকল প্রতিবেশী দেশসমুহের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরাে জোরদার করেছে। বঙ্গবন্ধুর সােভিয়েট ইউনিয়ন সফর, সে দেশের নেতৃবৃন্দের সাথে সার্থক আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্ব ও সহযেগিতা বৃদ্ধি করেছে। পশ্চিম ইউরােপের দেশসমুহের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ও সহযােগিতার ক্ষেত্র আরাে সম্প্রসারিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মি: জেরাল্ড ফোর্ডের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাঙ্কার এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: হেনরী কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফর দুদেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সমঝােতা বৃদ্ধি করেছে। নিউজিল্যান্ডের ভুতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মি: নর্মান কাকোর বাংলাদেশ সফরের ফলে দুদেশের সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়েছে। পূর্ব ইউরােপের সাথে সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রসারণ ও আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও সংহত হয়েছে। যুগােস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মি: যােসেফ ব্রজ টিটোর বাংলাদেশ শুভাগমন ও তার সাথে আমাদের মত বিনিময় উভয়দেশের নিবিড় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে। জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর সে দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সংহত করতে যথার্থ অবদার রয়েছে। আরব জাহানের সঙ্গে আমরা ঐতিহ্যিক বন্ধনে আবদ্ধ। ঐ অঞ্চলের দেশসমুহে এবং আমাদের দেশের অনেক সমস্যা ও আশাআকাংখা একই রূপ। আমাদের সাথে নিবিড় ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়নের ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব অর্জিত হয়েছে। আফ্রিকার দেশসমুহের সাথেও আমাদের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। সেনেগালের মহামান্য লিওপােল্ড সেনঘর এর বাংলাদেশে শুভাগমন ঐ দেশের সাথে আমাদের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায়ের সুচনা করেছে।
২৫। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমুহের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের উল্লেখযােগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। একথা আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। আলজিরিয়া ও মিশরের রাষ্ট্রপ্রধানদের বাংলাদেশে শুভাগমন এবং বঙ্গবন্ধুর ইরাক, মিশর, কুয়েত ও সংযুক্ত আরবআমীরাত সফর ও সকল দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন এবং রাজনৈতিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য বিষয়ে সহযােগিতার ক্ষেত্র প্রসারে সহায়তা হয়েছে। গত জুন মাসে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইরান সফরকালে মহামান্য শাহ-এর সাথে বাংলাদেশ ও ইরানের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে সম্ভাব্য ব্যাবস্থা সম্পর্কে আলােচনা হয়েছে।
২৬। গত বছর আমাদের কয়েকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যােগদান করেছে। তার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ সংসদের ২৯ তম অধিবেশন ও দ্বিতীয় ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। জাতিসংঘের সাধারণ সংসদের ভাষণে বঙ্গবন্ধু উন্নয়নকামী দেশসমুহের সমস্যাবলী এবং বিশ্বের বর্তমান বৈশম্যমুলক ব্যাবস্থার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লাহােরে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনে অন্যান্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সাথে, ইসরাইল কর্তৃক অন্যায় ভাবে অধিকৃত আরব ভূখন্ড প্রত্যার্পণ ও ফিলিস্তিনী ভাইদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং আরবদের অন্যান্য দাবী তিনি দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। বিভিন্ন সম্মেলনে বাংলাদেশ এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিকতা, বর্ণবৈষম্য ও শােষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত স্বাধীনতাকামী জাতিসমুহের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে এবং একাত্ম ঘােষণা করেছে।
