বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৭শে মে, সোমবার, ১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
নারী প্রগতি আন্দোলনের পুরোধা আজ আর নেই
বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সংস্কৃতি ও ক্রীড়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম বদরুন্নেসা আহমদ শনিবার সকালে লন্ডনস্থ হামারস্মিথ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। (ইন্নালিল্লাহি……..রাজিউন) । কিছুদিন থেকেই তিনি ক্যান্সার রোগে ভুগছিলেন এবং লন্ডনের হ্যামারস্মিথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যু-দুয়ারের তালা খুলবার বয়স তার হয়েছিল না। কিন্তু করাল নিয়তি তাকে অকালে এ সম্ভাবনাময় জগত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেলো। এতে দেশবাসীর বিশেষ করে বাংলাদেশের নারী সমাজের অপূরণীয় ক্ষতি হল।
মরহুমা ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেত্রী। এছাড়াও শিক্ষাবিদ এবং প্রখ্যাত সমাজসেবী হিসেবেও তিনি ছিলেন অগ্রগণ্যা। তার মৃত্যুর খবরে অকস্মাৎ রাজধানীতে শোকের ছায়া নেমে আসে। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম মুজিব মরহুমার বাসভবনে গিয়ে তার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সান্ত্বনা জানান। মরহুমা বেগম বদরুন্নেসা আহমেদের আত্মার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনের জন্য রোববার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। এবং শনিবার সন্ধ্যায় নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানাদি বন্ধ করে দেয়া হয়।
বেগম বদরুন্নেসা শিক্ষাজীবন মোটামুটি সংগ্রামের ছিল। একটানা লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তার ভাগ্যে হয়নি। ১৯২৭ সালের ৩রা মার্চ কলিকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩ সালে বি,এ, ১৯৫৯ সালে বি,এড, ১৯৬১ সালে এম, এড এবং ১৯৬৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম,এ পাস করেন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, জ্ঞানস্পৃহা এবং শিক্ষানুরাগেই তাকে এই পথের প্রেরণা যুগিয়েছিল। তার কর্মজীবনেও বৈচিত্র আছে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বিভিন্নভাবে সমাজকর্মের অংশ নিতেন। আইয়ুব আমলে মহিলা সংসদের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নারী প্রগতির মূলক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারার আমলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার দায়ে কারাবরণ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মুজিবনগর গিয়ে তিনি তৎকালীন হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করেন। এতে করে তিনি প্রকৃত দেশ প্রেমিকের ভূমিকাই পালন করেন।
রাজনৈতিক মঞ্চে যখন এদেশের খুব কম মহিলার আনাগোনা তখন থেকেই তিনি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৪-৫৮ সালে তিনি পরিষদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭০-৭২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা; ১৯৫৯-৭২ পর্যন্ত বাংলাদেশে মহিলা সংসদের সহ-সভানেত্রী এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী সমিতির সভানেত্রী হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
চাকরি জীবনও সমাজ সেবায় ওঠেনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিলেন। ১৯৬৯-৭২ সালে লালমাটিয়া কলেজের সহঅধ্যক্ষা ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ইসলামিয়া কলেজের অধ্যক্ষা হন। তার এলাকায় তিনি কয়েকটি মহাবিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বহু সংখ্যক দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার পথ সুগম করেন। শুধু তাই নয়–প্রয়োজন বোধে এবং দেশের ডাকে তিনি সর্বদা সাড়া দিয়েছেন। কোন সংস্কার বা কুসংস্কারে তিনি আক্রান্ত হতেন না। তাই স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সহস্র কাজের মধ্যেও তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ইংরেজি খবর পড়তেন।
স্বাধীনতার পূর্বে ও বহির্বিশ্ব কার্যক্রমে মরহুমা বেগম বদরুন্নেসা আহমদ উল্লেখযোগ্য যোগ্যতা ও মর্যাদার পরিচয় রাখেন। অধ্যক্ষা আহমদ ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘের মহিলাদের অধিকার সেমিনারে যোগদানের জন্য আমেরিকা গিয়েছিলেন। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ১৯৫৭ সালেই ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ভ্রমণ করেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, বিপুল ব্যক্তিত্বের অধিকারিনী ছিলেন মরহুমা। মনোবল, কর্মনিষ্ঠা, দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি অকুণ্ঠ সহানুভূতি এবং অক্লান্ত কর্মশক্তিই তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল। দেশের অগণিত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা সহ বিশেষ করে বাংলাদেশের নারী সমস্যাকে তিনি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে দেখতেন। দেশে নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতি এবং সর্বপ্রকার নারী মুক্তি আন্দোলনে জানাতেন তার অকৃপণ সমর্থন ও সহানুভূতি। বাংলাদেশ আজ তাই শুধু এক কর্মী দেশপ্রেমিক’ নেত্রীকেই হারালো না, সেইসঙ্গে বাংলার নারী সমাজ হারাল তাদের অকৃত্রিম সুহৃদকে। নারী মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা এবং পৃষ্ঠপোষককে। দেশের জন্যও এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমরা তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাই। এবং বিশ্ব স্রষ্টার কাছে মরহুমার আত্মার শান্তি কামনায় মোনাজাত করি।
শিশুখাদ্যঃ আমদানিকারকদের সৃষ্ট কৃত্রিম সংকট?
