You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.08 | সম্পাদকীয়: ভারতের জয় সুনিশ্চয় | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

সম্পাদকীয়: ভারতের জয় সুনিশ্চয়

বৃটিশ আমলের মিলিটারি কেপ্টেইন, পাকিস্তানের আয়ুব খান আমলের জেনারেল আগা মােহাম্মদ এহিয়া খান যিনি গদীলাভের জন্য তদীয় চেলাচামুন্ডা সহ গভীর রাত্রিতে রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিয়া মুনিবের বুকের উপর পিস্তলের মুখ উঁচাইয়া ধরিয়া পাকিস্তানের শাসনভার করায়ত্ত করিয়াছিলেন, যিনি শুধু সেনাবাহিনীর জোরে পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তৃত্ব লাভ করেন, যিনি পাকিস্তানের কোন শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে অক্ষম ছিলেন, যিনি পাকিস্তানে নির্বাচনী ব্যবস্থা করিতে গিয়া যখন দেখেন পূর্বপাকিস্তান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একেবারে সর্বমত হইয়া যাইতেছে, অথচ এহিয়া গােষ্ঠী শতকরা ২ টি ভােটই পাইলনা। এজিদ এহিয়া আপােস আলােচনার মুখােস পরিয়া সারা পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তদীয় দোসর লে. জেনারেল টিক্কাখানের মারফতে বেমালুম নরহত্যা, নারী ধর্ষণ, ধ্বংস আদি অকথ্য ও অভাবনীয় নারকীয় কাজ চালাইয়া লইলেন।
প্রতিবেশী গণতন্ত্রী ভারত এহিয়া খানের জঙ্গী অত্যাচার অনাচার বন্ধ করার জন্য সারা দুনিয়ার মােড়লদের কাছে দফায় দফায় আবেদন করিয়াও কোন ফল পাইলনা। শুধু ভাওতা এবং বড় বড় উপদেশই শুনিল। মানবতা ও মাননীয় সভ্যতার নিকট মুখপােড়া এহিয়া খান তাহার পাপাচার, অনাচার চাপা দিয়া দুনিয়াকে ধােকা দেওয়ার উদ্দেশ্যে দশদিনের মধ্যে ভারত আক্রমণের হুমকি দিয়া বসিলেন।
অবশেষে ৩রা ডিসেম্বর শুক্রবার দিন এহিয়া খানের জঙ্গীগােষ্ঠী পাঞ্জাব, কাশ্মীর রাজস্থান সীমান্তে এমনকি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা আক্রমণ সুশুিরু করিয়া দিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা নীরব থাকিবে কি রূপে? তাহারা পাক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য যথাযােগ্য প্রত্যুত্তর দিতে আরম্ভ করিয়াছে।
ভারত বহুবার ঘােষণা করিয়াছে ভারত কখনাে কাহারাে দ্বারা আক্রান্ত হইলে আক্রমণকারীদের বিষদাঁত ভাঙ্গিয়া দিতে ত্রুটি করিবেনা। ভারতবাসী আজ সত্য সত্যই পুলকিত যে ভারতীয় জল, স্থল ও আকাশ বাহিনী দিকে দিকে দুশমনের আক্রমণ প্রতিহত করতঃ তাহাদের বিষদাঁত ভাঙ্গিয়া দিতেছে। যে দিন পাকিস্তানী বাহিনী ভারত আক্রমণ করে, সেদিন ভারতনেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলিকাতায়। তিনি দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করিয়া মন্ত্রীসভার বৈঠক আহ্বান করতঃ জরুরীকালীন অবস্থা ঘােষনা[ণ] করেন।
বাংলাদেশে যেখানে মুক্তিবাহিনী হানাদার খানদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত ছিল সেখানেও ভারতীয় স্থল ও বিমানবহিনী দক্ষতার সহিত হানাদারদের শায়েস্তা করিতে নিয়ােজিত হইয়া যায়। বাংলাদেশের দিকে দিকে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর যােগে একের পর এক করিয়া সারা বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলি দখল করিয়া লইতেছে। শত শত খান সেনা ও সেনানায়ক ভারতীয় বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করিতেছে।
