You dont have javascript enabled! Please enable it!

দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি অরিহার্য: বঙ্গবন্ধু
বিশ্বে উত্তেজনা প্রশমনে একযােগে কাজ করবাে: হুইটলাম

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া-বিশ্বের সর্বাপেক্ষা স্বল্পোন্নত এই এলাকার প্রগতি ও সম্মুদ্ধি সুনিশ্চিত করার জন্যে শান্তি স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
গতরাতে বঙ্গভবনে সফররত অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী মি: এডওয়ার্ড গফ হুইটলামের সম্মানে তার দেওয়া এক নৈশভােজ অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে বঙ্গবন্ধু এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর এই গুরুত্ব আরােপ করেন।
দৃঢ় আস্থার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী মি: এড ওয়াড গফ হুইটলামের এই সফর আমাদের এ দুটি দেশের মধ্যেকার সম্পর্ককে কেবল সুসংহত ও সুদৃঢ় করবে না,বরং বৃহত্তর আঞ্চলিক সহযােগিতা, শান্তি ও সৌহার্দ স্থাপনের কাজে অবদান রাখবে।
নৈশভােজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের উত্তরে অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী মি: এডওয়ার্ড গফ বলেনআন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমন এবং সমকালীন ভীতির অবসানের জন্যে অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ একযােগে কাজ করে যেতে পারে। তিনি বলেন, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশ উভয় দেশই একই সমুদ্রসীমান্তের অধিবাস। এ দুটি দেশ একই ভারত মহাসাগরের দুই প্রান্তে অবস্থান করছে। দুটি দেশই জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথ এর সদস্য এবং উভয় দেশের পররাষ্ট্রনীতি মতাদর্শ নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতির অনুসারী। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা মনে করি যে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সকল জাতি ও জনগণের পারস্পারিক নির্ভরশীলতা একই সঙ্গে বিকাশ লাভ করতে পারে।
প্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্যে স্থায়ী শান্তির অপরিহার্যতা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন-বাংলাদেশ এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি সুনিশ্চিত করার জন্যে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এই অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনের জন্যে বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, দেশের বিরূপ মনােভাব এবং যুদ্ধাপরাধের স্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও শন্তি ও মৈত্রীর স্বার্থে বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়। পাকিস্তান বাংলাদেশের এই ঔদার্যের এখনও অনুরুপভাবে সাড়া দেয়নি। তিনি বলেন, কতিপয় অমীমাংসিত বিরােধ সম্পর্কে স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ। করেন যে এই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণের ব্যাপারে শান্তি ও মৈত্রীর যথাযােগ্য গুরুত্ব পাকিস্তান স্বীকার করবে এবং গঠনমূলক মনােভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন-কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়া বহু অভিন্ন ঐতিহ্যের অধিকারী। অস্ট্রেলিয়ার মতােই বাংলাদেশও শান্তিপ্রিয় জাতি। স্বাভাবিকভাবেই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও ভারত মহাসাগরীয় এলাকাকে শান্তির এলাকায় পরিণত করার পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছে। বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করে বলেন-এই অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীর জন্যেই শান্তি ও স্থিতিশীলতার একই লক্ষ্য অর্জনে এক যােগে কাজ করে যাবার একটি দৃঢ়ভিত্তি আমরা খুজে পাবাে।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশের মহাসংকট ও সমস্যার উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে এক কঠিন সময়ের মাঝে গিয়ে এগুচ্ছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংস ও যুদ্ধের জন্যে উব্বাস্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের পুনর্বাসনের ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই ১৯৭২ সালের সর্বগ্রাসী খরা, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি,আমদানী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং গত বছরের প্রলয়ংকরী বন্যা বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আঘাত হানে। ফলে এদেশের পূনগঠন ও উন্নয়ন প্রচেষ্টা মন্থর হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জনগণ এজেন্যে অসীম দুখ-কষ্টের মধ্যে পড়লেও ধৈৰ্য্য ও সাহসের সঙ্গে তার মােকাবিলা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, কঠোর পরিশ্রম, আত্মােৎসর্গ ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আমরা সকল সমস্যা ও সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবাে।
বিগত বছর গুলিতে অস্ট্রেলিয়ার মূল্যবান সাহায্যের জন্যে বঙ্গবন্ধু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু আশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় রযেছে যে আগামীদিনগুলিতেও আমাদের কল্যাণের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার বন্ধুসুলভ আগ্রহ অব্যাহত থাকবে।

হুইটলামের ভাষণ
অস্ট্রেলিয়ার মহান জননায়ক ও প্রধানমন্ত্রী মি: এডওয়ার্ড গফ হুইটলাম বলেন, অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের বড়াে বন্ধু আর নেই। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি অস্ট্রেলিয়া ও তার জনগণের অনুরাগ প্রগাঢ় এবং এ অনুরাগ উত্তরােত্তর প্রগাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর হচ্ছে।
মি: হুইটলাম বলেন, ইউরােপ সফরকালে আমি এ কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছি যে পাশ্চাত্যের ধনী দেশগুলিকে উন্নয়নশীল দেশসমুহের চাহিদা ও সমস্যাদি উপলব্ধি করতে হবে।
তিনি বলেন, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলির যে সমস্যা তা কোনাে একটি একক দেশ বা কয়েকটি দেশের সমস্যা নয়। সে সমস্যা মানবতার সমস্যা; আর সে সমস্যার সমাধান হতে পারে আন্তর্জাতিক সহযােগিতার মাধ্যমে, সমাধান হতে পারে আমাদের এই গ্রহের সম্পদ পরিবন্টনের যৌথ সংকল্প ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে।
মি: হুইটলাম বলেন, বাংলাদেশ যাতে তার বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে পারে অস্ট্রেলিয়া তার জন্যে যথাসম্ভব সহযােগিতা দানে চেষ্টা করবে। তিনি বলেন: আমরা পরিচেষ্টা করে যাবাে। আমরা চেষ্টাকরে যাবাে কেবলমাত্র বাংলাদেশের জরুরী প্রয়ােজন মেটানাের জন্যেই নয়, আমরা সম্ভাব্য সহযােগিতা দিয়ে যাবাে বাংলাদেশ যাতে তার নিজস্ব সম্পদের উন্নয়ন করতে পারে।
অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত মহাসাগরীয় এলাকার দেশগুলিতে শান্তি উন্নত হতে পারে যদি ওই সমগ্র এলাকাকে বৃহৎ শক্তির ক্ষমতা দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত রাখা হয়। তিনি বলেন, ভারত মহাসাগর বৃহৎ শক্তিবর্গের ক্ষমতা দ্বন্দ্ব ও শক্তি পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে উঠুক অস্ট্রেলিয়া তার ঘােরতর বিরােধী। ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকায় পরিণত করার জন্যে শ্রীলংকার প্রস্তাব অস্ট্রেলিয়া সমর্থন করেছে। এ প্রস্তাবের পক্ষে অন্যান্য শক্তির সমর্থনের আহ্বান জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। অস্ট্রেলিয়া মনে করে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযােগিতায় বাড়াবাড়ি ও মারাত্মক বিপদ এড়ানাের জন্যে বৃহৎ শক্তিবর্গে সংহত হওয়া উচিত।

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২০ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!