You dont have javascript enabled! Please enable it!

সম্পাদকীয়: আজিকার কর্তব্য বাংলাদেশ স্বাধীন হইয়া গেল

স্বাধীন বাংলা পুনঃগঠন, প্রশাসনিক সংগঠন, আদিবাসীদের যাহারা গৃহহারা হইয়াছিল তাহাদের নিজ নিজ বাস্তুভূমে বসবাস করান, দেশের কৃষি শিল্প ব্যবসায় বাণিজ্যগুলি চালুকরণ, সৰ্ব্বরকম যােগ যথানিয়মে চালুকরণ, আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা, মুদ্রার প্রচলন এসব একান্ত জরুরী কাজ।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্মত শাসনতন্ত্র রচনা করা প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরের চাকুরিগুলির শূন্য আসন পূরণ করা দেশের অভ্যন্তরে দৃঢ় করা নতুন স্বাধীন দেশের সরকারের পক্ষে এক বিশেষ সমস্যা। একটা লণ্ড ভণ্ড দেশের সমাজ জীবন ও প্রশাসনিক বিন্যাস যথাযথ করিয়া তােলা একটা কঠিন কাজ।
বাংলাদেশের নতুন সরকারকে আজ অত্যন্ত সতর্ক এবং দৃঢ়পদক্ষেপে আগাইয়া চলিতে হইবে কেননা দেশের জনজীবনে যে বিপর্যয় আসিয়াছিল, যে শূন্যতার ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হইয়াছিল খুব বিচক্ষণতার সহিত সে গুলির সমাধান বা পূরণ আজিকার বড় কথা।
বাংলাদেশের মুক্তি এবং স্বাধীনতার ব্যাপারে আসাম মেঘালয় ত্রিপুরা ও পশ্চিমাবাসীদের বিশেষ উচাটন এবং আকর্ষণ ছিল। এই চারিটি রাজ্যের আদিবাসীরা নানাভাবে বাংলাদেশের ঘটনাগুলির ও সমস্যাগুলির সঙ্গে জড়াইয়া পড়িয়াছিলেন তাহা ছাড়া বাংলাদেশের সহিত এই চারিটি রাজ্যের জনগণের বড় অংশের একটা আত্মিক যােগ রহিয়াছে। এই কারণে আজিকার বাংলাদেশের স্থানে যাওয়া আসার জন্য আত্মীয় বন্ধুদের সংবাদাদি পাওয়ার জন্য একটা বিশেষ আকর্ষণ থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলিয়া তাড়াহুড়া করিয়া বাংলাদেশে যাওয়া আসার ঝুঁকি লওয়া উচিত হইবে না। কেননা সে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা যােগাযােগ এবং প্রশাসনিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠিত হইতে কিছুটা সময় লাগিবে। বর্তমানে সেখানকার অধিবাসীদের বসতি, খাদ্য সরবরাহ এসব কাজ চলিতেছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আরম্ভ হইতে যথেষ্ট সময় লাগিবে। রেলপথে সড়কপথে যােগাযােগ যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করিতে সময়েরও প্রয়ােজন আছে।
তদুপরি বাংলাদেশ পৃথক একটা রাষ্ট্র। সে রাষ্ট্রের কাঠামােও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ঠিকমতে চালু হইতে সময়ের দরকার। তাহা ছাড়া হানাদার পাকসেনারা নানাভাবে সে দেশের অভ্যন্তরে বহু প্রকার নাশকতা সৃষ্টিকারক মারণদ্রব্যাদি যত্রতত্র পাতাইয়া বা ফেলিয়া গিয়াছে। এমতাবস্থায় সেখানে বহিরা লােকের যথেচ্ছ যাতায়াত বর্তমানে বাঞ্ছনীয় নহে বলিয়াই আমরা মনে করি।
সর্বোপরি বড় কথা হইতেছে দুষমন বা দুষমনদের চরেরা নানাভাবে সে দেশে জনগনেণের মধ্যে পারস্পরিক কলহের চেষ্টা চালাইয়া জনজীবন বিপর্যস্ত করিতে ত্রুটি করিবেনা।
স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে বাংলাদেশবাসীরা বিজয়ী হইয়াছেন ইহা গৌরবের কথা কিন্তু সে দেশের জনজীবনে এখনও বিপর্যয় সৃষ্টির কারণে বিভীষণের দল যে নাই ইহা ভূভুলিলে চলিবে না।
এহেন অন্তর্বর্তীকালীন পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে বিচক্ষণতার সহিত চলার এবং ধৈর্য্যের সহিত কাজ করার প্রয়ােজনীয়তা রহিয়াছে। আমাদের আচরণে, যাতায়াতে, মন্তব্যে এবং অতি আগ্রহের কারণে যাহাতে সে দেশে কোন ঝামেলার সৃষ্টি না হয়, সে দেশের জনমনে যাহাতে বিরূপ ভাবের উদয় না হয়। সেদিকে আমাদের লক্ষ্য রাখা একান্ত দরকার।
ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবেই বাংলাদেশের সৃষ্টি হইয়াছে, সেদেশে যখন গণতন্ত্রী, সমাজবাদী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনেতারা বা উভয় দেশের সরকার এমনভাবে শাসন, অনুশাসন ব্যবস্থা করিবেন যাহার ফলে উভয় রাষ্ট্রের যােগাযােগ, যাতায়াত, আদান প্রদান সহজতর হইবেই। সুতরাং তাড়াহুড়া করিয়া কোন রকম সমস্যা সৃষ্টির কারণ যাহাতে আমরা না হই তৎপ্রতি সচেতন সচেতন থাকা আমাদের কর্তব্য।
আমাদের আরাে মনে রাখা দরকার যে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বের রচনার পটভূমিকা লক্ষ্য করিয়া বিশ্বের বহু দেশ বিনিদ্র রজনী যাপন করিতেছে।
মনে রাখিতে হইবে বেলজিয়াম অধিকৃত কঙ্গোর মুক্তি স্বাধীনতা লাভ হইয়াছিল সত্য কিন্তু কঙ্গোর নয়নমনি পেট্রিস [এ] মুম্বা সশরীরে কঙ্গোতে পদার্পণ করিতে পারেন নাই। পাক অধিকৃত বাংলাদেশের মুক্তি হইয়াছে। বাংলাদেশের নয়নমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশে আসিয়া তাহার দেশ পরিচালনা করুন। ইহাই আজিকার প্রধান কাম্য।

সূত্র: আজাদ, ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!