You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১৩ই এপ্রিল, শনিবার, ৩০শে চৈত্র, ১৩৮০

নৈরাজ্যের অবসান চাই

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ আজ আর নেই। বিনষ্ট হয়ে গেছে। দেশের এই সর্ববৃহৎ শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা রক্ষা করতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেমন ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনি ভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও। সরকার ব্যর্থ হয়েছেন এই পবিত্র পরিবেশ অক্ষুন্ন রাখার কাজে সহযোগিতার ক্ষেত্রে। ফলে সাধারণ ছাত্র সমাজ হতাশাগ্রস্থ এবং দিশেহারা। শিক্ষার এই পবিত্র পাদপীঠ এখন এক বিরাট নৈরাজ্যের আস্তানা। কুলষিত। এটা যে আমাদের জাতীয় জীবনে কতখানি অধঃপতন, কতখানি অবমাননাকর তা যে কেউ অতি সহজেই বুঝতে পারেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে সম্প্রতিকালে সংঘটিত দুর্ঘটনা বলি সম্পর্কে মন্তব্য প্রকাশ করেছেন, উপরোক্ত বক্তব্যের ক্ষেত্রে তা প্রণিধানযোগ্য। গত বৃহস্পতিবার শিক্ষক সমিতির এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, ‘সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তীকালে কলাভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়েছে। এই বেদনাদায়ক ও কলঙ্কজনক ঘটনা পর্যায় আমাদের প্রাণপ্রিয় এই শিক্ষায়তন এর সহিত আমাদের সম্পর্ক আজ নিয়ন্ত্রণ যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত করেছে। আমরা মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় অভ্যন্তরে এমন কিছু আছে যার ফলে এ ধরণের অবিশ্বাস্য ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঘটতে পারে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা এবং আভ্যন্তরীণ দুর্বলতা দূরীকরণের জন্য অবিলম্বে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাই।’
শিক্ষক সমিতির এই অবজারভেশন ও দাবির যথার্থতা সম্পর্কের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পবিত্রতা ও শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনাটা যারা কামনা করেন-অন্যকথায় সমাজের সুস্থ ও চিন্তাশীল কল্যাণকামী মানুষের কারো কোনো রকমের দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই।
তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের সর্ব প্রাচীন, সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্য শালী শিক্ষা অঙ্গন। সেখানেই যদি এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং তা এমন লজ্জাজনকভাবে অব্যাহত থাকে তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের অপরাপর শিক্ষাঙ্গনগুলো অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে সে কথা কি কেউ ভেবে দেখেছেন? আর যদি এ ধরনের ঘটনা বলি চলতে দেয়া হয় তবে এদেশের শিক্ষা-শিক্ষাঙ্গন বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে কোন অবকাশ আছে কি?
আমরা বিশ্বাস করি-আমরা শিক্ষক সমিতির উপরোক্ত দাবির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে দাবি করে অবিলম্বে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে তাদের চরম শাস্তি দেয়া হোক। অপরাধী যেই হোক না কেন তারা অপরাধীই এবং তাদের সাথে যদি কোনো প্রতিকুলতা সৃষ্টি হয়ে থাকে তবুও সকল প্রতিকূলতা পর্বত ডিঙিয়ে পেরিয়ে সেই ধরনের আচরণ করতে হবে। তা না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে বিরাজিত নৈরাজ্য গোটা জাতিকেই গ্রাস করবে এবং তখন আর কেউই তার হাত থেকে রেহাই পাবেন না-পেতে পারেন না।