শিশুখাদ্য নেই। বাজার থেকে দুধ উধাও। প্রায় দুই মাস ধরেই এই অবস্থা। অথচ চলতি বছরেই শিশু খাদ্য আমদানির জন্য এক কোটি ৬৮ লাখ টাকার লাইসেন্স দেয়া হয়েছে। এ লাইসেন্স গুলির অধিকাংশই পেয়েছে বেসরকারি আমদানিকারকরা। খবরে প্রকাশ, মোটা দুধের ১৩ হাজার ৭৪৪ মেট্রিক টন আমদানি করেছেন বেসরকারি আমদানিকারক আর মাত্র ২ হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন আমদানি করেছে টিসিবি। টিসিবি তা বন্টন এর জন্য তুলে দিয়েছে ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থার হাতে।
দুধ তবে কোথায়? এত এত দুধ অথচ তা বাজারে মিলছে না কেন? ইদানীংকালে প্রচারণা চালানো হচ্ছিল যে আমদানির ওপর খুব বেশি সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকার ফলেই বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়ছে, বাজার থেকে সে সকল জিনিস উধাও হচ্ছে। বাইরে থেকে কর্তারা বেশি দামে জিনিস কিনছেন এবং দুর্নীতির কালা গলিপথে তা মুনাফাখোর, মজুদদারদের হাতে পড়ে অগ্নিমূল্যে বাজারে বিকিকিনি হচ্ছে। যদি বেসরকারি আমদানিকারকদের জিনিস আমদানির সুযোগ দেয়া হতো তবে তারা দেখিয়ে দিতেন একহাত। কেউ দাবি করছিল এটা হলে জিনিসপত্রের দাম পঞ্চাশ ভাগ হ্রাস পাবে আবার কেউ বলছিল আশি ভাগ।
আমরা আমদানি বাণিজ্য সরকারি নিয়ন্ত্রণের ‘লুপহোল’ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নই তা নয়, কর্তা ব্যক্তিদের অনেকেই যে বিদেশ থেকে মাল কেনার সময় নিজের পকেট পূর্তি করেন এবং বন্টনের সময়ও দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন তা বারবার আমরাই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তার বিকল্প হিসেবে বেসরকারি আমদানিকারকদের আসর মাৎ করবার সুযোগ দানের সুপারিশ আমরা করতে পারি না। বরং সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন আমদানি বাণিজ্যকে সফল করে তোলার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা সরকারের কাছে আহবান জানিয়েছি।
চলতি বছরের শিশু খাদ্য আমদানি শতকরা ৮৪ ভাগ ছিল বেসরকারি আমদানিকারকদের হাতে। তারা সে দুধ আমদানি করেছেন কিন্তু তা গিয়ে পৌঁছেনি শিশুদের মুখে। আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ দপ্তর এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ‘বাংলার বাণী’র রিপোর্টার যোগাযোগ করলে তারা জানান, শিশু খাদ্য সংকটের জন্য বেসরকারি আমদানিকারকরাই দায়ী। তারা বলেন, এটি একটি কৃত্রিম সংকট। আমাদের বক্তব্য যদি সরকার সত্যি জানেন যে কৃত্রিমভাবে শিশুখাদ্যের সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে তবে সেই সংকট সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না। যে সকল আমদানিকারক শিশু খাদ্য আমদানি লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের তালিকা প্রকাশেও নাকি সংশ্লিষ্ট দপ্তর অসম্মতি প্রকাশ করেছেন। অভিযোগটি সত্য হলে আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাব তারা যেন ব্যাপারটির তদন্ত করে দেখেন। কাদের আমদানি লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল তাদের নাম-ধাম প্রকাশ করেন। এই আমদানিকারকরা আমদানিকৃত মাল বাজারে ছেড়েছে কিনা তারও খোঁজখবর নেওয়া হোক। মজুদ করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
খাদ্যশস্যের ব্যাপারেও উচ্চতর দায়িত্বশীল মহল থেকে বলা হয়েছিল এক শ্রেনীর মজুতদার কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যাপৃত রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোরতম নানা ব্যবস্থা গ্রহণের গালভরা বুলিও আওড়ানো হয়েছিল। কিন্তু দুমাস আগের সেই সংকট আজও তেমনি রয়েছে। ‘কৃত্রিম সংকট’ সৃষ্টিকারি তেমন কেউ ধরা পড়েছেন অথবা শাস্তির সম্মুখীন হয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই। শিশুখাদ্যের ব্যাপারে ‘কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি কারিদের’ উপর শুধু দোষ চাপিয়ে চুপ করে যাওয়া উচিত হবে না। তাতে করে সাধারন মানুষের আস্থা কমবে আর ‘কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি কারীরা’ যদি ইতিমধ্যেই প্রচুর ক্ষমতা এবং প্রভাব অর্জন নাও করে থাকেন তবে ভবিষ্যতে তাদের শক্তি আরো বাড়বে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক