সম্পাদকীয়: আমাদের কর্তব্য
মাননীয় আজাদ সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু,
আমার সবিনয় নিবেদন নিম্নে আমি যে চিঠিখানা আপনাকে লিখছি তা যদি আপনার জনপ্রিয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় তবে বাধিত হব।
আপনার সংবাদপত্রে ১৫ই সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত “বাংলাদেশ ও এহিয়াখান” প্রবন্ধটি পাঠ করেছি। প্রবন্ধটি সত্যিই অপূৰ্ব্ব লেগেছে আমার কাছে। অপূৰ্ব্ব লাগার কারণ প্রবন্ধটির মধ্যে কোন অমূলক যুক্তির অবতারনাণে না করে লেখক যে নগ্ন সত্যটির উঘাটন করেছেন তার প্রশংসা না করে পারা যায় না। পূর্বপাকিস্তানে সশস্ত্র পাকিস্তানী ফৌজ সৈন্যদের হাতে বাঙালীরা নির্মমভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে এটা সকলেরই জানা। এবং আমার মনে হয় এও বােধ হয় সকলেরই জানা যে পাকিস্তানী সৈন্যদের কৃত পাশবিক অত্যাচারের সকল বৃত্তান্তই পূর্বপরিকল্পিত এবং পূৰ্ব্বস্থিরীকৃত। কিন্তু ভাবলেও আশ্চর্য লাগে যে বিংশ শতাব্দীর সুসভ্য সমাজে এই অসভ্য বৰ্ব্বরতা কিভাবে স্থান পায়? আজকের এই ঘটনাবলী যে পূৰ্ব্ব-বাংলায় নির্বিবাদে ঘটে যাচ্ছে তার নজির কিন্তু ইতিহাসেও নাই। নাদির শাহের ভারত আক্রমণে] এবং তার অত্যাচারের কাহিনী পড়তে পড়তে আমাদের শরীরের রক্ত গরম হয়ে ওঠে কিন্তু পাকবাহিনীর পাশবিক অত্যাচার সে নাদিরকে হার মানিয়েছে। কিন্তু সে যাইহােক আমি এই চিঠির মধ্যে অতীত এবং বর্তমানের কোন তুলনা আনতে চাই না। আমি শুধু আমার স্বধর্মীয় মুসলিমগণকে সতর্ক করে দিতে চাই যে, পাকিস্তান আমাদের এই কাছাড়ের দিকেও লুব্ধনেত্রে তাকিয়ে রয়েছে।
আমরা সকলেই জানি পাকিস্তানের শুরু থেকেই সে শুধু ভারতের শত্রুতা করার চেষ্টায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। তাহাদের কিছু অনুচর ভারতের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে ধর্মের নামে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতবর্ষে শান্তি বিঘ্নতা ঘটাতে চায়। শুধু তাই নয় তারা কাছাড়ের মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য প্রেরণ করে কাছাড়ের সমস্ত প্রকার সুবিধা নষ্ট করতে ও বদ্ধপরিকর। আজ তারা ভারতের মধ্যে যাতায়াত বিঘ্নতা ঘটাচ্ছে। পাকিস্তান হতে আগ্নেয়াস্ত্র ভারতের মধ্যে অবৈধভাবে চালনা করে কাছাড়ের সর্বনাশের চেষ্টা করছে। এ ছাড়া তারা ভারতের নামে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। এখন আমার যা মনে হয় তাতে এই টুকুই পরিস্কার যেভাবে পাকিস্তান কাশ্মীরকে ভারত হতে ছিনিয়ে নিতে চাইছে’ ঠিক একই পন্থার অনুকরণে তারা কাছাড়কেও ছিনিয়ে নিতে চায়।
সুতরাং এই সংকল্প হতে পাকিস্তানকে বাধা দিতে হলে বাংলাদেশকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা স্বীকৃতি দিতে হলে, আমার মুসলিম ভাইদের উচিৎ সর্বাগ্রে পাকিস্তানী অনুচরদের উপর তীব্র দৃষ্টিতে পাহারা দেওয়া এবং তাদের কার্যকলাপ হতে দুশমনদেরে বিরত করা। আমার মুসলিম ভাইদের যে শক্তি ও একতা আছে যদি তারা সেই বৃহত্তম শক্তির যথাযথ প্রয়ােগ করেন তবে পাকিস্তানী বর্বরতার, তাদের হিংস্র কাৰ্যকলাপের অবসান ঘটানাে সম্ভব। বাংলাদেশে মুক্তিফৌজ যে অদম্য উৎসাহ এবং সাহসের সংগে তাদের দেশকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে দুর্ধর্ষ পাকিস্তানীদের বিতাড়িত করার জন্য তার তুলনা নাই। তদ্রুপ অতুলনীয় সাহস ও ক্ষমতায় যদি ভারতীয়রা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তবে পাকিস্তানীদেরে হটিয়ে দেওয়া খুব একটা কঠিন কাজ বলে আমার মনে হয় না।
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কাছাড়বাসীর কাছে আমার প্রার্থনা, তারা যে ন] একতাবদ্ধ হয়ে আমাদের সকল প্রকার সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তাদের সকল প্রকার সাহায্যের দ্বারাই কেবল মাত্র দুষ্কৃতকারীদের খুঁজে বের করা সম্ভব, তাদের শাস্তি দেওয়া এবং বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের তাদের দেশকে স্বাধীন করার চেষ্টায় সামান্যতম হলেও সাহায্য করা সম্ভব। পাকিস্তান বেতার এবং পাকিস্তানী সরকার একটানা নানা প্রকার মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই মিথ্যা প্রচারকে আমরা কিছুতেই ক্ষমা করতে পারি না। তাদের মিথ্যাকে সত্যের পদতলে আসতে হবে। আর তার জন্যই প্রয়ােজন একতা, শক্তি ও সাহস। তাই আল্লাহর কাছে আমার এই প্রার্থনা তিনি যেন আমাদের শক্তি, সাহস যুগিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে ও দেশকে শত্রুমুক্ত করতে সাহায্য করেন।
২০/৯/৭১ ইং
আনােয়ারুল হক বটরশী, করিমগঞ্জ
সূত্র: আজাদ, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১