দ্রব্যমূল্যের রাশ টানতে হবে

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের দৌরাত্মে জনজীবন আজ চূড়ান্ত রকম বিপর্যস্ত। দেশ স্বাধীন হবার পর সোয়া দুই বছরে দ্রব্যমূল্য কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। যার ফলে মধ্যবিত্ত পরিবার গুলো ক্রমে ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে অর্থনীতি বিশারদ মত প্রকাশ করেছেন যে, অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতাহীনতার জন্য ধনিক শ্রেণী আর আরো ধনী হচ্ছে, দরিদ্র শ্রেণীর আরো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে এবং শহর ও গ্রাম কেন্দ্রিক মধ্যবিত্ত পরিবারের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতি বিশারদ মহলের উল্লিখিত মতামতের সত্যসত্য আজ আমরাও উপলব্ধি করতে পারছি। স্বীকার করেই নিলাম স্বাধীনতা-উত্তর বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিতে কোন স্থিতিস্থাপকতা থাকেনা-থাকতে পারেনা। ঐ অবস্থা তৎকালীন পরিস্থিতির জন্য স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। কিন্তু তারপরে ক্রমশঃ সেই অবস্থা যদি আয়ত্তের মধ্যে আনার চেষ্টা না করা হয় অথবা আয়ত্তে আনার না যায় তাহলে তার যে বিষময় ফল হয়-আজকের বর্তমান অবস্থা তারই সার্থক দৃষ্টান্ত। আমরা দেখেছি বল্গাহীন অশ্বের মতো দ্রব্যমূল্য ছুটছে এবং ছুটছে।
আমরা এও জানি, উৎপাদনে নানান প্রতিবন্ধকতা, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে অসামঞ্জস্য ও ঘাটতি, পরিবহন সংকট, ত্রুটিপূর্ণ বন্টন ব্যবস্থা, মুনাফাখোর এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের সীমাহীন অর্থলিপ্সা, ব্যবসায়ীদের কালোবাজারি তৎপরতা এবং প্রশাসনিক দুর্নীতিতে পরিস্থিতি অবনতির দিকে গিয়েছে। কৃষক কুলের মধ্যে মধ্যে মাত্র ১২ জন কৃষক স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং মাত্র ১০ জন কৃষক কৃষি পণ্য বাজারে বিক্রি করতে পারে। মুষ্টিমেয় সংখ্যক কৃষকরা তাদের কৃষিপণ্য অস্বাভাবিক মূল্যে অবাধে বাজারে বিক্রি করছে। ফলে তাদের ভাগ্য খুলে যাচ্ছে এবং দরিদ্রের অভাব ও যন্ত্রণা বাড়ছে।
এছাড়াও উৎপাদন ব্যয় বা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি দেখিয়ে কিছুদিন পর পরই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা জিনিসপত্র নির্ধারিত দাম বাড়িয়েই যাওয়া হচ্ছে। অভিযোগে প্রকাশ, অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পূর্বাপর চিন্তা না করে বা প্রতিষ্ঠিত মূল্য নিয়ন্ত্রণ দপ্তর এর কাছ থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ না নিয়ে এককভাবে নিজেদের উৎপাদন ব্যয় অধিক দেখিয়ে উৎপাদিত সামগ্রিক মূল্য বৃদ্ধি করে চলেছে। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কালোবাজারি দাম হু হু করে চড়ে যাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি দাঁড়াচ্ছে এই যে, দেশময় একটা সামগ্রী ও অব্যবস্থা ও দুরবস্থার চক্র ক্রমেই জটিল হচ্ছে এবং তার জন্য জাতীয় অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আসতে পারছে না। একদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে দেশে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেনি অথচ মুদ্রা ক্রয় ক্ষমতা যে অর্ধেকেরও বেশি কমে গেছে তা আমরা প্রাত্যহিক জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
এই পটভূমির প্রেক্ষিতে বলা যায়-সীমিত আয়ের লোকদের অবস্থা আজ কল্পনার সীমাকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবুও আশায় বুক বেঁধে বলতে হচ্ছে-যা ঘটেছে তা অতীত। তাই বলে বর্তমানের পদক্ষেপ নিতে আর দেরি করলে অবস্থা সম্পূর্ণই আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে বলে আমাদের ধারণা।
অতএব ওয়াকিবহাল মহলের মত আমরাও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, অবিলম্বে একটি উচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠন করা হোক। এদের কাজ হবে প্রতিটি জিনিসের পণ্য মূল্যায়ন এবং দাম বৃদ্ধির কার্যকরণ পরীক্ষা ও বিবেচনা করা এবং সুষম বন্টন ও তার মাধ্যমে যেন ক্রেতাসাধারণ ন্যায় সঙ্গত উপায় দ্রব্যাদি পেতে পারে তার দিকে প্রখর দৃষ্টি রাখা।
পরিশেষে বলতে হয়, এই উচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিশন যেন কাগুজে বাঘ না হয় মূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা মূল্যে কঠিন আঘাত হানতে পারে তাই আমরা দেখতে চাই। কারণ দুর্নীতির ক্ষত প্রলেপে সারেনা, তার জন্য অস্ত্রোপচার তথা কঠোর প্রতিবিধানের কার্যকর ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণীয়। আর জাতিকে এই অর্থনৈতিক সংকটের আবর্তন থেকে বাঁচাতে গেলে সততা, নিষ্ঠা ও বাস্তব দৃষ্টি নিয়ে কাজ না করলে গত্যন্তর নেই। অশান্ত ও অতৃপ্ত জনগণের মাঝখানে বসে অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকহীনতার ধ্বংসাত্মক প্রভাবকে আজ স্বীকার করেই কাজে নামতে হবে। সব কথার শেষ কথা দেশের বৃহত্তর জনসাধারণের স্বার্থে দ্রব্যমূল্যের রাশ টানতে হবে।

