সম্পাদকীয়: এপার ও ওপার বাঙ্গলা নয় বাংলা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার পটভূমি বিচার বিশ্লেষণ করিলে ইহা জলের মতাে পরিষ্কার দৃষ্ট হয় যে, পূর্ব বাঙ্গালার ভাষা আন্দোলনই সমগ্র জাতীকে প্রেরণা ও উৎসাহ জোগাইয়াছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু করিবার দৃঢ় সংকল্পকে পূর্ব বাংলার তরুণ ও বুদ্ধিজীবি সমাজ তাদের ত্যাগ ও দুঃখ বরণের ভিতর দিয়া নস্যাৎ করিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছেন। ১৯৫২ ইংরেজীর পূৰ্ব্বাঙ্গলার ঐতিহাসিক ভাষা সংগ্রাম যেমন তাহাদের ভাষার অধিকার দিয়াছে তেমনি মহৎ কাজে ঐক্যবদ্ধ হইবার প্রেরণা যােগাইয়াছে। এই প্রেরণাই পশ্চিম পাকিস্তানের সহিত তাহাদের শিকল ভাঙ্গার গানের জন্ম দিয়াছে। কিন্তু তাই বলিয়া বাংলা ভাষার প্রতি তাহাদের ভালবাসার এতটুকু শিথিলতা দেখা যায় নাই। বিগত কয়েক বৎসরের মধ্যে সংগীত, নাটক, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসে বাঙ্গলাদেশে যে উন্নতি দেখা দিয়াছে তাহা কল্পনাকেও হার মানায়। বিধি নিষেধের বেড়াজালে পূৰ্ব্বাঙ্গলার সীমানা আমাদের নিকট বন্ধ থাকায় তাহার সম্যক পরিচয় পাওয়ার সুযােগ পায় নাই। আজ উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়া যে সুর ভাসিয়া আসিয়া আমাদের নিকট পৌছিয়াছে তাহার পরিচয় পাইয়া আনন্দে বুক ভাসিয়া ভরিয়া উঠিতেছে। সাংবাদিক বন্ধু শী এম, আর, আখতারের পত্রান্তরে প্রকাশিত একটি মূল্যবান প্রবন্ধের প্রতি ছত্রে ছত্রে পূর্ব বঙ্গবাসীর অসীম ধৈৰ্য্য, সাহসীকতা ও বাংলা ভাষার প্রতি তাহাদের দরদের পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জয়ন্তী উৎসবগুলি সরকারি বিধি নিষেধ এড়াইয়াও তাহারা যে নিষ্ঠার সহিত পালন করিয়া আসিয়াছেন তাহা আমরা কোন দিনই পারি নাই। এই বাংলা ভাষা প্রীতির ভিতর দিয়াই ১৯৫২ ইংরাজীতে রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলন এর আরম্ভ এবং শহীদের রক্তস্নাত হইয়া বাংলা ভাষার জয়যাত্রা পূর্ববাংলায় অপ্রতিহত গতিতে চলিতে থাকিল। শ্রীনুরুল আমিন সরকার দুই বাঙ্গলার মধ্যে পত্র পত্রিকার আদান প্রদান বন্ধ করিল এবং যাতায়াতে পাশপাের্ট প্রথা প্রবর্তিত হইল; তবুও বাংলাভাষার কণ্ঠরােধ করা গেল না। কাগমারী সম্মেলনে ভারত হইতে তাহার বিশেষ বাঙালী লেখকদেরে নিমন্ত্রণ করিয়া নিলেন। এমনকি সম্মেলনের তােরণগুলির যেসব নামকরণ হইল তাহা ও বাঙালী ঐতিহ্যের প্রমাণ দেয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য আলােচনার জন্য প্রয়ােজনীয় পুস্তকাদি তথায় দুষ্প্রাপ্য হইলেও কত না কষ্ট স্বীকার করিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ হইতে কয়েকটি গবেষণামূলক পুস্তক রচিত ও প্রকাশিত হইল। জনাব আখতারের মতে ডঃ আহমদ শরীফের ‘পদ্মাবতী”, ডঃ নীলিমা ইব্রাহীমের “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন”, ডঃ আনিসুজ্জামানের “বিদ্যাসাগর রচনাবলী”, ডঃ দীন মােহাম্মদের “ভাষার ইতিহাস” অধ্যক্ষ আবদুল হাই ও অধ্যাপক আনােয়ার পাশার যুগ্ম সম্পাদনায় “চর্যাপদ” প্রভৃতি অন্যতম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পরিষ্কার জানাইয়া দিল, ক্লাসে সমস্ত বক্তৃতা বাংলাভাষায় দিতে হইবে। উহাতেই কাজ হইল, বাংলা ভাষায়ই অধ্যাপকরা বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করিলেন। দোকানের সাইনবাের্ডগুলি পালটাইয়া বাংলা করা হইল এবং আখতার সাহেব কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন কি করিয়া দোকানের বিদেশী নাম পালটাইয়া বাংলা নাম দেওয়া হয় যথা- রেস্টুরেন্টের নাম (ক) বিশ্রাম (খ) কিছুক্ষণ (গ) পান্থশালা (ঘ) তৃষ্ণা; পুস্তকের দোকানের নাম “বর্ণমালা”, কাপড়ের দোকানের নাম “আবরণী”। উহাতে ব্যবসায় কাহারও কোনও ক্ষতি হয় নাই। তাই বলা যায় ৫২’র ভাষা সংগ্রামই ৭১’এ আসিয়া পূর্ণ স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নিয়াছে।
১৯৬১ ইংরাজীতে এই কাছাড় জেলায় ও একটি ঐতিহাসিক ভাষা সংগ্রাম জন্ম নেয়। করিমগঞ্জ হইতেই উহা জন্ম নেয় এবং ১৯ শে মে শিলচরে একাদশ শহীদের রক্ত এই আন্দোলনের ইন্ধন যােগায়। সমগ্র আন্দোলনের গতি ও প্রকৃতি কোন বড় সংগ্রামের চেয়ে কম ছিল না। সেই সময়ে কাছাড়ের ছাত্র ও যুবক সমাজের যে উন্মাদনা আমরা দেখিয়াছি তাহার তুলনা নাই। কিন্তু আমরা কাছাড়বাসীরা এই প্রাণ বন্যাকে জিয়াইয়া রাখিতে পারি নাই যেমন জিয়াইয়া রাখিয়াছেন আমাদের বাঙ্গলাদেশের ভাইরা। চরম আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে কাছাড়ের জন্য আমরা বাংলা ভাষার দাবী আদায় করিয়াও বাংলার জন্য কি করিতেছি? আজও কলেজগুলিতে ইংরাজী বক্তৃতা অধিকাংশ ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিসে ইংরাজী সাইনবাের্ড, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গুলিতেও ইংরাজী ছড়াছড়ি। সম্প্রতি শিলচর স্কুলবাের্ডে বাংলা ভাষার প্রবর্তন প্রশংসার দাবি রাখে। যানবহন নম্বর প্লেটগুলিও কাছাড় জেলায় বাংলায় প্রবর্তিত হয় নাই। এই নিয়া কাছাড়ের যুব সমাজের মধ্যে কোনও আন্দোলন নাই কেন? স্বৰ্গতঃ লালবাহাদুর শাস্ত্রী মহাশয় গােলটেবিল বৈঠকে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিবর্গকে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন তাহার অনেকটাই আজ পর্যন্ত পালিত হয় নাই, এ নিয়াও যুব সমাজের মধ্যে কোন সাড়া শব্দ নাই। তাই নিবেদন। করিতেছি, আজ যখন ওপার এপারের কাছে আসিয়াছে, তাহাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও দুঃখবরণের ঐতিহ্য স্মরণ করিয়া কাছাড়ের ছাত্র ও যুব সমাজ ও নূতন করিয়া সব আবার ভাবিয়া দেখুন কি আমাদের কর্তব্য।
সূত্র: দৃষ্টিপাত, ২৩ জুন ১৯৭১