You dont have javascript enabled! Please enable it!

কুমিল্লা আন্দোলনের ন্যায় ময়মনসিংহ আন্দোলন গড়তে হবে

ময়মনসিংহ; ১লা জানুয়ারি। বহু সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশের জন্য খাদ্য সংকট আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। বছরে ২০-২৫ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি একটি বিরাট বােঝার মতাে আমাদের ঘাড়ে চেপে আছে। দেশের বাণিজ্য থেকে পাওয়া বিদেশী মুদ্রার প্রায় সবখানিই লেগে যায় এ খাদ্য ঘাটতি মেটাতে। সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে সে সমস্যার সমাধানের জন্য সরকার দেশের বিরাট শক্তি ও সম্পদ নিয়ােজিত করেছেন। সে প্রচেষ্টায় যেটুকু ফল পাওয়া উচিত, জনসংখ্যার বিস্ফোরণের ফলে তা পাওয়া যায় না। বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা তিন ভাগের মত-আর কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির হার শতকরা দুই আড়াই-এর বেশি নয়। এ দুমুখী সমস্যা সম্পর্কে যারা চিন্তা করেন, তারা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির শতকরা হারকে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ করার কথা না ভেবে পারেন না। তাই একদিকে সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও অপরদিকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজকে এ জাতির সবচেয়ে বড় কাজ বলে ধরা যায়।
দেশের এ দুটি মূল সমস্যা জনসাধারণের সামনে তুলে ধরা ও তার সমাধনে যৎসামান্য অবদান রাখার মানসে জনসংযােগ বিভাগের বাংলাদেশ পরিষদ শাখা একটি কার্যসূচী গ্রহণ করছে। সে কার্যক্রম অনুসারে সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিষদের যৌথ উদ্যোগে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দু দিনব্যাপী এক জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
কৃষিমন্ত্রী জনাব আবদূস সামাদ আলােচনা সভায় বলেন যে খাদ্যে স্বনির্ভর না হয়ে আমাদের কোন পথ নেই। কারণ খাদ্য নিয়ে আজকের বিশ্বে চলছে কূটনীতি ও রাজনীতির খেলা।
দুদিনে চারটি মূল অধিবেশনে মােট সাতাশটি প্রবন্ধ-সংক্ষেপ পেশ করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন, বিভাগীয় প্রধান, প্রফেসর, সহযােগী ও সহকারী প্রফেসর ও প্রভাষকগণ। বাইরে থেকে এসে ছিলেন কতিপয় সুধীজন- কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর জনাব মাহবুব আলম চাষী, প্ল্যানিং কমিশনের কৃষি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর শামসুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিগণ, সরকারের কৃষি ও গণসংযােগ বিভাগের প্রধানদ্বয় এবং আরও কয়েকজন। সক্রিয় অংশগ্রহণ করে ছিলেন কৃষি খামারের আদর্শ চাষী আর কৃষি কর্মীরা। আলােচনা হয়েছে ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিধি নিয়ে খাদ্য সংকটের পটভূমিতে দেশের সেরা কৃষি বিজ্ঞানীরা বক্তব্য রেখেছেন কি করে উচ্চ ফলনশীল ফসলের চাষ করা যায়। খাদ্য বলতে কেবল ধান-চাল নয়, বিল, হাওর, সাগরের মৎস্য সম্পদ সব কিছু নিয়েই মানুষের খাবার। সীমিত জমিনে চাষাবাদের সংগে সংগে চারণভূমির সমস্যার সমাধানের কথাও আলােচনায় এসেছে। উন্নতমানের গৃহপালিত পশু-পাখির প্রজননের ব্যবস্থা প্রয়ােজন। এ সবের সম্প্রসারণ কাজে সমন্বয় সাধনের সমস্যা, খাদ্যাভাসের পরিবর্তন প্রভৃতি নিয়ে আলােচনা হয়েছিল ব্যাপক। দেশের সীমিত সম্পদের পরিপ্রেক্ষিতে সেচ ব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন চিন্তা, সার বণ্টনে ভর্তুকির যৌক্তিকতা প্রভৃতি নিয়েও হয়েছিলাে ব্যাপক পর্যালােচনা।
সর্বশেষ তিনটি সাব-কমিটিতে ভাগ হয়ে সেমিনার কতিপয় সুপারিশ করেছে। প্রয়ােগধর জ্ঞানের অনুসারী হয়ে সেমিনার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে- তা হলাে ময়মনসিংহ জেলার কতিপয় নির্বাচিত এলাকার সার্বিক উন্নয়নের জন্য একটি যৌথ কার্যক্রম। এর অংশীদার হবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, স্থানীয় প্রশাসন ও ময়মনসিংহের নেতৃবৃন্দ। এ প্রচেষ্টা সফল হলে কুমিল্লা আন্দোলনের মত ময়মনসিংহ আন্দোলন বলে একটা নতুন আন্দোলনের সৃষ্টি হবে এবং সারা বাংলাদেশে তার প্রসার ঘটবে।
বস্তুত দেশের খাদ্য সমস্যা সমাধানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত কৃষি বিজ্ঞানীদের কাছে সঙ্গতভাবে দেশ ও জাতি অনেক কিছু আশা করে। ময়মনসিংহ জেলার কিছু নির্বাচিত এলাকা নিয়ে তারা যদি পরীক্ষা-নীরিক্ষা শুরু করেন, আমাদের দেশের পরিশ্রমী কৃষকদের বাস্তব জ্ঞানের সঙ্গে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের কর্ষিত জ্ঞানের সংযােগ ঘটে, তাহলে আমাদের দুঃখ ঘুচতে আর কত দিন? এ ক্ষেত্রে সরকারী কৃষি দফতর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও সমন্বয়ের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। শুরুতে সে প্রচেষ্টা যে সর্বক্ষেত্রে সফলকাম হবে তা নয়, তবে তাদের ব্যাপক জ্ঞানের কল্যাণে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে সদিচ্ছার সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালালে সফলতা নিশ্চয়ই আসবে।
সম্মেলনে জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জ্ঞানের উর্ধ্ব মার্গে বিচরণের একটা প্রবণতা থাকে। সে উধ্বমুখী জ্ঞানের ডানা কেটে মাটিতে নামিয়ে এনে মানুষের কল্যাণে তাকে নিয়ােজিত করতে হবে। এ কথাটা দেশের প্রকৃত কল্যাণ সাধনের একমাত্র পথ।”

সূত্র: দৈনিক বাংলা, ২ জানুয়ারি ১৯৭৫
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭৫ – অধ্যাপক ড. আবু সাইয়িদ ও শাহজাহান মৃধা বেনু সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!