সম্পাদকীয়: ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব দিতে হইবে
পাকিস্তানের জঙ্গী লাট আবার মুখ খুলিয়াছেন। লজ্জা নাই, দ্বিধা নাই, মানবিকতার চরম ধিক্কারে বিবেকের রুদ্ধদ্বার বিন্দুমাত্র ঠেলে নাই, গণতন্ত্র ও জনমতের উপর কসাইয়ের ছুরি চালাইয়া সভ্য পৃথিবীর ইতিহাসে আবর্জনার রূপ ধারণ করিয়া ইয়াহিয়া খান গত ২৮শে জুন যে ঘােষণা করিয়াছেন তাহা তাহার জঘন্য মানসিক প্রবৃত্তিরই পরিচায়ক।
আমরা কিন্তু ইয়াহিয়া খানের এই ভাষণে বিন্দুমাত্র আশ্চৰ্য্য বােধ করি নাই। আমরা এই রকম একটা কিছুরই প্রতীক্ষা করিতেছিলাম। ন্যায় নীতি, গণতন্ত্র ও ধমর্কে কবরচাপা দিয়া বাংলাদেশকে গােরস্থানে পরিণত করিয়া উপনিবেশবাদের নির্লজ্জ দালাল ইয়াহিয়া ঘােষণা করিয়াছেন তিনি নিজেই বিশেষজ্ঞ দিয়া সংবিধান তৈরী করাইবেন—যার মূল আদর্শ হইবে ইসলাম। পাইকারী হারে নরহত্যা করিয়া, বাঙালী নারীর ইজ্জত আব্রু কলংকিত করিয়া, ঘরবাড়ী জ্বালাইয়া ধ্বংস করিয়া লুঠতরাজের মাধ্যমে সন্ত্রাসের রাজস্ব কায়েম করিয়া ইয়াহিয়া বহুপূর্বেই ইসলামের সমাধি রচনা করিয়াছেন—তাই বলা বাহুল্য, তার তথাকথিত ইসলাম মেড ইন পিণ্ডির নামাবলী ধারণ করিয়া বাংলাদেশ ও বিশ্ববাসীকে ধােকা দিতে ব্যর্থ হইয়াছে। ধর্মপরায়ণ বাঙালী জনগণ ইয়াহিয়ার এই ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব দিবার জন্য কাতারবদ্ধ হইয়াছেন—ইয়াহিয়ার ফোপরদালালি কিম্বা টপকা মাতব্বরি বরদাশত করিবার মতাে মানসিক অবস্থা বাঙালীর নাই। গায়ে মানে না আপনি মােড়ল সাজিয়া ধর্মের নামাবলী গায়ে দিয়া বিড়াল তপস্বী হওয়া যতখানি সহজ বাঙালীর উপর ঔপনিবেশিক শােষণের ষ্টীম রােলার অপ্রতিহতভাবে চালাইয়া যাওয়া ঠিক ততখানি সহজ নয় তাহা বুঝিবার ইচ্ছা ইয়াহিয়া খানের না থাকিলেও শেষ পর্যন্ত তাহাকে বুঝিতেই হইবে।
বাঙালী জনগণ ইয়াহিয়া খানকে ক্ষমা করে নাই, করিতে পারে না। গত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে অমান্য করিয়া আওয়ামী লীগকে বাজেয়াপ্ত করিয়া প্রকারান্তরে সমস্ত বাংলাদেশটাকেই ইয়াহিয়া খান যেদিন ডাণ্ডার গুতায় ‘বাজেয়াপ্ত করিয়া দিলেন সেই দিনের অপরাধই বাঙালী ক্ষমা করে নাই। এই ঘটনার পরে পদ্মা, মেঘনা যমুনার জলপ্রবাহের সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মাতার অশ্রুধারা; বিধবার দীর্ঘশ্বাস মিলিয়া একাকার হইয়া গিয়াছে। আজ মায়ের চোখের অশ্রুধারা শুকাইয়া জ্বলিয়া উঠিয়াছে রােষবহ্নি, বীরের রক্তে জজ্বিলিতেছে আগুন। আজ বাঙালীর কথা কহিবার শুনিবার অবসর নাই। ইয়াহিয়ার হাস্যকর উক্তি শুনিয়া তাহা নিয়া মাথা ঘামাইবার মত লােকও বাংলাদেশে আজ খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। সংবিধান, ক্ষমতা হস্তান্তর, নির্বাচন, ইসলাম ইত্যাদি ফাঁকা বুলির অন্তরালে যে শয়তান ওৎ পাতিয়া বসিয়া অস্ত্র শান দিতেছে সে শয়তানের প্রকৃত রূপ বাঙালীর অজানা নয়। দ্বি-জাতি তত্ত্বের সেই প্রাচীন মতবাদ বঙ্গোপসাগরের প্রমত্ত প্রবাহে মিশিয়া গিয়াছে—আজ বাঙালী কেন ইয়াহিয়াও জানেন—বাঙালীর সামনে স্বাধীনতা ব্যতীত কোন বিকল্প পন্থা নাই। সংবিধান, গণতন্ত্র, ধৰ্ম্ম বাঙালী নিজ হাতেই নিজের দেশ প্রতিষ্ঠা করিবে; ইয়াহিয়া খান নহেন। তাই আজ তার এই ঘােষণা বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামকে নস্যাৎ করিতে পারিবে না। বরং এই ভাষণ বাঙালীকে আরাে রক্ত দিতে আরাে ত্যাগ স্বীকার করিতে এবং যে কোন মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করিয়া ইয়াহিয়ার ঔপনিবেশিক শােষণের অবসান ঘটাইতে দৃঢ়তর সংকল্প গ্রহণের শিক্ষা দিয়াছে।।
সূত্র: দৃষ্টিপাত, ৩০ জুন ১৯৭১