You dont have javascript enabled! Please enable it!

সম্পাদকীয়: শরণার্থী ও আমরা

মেঘালয়ে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরগুলির অবস্থা সম্পর্কে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধির কাগজে বর্তমান সংখ্যার যে করূণ চিত্র প্রতিফলিত করিয়াছেন তাহা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের কারণ হইয়া পড়িয়াছে। নিজের পিতৃপুরুষের বাসভূমী হইতে পাকিস্তানী জান্তার অত্যাচারে জর্জরিত হইয়া যেসব হতভাগ্যরা ভারতের মাটীতে আসিয়া স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলিতে চাহিয়াছিল তাহারা কি স্বস্তি লাভ করিয়াছে? অনেক স্থলেই দেখিতেছি। সরকার ও জনসাধারণ অবহেলার কারণে এই সব শরণার্থী চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়িতে বাধ্য হইয়াছে।
ইহারি পরিপ্রেক্ষিতে পাক বেতারে আমাদের শরণার্থীদের অবস্থা পর্যালােচনা করিয়া একটুকুকে দশটুকু করিয়া দিনের পর দিন বর্ণনা দিতেছে। অবশ্য তাহারা যে বর্ণনা দিতেছে তাহার শতাংশের এক শতাংশও সত্য নয়। কিন্তু বিষয়টা নিয়া ভাবিবার প্রয়ােজন হয়ে পড়িয়াছে। সর্বশেষ খবরে দেখিতেছি যে, কলেরার আক্রমণে একমাত্র মেঘালয়ের মৈলাম শিবিরেই এক হাজার লােক মারা গিয়াছে। সেপ্টম্বরের মধ্যেই মৃত্যুর সংখ্যা নাকি ৭৭০ জন। তবুও শরণার্থী আগমনের বিরাম নাই। দৈনিক ৩ হাজার জন শরণার্থী এখনও মেঘালয় রাজ্যে প্রবেশ করিতেছে গত সপ্তাহে কেন্দ্র হইতে একটা উচ্চ পর্যায়ের পর্যবেক্ষক দল এইসব শিবির পরিদর্শন করেন এবং অবিলম্বে ৬০ হাজার শরণার্থীকে তথা স্থানান্তর করা সাব্যস্ত করিয়াছেন।
এইসব শরণার্থীদের জন্য খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য ভারত সরকার দৈনিক দেড় কোটি টাকার উপর খরচ করিতেছেন। একমাত্র মানবতার খাতিরেই তাহাদেরকে আশ্রয় দেয়া হইয়াছে। সারা পৃথিবীর মানব কল্যাণকামী জনসাধারণ উহাদের জন্য খাদ্য বস্ত্র, ঔষধ ও অর্থ পাঠাইতেছেন যদিও প্রয়ােজনের তুলনায় উহা সাগরে বারিবিন্দুবৎ তবু ভারত নিজে ধ্বংস হইয়াও এইসব হতভাগ্য মানবগােষ্ঠীর সেবায় ও পরিচৰ্য্যায় লিপ্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী হইতে আরম্ভ করিয়া আসামের মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই এইসব শরণার্থীদের মান্য অতিথি হিসাবে ব্যবহার করিবার পরামর্শ দিতেছেন। এই বিরাট সমস্যা মােকাবিলা করার জন্য জনসাধারণকে তাহারা অকুণ্ঠ সাহায্য ও সহযােগিতা করিবার জন্য আবেদন করিতেছেন।
এই অবস্থায় আমাদের আত্মসমীক্ষা করার প্রয়ােজন হইয়া পড়িয়াছে। করিমগঞ্জ মহকুমায় যে কয়টী শিবির স্থাপিত হইয়াছে তাহার সবগুলি কি সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হইতেছে? সাংবাদিক ও জননেতাদের নিয়া একটী পৰ্যবেক্ষক কমিটী এর দরুণ নিয়ােগ করা উচিত বলিয়া আমরা মনে করি। সরকারী কর্মচারীরা যাহা করিতেছেন তাহাই অভ্রান্ত বলিয়া মনে করি না। ত্রুটি বিচ্যুতি সকলেরই হইতে পারে। বিগত ১৯৫০ ইং হইতে উদ্বাস্তু ও বন্যা দূর্গতদের জন্য ত্রাণ ব্যবস্থা করিতে এই সহরে বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান আছে, যাহারা বারবার তাহাদের নিঃস্বার্থ সেবার মধ্য দিয়া কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন এবং সরকারী শিবির সংস্থাপনের পূর্বে উহারাই এই গুরু দায়িত্ব পালন করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু আজ সরকারী শিবিরে শরণার্থী স্থানান্তর করিয়া এইসব নিঃস্বার্থ জনদরদী ব্যক্তিদের উহার মধ্য হইতে সরইয়া দেওয়া হইয়াছে, কারণ তাহাদের পক্ষে এখন আর কোন সুযােগই নাই।
আমরা শিবিরগুলির পরিচালক ব্যবস্থায় বহু ত্রুটি বিচ্যুতির খবর পাইতেছি। পাথু ও দাসগ্রাম ক্যাম্প একটা অপরটা হইতে কিছু দূরে অবস্থিত কিন্তু বালক বৃদ্ধ সকল শরণার্থীকে ঘাড়ে করিয়া একস্থান হতে অন্যস্থানে রেশন বহিয়া আনিতে হয়। চিকিৎসার সুষ্ঠু ব্যবস্থা নাই। সরবরাহকারক ঠিকাদারদের মধ্যে মানবদরদের লেশমাত্র নাই। অখাদ্য কুখাদ্য সরবরাহ হইতেছে। নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিষপত্র কিনিবার জন্য শিবির সংলগ্ন কোন ন্যায্য মূল্যের দোকান নাই। কোন কোন ক্যাম্প পরিচালক সম্পর্কে গুরুতর অভিযােগ শােনা যায়। শরণার্থীদের মনের উৎকর্ষতা, সজীবতা ও মনােবল রক্ষার জন্য কোন প্রয়ােজনীয় প্রচার ব্যবস্থার ও অভাব। এ যেন কতকগুলি লােকের বিপদের সুযােগ নিয়া অপর এক শ্রেণীর স্বার্থপর লােকের অর্থ উপার্জনের সুযােগ হইয়া পড়িয়াছে।
আমরা চাই যে, যে মানবতার কারণে আমরা এইসব শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়াছি সেই মানবতাবোেধ কৰ্ম্মী ও কর্মচারীদের মধ্যে বৃদ্ধি হউক।

সূত্র: দৃষ্টিপাত, ১৩ অক্টোবর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!