ধান পাচার প্রসঙ্গে

ক্ষেতের ফসল ক্ষেতেই আছে। কিন্তু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। ব্যাপারটা খুবই চমকপ্রদ। দেশের অনেক এলাকায় বোরো ধান কখন কাটা হয়নি। কিন্তু বোরো ধান কেনার জন্য একশ্রেণীর ব্যবসায়ীদের মধ্যে দারুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা জমিতে ধান রেখে তা কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছে কেন এ প্রশ্নটি নেপথ্যে গভীর তাৎপর্য লুকিয়ে রয়েছে। জানা গেছে, কিশোরগঞ্জে নাকি গত বছরের তুলনায় বর্তমান বছরের ধানের ফলন হয়েছে আশা ব্যাপক। এ কারণে জনসাধারণের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছে যে, বোরো ধান কাটা শেষ হলে ধানের মূল্য কিছুটা হয়তোবা কমবে। বর্তমানে সমগ্র দেশব্যাপী ধান চালের দাম দারুণ চড়ে গেছে। ফসল ভাল ফলাতে সবার মনেই এহেন আশার আলো জ্বলে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা ক্ষেতের ধান কাটার আগেই সেই ধান কিনে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন, তাতে সকলের মনেই আশঙ্কার কালো ছায়া দেখা দিয়েছে। দেশের খাদ্য সংকটের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ধান কাটার আগেই কিনে নিয়ে তা যে সন্দেহতীতভাবে মওজুত করবে তাতে আমাদের কোন সংশয় নেই। শুধু মৌলিক নয় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পাচার হয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। তাই আমরা সরকারিভাবে কর্ডন বসানোর ওপর এখন থেকেই জোর দিচ্ছি। ধান-চাল যদি অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মতৎপরতায় পাচার হয়ে যায় তাহলে তা আমাদের খাদ্য সংকটের চিত্র কে নির্ধারণ ভয়াবহ করে তুলবে। যে এলাকায় ফসল ফলেছে, সেই ফসল যদি সেই এলাকার জনসাধারণের ভোগ থেকে লাঞ্চিত হয়ে যায়, তাহলে সেই এলাকায় যৌক্তিক কারণেই ধান চালের দাম হবে গগন স্পর্শী। কাজেই ব্যবসায়ীদের মতলবটা তেমন সুবিধার নয়। ধান কাটা শুরু হওয়ার আগে যেসব ব্যবসায়ী কৃষকদের কাছ থেকে ইতিমধ্যে ধান কিনে নিয়েছেন, তাদের অসাধু তৎপরতা দমনের জন্য জরুরী ব্যবস্থাবলম্বন বাঞ্ছনীয়।
সরকার খাদ্য সংগ্রহ অভিযান শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ অবধি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হয়ই নি, ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা কাছাকাছিও গিয়ে পৌঁছায়নি। গত বছরও ক্ষেত থেকে ধান কাটার আগেই ধুরন্দর ব্যবসায়ীরা তা কিনে নিয়ে ‘টু পাইস’ যা কামাবার কামিয়ে নিয়েছে। মাঝখান থেকে জনসাধারণকে উচ্চমূল্যের খেসারত দিতে হয়েছে। তাই আমরা ধান পাচারের তৎপরতাকে প্রতিরোধ করার জন্য সরকার সমীপে অনুরোধ জানাচ্ছি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!