ভারত সরকারের পক্ষে বলা হইতেছে বাংলাদেশ দখল করিয়া রাখার জন্য ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে যুদ্ধ করিতেছে না। হানাদার মুক্ত বাংলাদেশের শাসনভার ও কর্তৃত্ব বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিষদের হাতেই যাইবে ও থাকিবে।
আরাে সুখের বিষয় ভারত সরকার গত সােমবার দিন ভারতীয় পার্লিয়ামেন্টের যুক্ত অধিবেশনে বিপুল হর্ষধ্বনীর মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করত: দেশের জনমতের প্রতি সময়ােচিত শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়াছেন। সারাদেশবাসী ভারত সরকারের এই সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানাইতেছেন। অপর দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ভারতের সঙ্গে কুটনীতি সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া লইয়াছেন।
দেশের পরিস্থিতি বর্তমানে এমন পৰ্য্যায় পৌঁছিয়াছে- এই সময়ে গােটা দেশবাসী একাগ্রচিত্তে অকুণ্ঠিত ভাবে ভারত সরকারের প্রতিরােধাত্মক নীতিকে সমর্থন জানাইতেছেন। দেশ ও জাতীর এহেন জটিল যুগ সন্ধিক্ষণে যুবাবৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেরই উচিত সংযত ও সংহতভাবে জাতীয় সরকারকে সাহায্য করা। পরচালিত পাকিস্তান অহেতুকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামিয়াছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে মার খাওয়ার পর পাকিস্তানের উচিত ছিল ভারতের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তিবদ্ধ হইয়া নিজেদের কল্যাণ করা, নিজেদের শাসনতন্ত্র রচনা করিয়া ভারতের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে চলা। কিন্তু পাকিস্তানের জঙ্গীগােষ্ঠী সে পথে না গিয়া ভারতের অগ্রগতির পথে কাটা দিতে আগাইয়াছে যে কাটায় নিজেরাই কণ্টকিত হইয়া ধ্বংস হইবে।
অল্পদিন মধ্যেই বাংলাদেশ হানাদার মুক্তা হইয়া ধর্ম নিরপেক্ষ গণতন্ত্রী রাষ্ট্রে পরিণত হইবে এ বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। পশ্চিম রণাঙ্গনেও ভারতীয় বাহিনী বিপুল বিক্রমে আগাইয়া চলিয়াছে।
শ্ৰেণী, সমাজ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সারা ভারতবাসী এক ও অভিন্ন হইয়া দেশের বর্তমান সংকটকালে ভারতের বিজয়ের সকল রকম পরিবেশ রচনায় আগাইয়া আসিতেছেন এটুকু বলাই বাহুল্য। আমাদের মনে রাখিতে হইবে পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদী ও ধনতন্ত্রী কূটচক্র ভারতের অগ্রগতী এবং উন্নয়নকে সুনজরে দেখিতে পারিত না। যে কোন ত্যাগে যে কোন মূল্যে আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, সংহতি, প্রগতী ও জয়যাত্রা অক্ষুন্ন রাখিতে হইবে। জাগ্রত জগৎ জানিয়া লউক ভারত পররাজ্যগ্রাসী বা সম্প্রসারণবাদী নহে, ভারত সৰ্ব্বপ্রযত্নে তাহার সাৰ্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রাখিতে যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত। সঙ্গে সঙ্গে যে বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দান করিয়াছে দান করিয়াছে সে দেশের পরিপূর্ণ মর্যাদা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারত কোন অবস্থাতেই ত্রুটি করিবেনা।
সুতরাং সর্বাবস্থাতেই ভারত চরম বিজয়ী হইবে। প্রত্যেক ভারতবাদী মনেপ্রাণে কথায় কাজে চরম বিজয়ের পরিবেশ রচনায় পরিপােষকতায় এক এবং অভিন্ন।
জয়হিন্দ-

সূত্র: আজাদ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১