২৭। গত বছর ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান পরস্পরের স্বীকৃতিদানের পর বঙ্গবন্ধু লাহােরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে যােগদান করেন। এর অব্যবহিত পরে, আমাদের শান্তি ও সমঝােতার নীতির সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লীতে ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে মিলিত হন এবং সেখানে আমরা মানবতাবিরােধী জঘন্য অপরাধে অভিযুক্ত ১৯৫ জন পাকিস্তানী যুদ্ধ বন্দীর প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করতে সম্মত হই। উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনে এটা আমাদের একটা বিরাট অবদান। স্বাভাবিকভাবেই আশা করা হয়েছিল যে পাকিস্তান এই মহানুভবতায় সাড়া দিয়ে দিল্লি চুক্তির প্রতিশ্রুতি মােতাবেক ন্যায়নীতির ভিত্তিতে ভূতপূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ বন্টন ও ৬৩ হাজার পাকিস্তানী পরিবারের পাকিস্তানে ফেরত সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান করবে। কিন্তু জুন মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে আমাদের এ আশা পূর্ণ হয়নি।
এই উপমহাদেশে দারিদ্র, ক্ষুধা, বেকারত্ব এবং রােগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম তথা এখানকার জনগণের সার্বিক উন্নতির জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলাের মধ্যে শান্তি ও সমঝােতা অপরিহার্য বলে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সকল সমস্যার সমাধান করতে চাই।

কঠিন পরীক্ষা
২৮। জাতীর অভিযাত্রায় আজ আমরা এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন কতিপয় লােকের জনস্বার্থবিরােধী কার্যকলাপের জন্য কঠোর আত্মত্যাগ ও অমূল্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। জাতির শত্রুদের প্রতি কঠোর আঘাত হেনে সাধারণ মানুষের সুখস্বপ্নকে সফল করে তুলতে হবে। জনসাধারণের শ্ৰীতিবুদ্ধির জন্য প্রয়ােজন দেশের সম্পদ বৃদ্ধি করা, বর্তমান সম্পদসমুহ রক্ষা করা ও নতুন সম্পদ সৃষ্টি করা। ত্যাগ, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের ভিতর দিয়েই সম্পদ সৃষ্টি সম্ভব হতে পারে। এ জন্য ক্ষেতে-খামারে, কলে-কারখানায়, অফিসে-আদালতে সর্বত্র আজ পূর্ণ উদ্যমে কাজ করা দরকার।
জাতির সম্মুখে আজ যে সমস্যা, তা নিতান্ত সামরিক, এ বিশ্বাস আমার আছে। জীবনযুদ্ধে মােকাবেলায় ও সংকট উত্তরণে আত্মশক্তির উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন এবং শপথদৃপ্ত উৎকর্ষ, আত্মবিশ্লেষণ, আত্মশুদ্ধি ও কৃচ্ছসাধন। দেশাত্মবােধে বৃদ্ধি হবে দেশের মানুষকে ভালবেসে আমরা যেন আমাদের বংশধরদের জন্য এক সুদ্ধ-সমৃদ্ধিপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ে যেতে পারি।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের উপর এক মহান দায়িত্ব ন্যাস্ত। পরবর্তীকালের ইতিহাসে যেন প্রমাণিত না হয় যে, আমরা সকলে সে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি। বিশ্বের দরবারে আত্মনির্ভরশীল এবং আত্মমর্যদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য প্রতিটি নাগরিককে শৃংখলার সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজে আত্মনিয়ােগ করতে হবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযােগ্য নেতৃত্বে ও নির্দেশ একদিন জাতীয় স্বাধীনতার আশীর্বাদ বহন করে এনেছি; আজ সে স্বাধীনতার আস্বাদ লাভের জন্য দেশের প্রতিটি নাগরিক তারই প্রদর্শিত পথে দেশ গঠনের নতুন সংগ্রামে এগিয়ে যাবেন জাতির জনক যে সুফলা-সুফলা, শস্যশ্যামলা, আনন্দময় বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, তার বাস্তবায়নই আমাদের একান্ত লক্ষ্য। মাননীয় সংসদ সদস্য দেশের মঙ্গলার্থে আপনাদের সকল প্রচেষ্টায় আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা রইল। ইনশাল্লাহ আপনারা সাফল্য লাভ করবেন।
জয় বাংলা

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২১ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!