সামরিক একাডেমীর প্রথম শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু
আজ কুমিল্লা সেনানিবাসে বাংলাদেশ সামরিক একাডেমীর ক্যাডেটদের প্রথম দলের শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে ভাষন দানকালে বঙ্গবন্ধু এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন: মনে রাখবেন, আপনারা আমার জনগণের বাহিনী, দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর পেশাদার সৈনিক আপনারা নন। তিনি বলেন, জনগণের প্রতি গভীর ভালােবাসা নিয়ে, শ্রদ্ধা নিয়ে সমগ্র জাতির সেবায় আপনাদের আত্মনিয়ােগ করতে হবে। পূর্ণ শৃংখলার সঙ্গে পালন করে যেতে হবে জাতীয় দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু বলেন, জনজীবনে অপরিসীম দুর্ভোগ ও বিপর্যয় সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত মুনাফাখাের, মজুতদার, চোরাচালানকারী, দুর্নীতি পরায়ণ ব্যক্তি এবং দুষ্কৃতিকারী ও সমাজবিরােধীদের ওপর চরমতর আঘাত হানতে তার সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেন, মুষ্টিমেয় সমাজবিরােধী ও দুষ্কৃতিকারীদের দেশের মেহনতি জনগণকে শােষণ করতে দেওয়া যেতে পারে না। দেশের লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয় দুষ্কৃতিকারী ও সমাজবিরােধী ব্যক্তিদেরকে স্বাধীনতার সুফল ভােগ করতে দেওয়া হবে না। সরকার তাদের নির্মূল করতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। যেসব সমাজবিরােধী ব্যক্তিরা লক্ষ লক্ষ দুর্গত মানুষের জীবনে অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে তুলেছে আত্মশুদ্ধির জন্যে বহুবার বহু ভাবে তাদের আহ্বান জানানাে হয়েছে, কিন্তু তারা তা শােনেনি। সুতরাং আর নয়, এবার তাদের সমূলে বিনাশ করা হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। আজ সারা পৃথিবীতে এমন কোনাে শক্তি নেই এদেশ থেকে সম্পদ নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এদেশের সকল সম্পদের সার্বভৌম অধিকারী আমাদের জনগণ। একমাত্র জনগণই পারে দেশের সম্পদ ভাগ করতে, অন্য কেউ নয়। তিনি বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের অপরিসীম ত্যাগতিতিক্ষা, রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ এখনও তাদের চরিত্র বদলায়নি। তাদের বহুবার বহু আবেদন-নিবেদন করা হয়েছে। কিন্তু আর নয়, এবারে তাদের নির্মূল করার জন্যে সরকার দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। দুর্নীতিবাজ, মুনাফাখখার, চোরাকারবারী, কালােবাজারী, মজুতদার, গুপ্ত হত্যায় লিপ্ত দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করা হবে। নির্মূল করা হবে যারা বিদেশী শক্তির দ্বারা পরিচালিত হয়ে আমাদের বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ক্ষুন্ন করার ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন, জনগণের সকল দুঃখ-কষ্ট আর অভাব অভিযােগ সম্পর্কে তিনি পূর্ণ সচেতন। তিনি বলেন, দেশের দেশের যেসব মানুষ আজ ভাত-কাপড়ের অভাবে কষ্ট পাচ্ছেন তাদের দুঃখ-কষ্ট সম্পর্কে তিনি পূর্ণ সচেতন। তিনি বলেন, দেশের দুখী মানুষের জন্যে আমি বহু কষ্টে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে আনছি, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সামগ্রী নিয়ে আসছি আর এইসব সমাজবিরােধীরা তা লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আর নয়। লুণ্ঠন আর বরদাস্ত করা হবে না। গভীর আশা প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশ একদিন সত্যিকারের সােনার বাংলা রূপে গড়ে উঠবেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের কাছে বিপুল সম্পদ আর জনশক্তি। আমরা যদি আমাদের এই বিপুল সম্পদ আর জনশক্তিকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করতে পারি, প্রকৃত কাজে লাগাতে পারি বাংলাদেশ তাহলে নিশ্চয়ই তার আকাংক্ষিত লক্ষ্যে পৌছাতে পারবে। তিনি বলেন আমাদের জাতীয় সম্পদ আর জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন আমরা যদি দেশের লক্ষ লক্ষ দুঃখী মানুষের মুখে মেহনতি জনগণের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি তাহলে এ স্বাধীনতা উপকথায় পরিণত হবে। উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশ গড়ার কাজে পূর্ণ আত্মনিয়ােগের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেন যে উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনাে বিশৃংখলা সহ্য করা হবে না। উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া, কঠোর পরিশ্রম ছাড়া, কোনাে দেশই স্বনির্ভর হতে পারে না। বাংলাদেশ সামরিক একাডেমীতে ক্যাডেটদের প্রথম দলের সাফল্যজনক শিক্ষা সমাপনের উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন: ইনশাআল্লাহ-আমি আশা করি কেবল দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতেই নয়, বাংলাদেশ সামরিক একাডেমী একদিন সারা বিশ্বের প্রশংসা অর্জন করেন। প্রত্যয় দৃঢ়কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন পূর্ণ সুযােগ সুবিধে দেওয়া হলে আমাদের ছেলেরা পৃথিবীর যে কোনাে শক্তির মােকাবিলা করতে পারেন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানীরা আমাদের জনগণকে একদা ভীরু বলে অপবাদ দিতাে। এবং বলতাে বাঙালীদের সৈনিক হওয়ার মতাে মনােবল ও যােগ্যতা নেই, সেই পাকিস্তানীদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে আমাদের জনগণ উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেন সেনাবাহিনীকে জনগণের প্রতি গভীর ভালােবাসায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে একাত্ম হতে হবে। সেনাবাহিনী ও সরকারী কর্মচারী উভয়ই জনগণের অর্থে প্রতিপালিত। সুতরাং জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব আছে, কর্তব্য আছে। তিনি বলেন দেশ জনগণের কথা সব সময় মনে রাখলেই তারা জনগণের প্রতি অধিকতর দায়িত্বশীল মনােভাবে উদ্বুদ্ধ হতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, অন্যান্য বাহিনীর সহযােগিতায় বাংলাদেশ। সেনাবাহিনী শতকরা ৯৫ ভাগ চোরাচালান বন্ধ করেছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গত ২৫ বছরে যা পারেনি বাংলাদেশ সাফল্যজনকভাবে তা পেরেছে। সেনাবাহিনীর এ সাফল্য কম উল্লেখযােগ্য নয়। বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেন সাফল্যের সঙ্গে শিক্ষা সমাপন করে আপনারা একটি পর্যায় অতিক্রম করেছেন, পরবর্তী পর্যায়ে আপনাদের দায়িত্ব রয়েছে বিরাট। সেনাবাহিনী অফিসার হিসেবে আপনাদের জাতীয় দায়িত্ব বহু গুণ বেড়ে গেছে। শৃঙ্খলা আত্মত্যাগ জনগণের আশা আকাক্ষার সঙ্গে পূর্ণ একাত্মতা নিয়ে সে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
সূত্র: দৈনিক বাংলা, ১২ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত