সম্পাদকীয়: দিক-দর্শন
– শ্রীদর্শক
পাকিস্তানী এজেন্ট এবং আমাদের নিরাপত্তা | এতদিন ধরে যা আশংকা করা হচ্ছিল, তা সত্য প্রমাণিত হল। ভাঙ্গা চরগােলার মধ্যখানে লামাজোয়ার গ্রামের কাছে আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ রেল লাইন এবং মটর রাস্তায় মাইন বিস্ফোরণ ঘটল, যার ফলে মাল গাড়ী লাইনচ্যুত হওয়া এবং একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়ী ধ্বংস হওয়া ছাড়া সাতজন নিরাপরাধ ব্যক্তি আহত হয়েছেন। মেরামতের জন্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকল দু’দিন।
মুখ্যমন্ত্রী তার সাম্প্রতিক সফরকালে বলেছেন যে, এ ধরণের দুর্ঘটনা জনসাধারণের সক্রিয় সহযােগিতা ছাড়া প্রতিরােধ করা সম্ভব নয়। সাধারণভাবে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু আলােচ্য ঘটনা সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্যাদি পাওয়া যাচ্ছে, তাতে স্থানীয় আইন শৃঙ্খলার রক্ষকদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের অক্ষমতার অভিযোেগ সঙ্গতভাবেই উঠেছে। চোরাকারবার এবং অন্যান্য রাষ্ট্র বিরােধী কার্যকলাপের ঘাঁটি এ অঞ্চলে যে বিধ্বংসী কাৰ্য্যকলাপের প্রস্তুতি চলছিল, সে খবর কর্তৃপক্ষ আগেই পেয়েছিলেন বলে আমরা অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য সূত্রে থেকে জেনেছি। এমন কি এখান থেকে এগারােটি তরুণ পাকিস্তানে গেছে ট্রেনিং নিতে, সে খবরও নামধাম সহ কর্তৃপক্ষ জানতেন। এ সম্পর্কে তদন্ত করার দায়িত্ব যাদের উপর দেওয়া হয়েছিল, তারা সে দায়িত্ব আদৌ পালন করেন নি বলে শােনা যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দায়িত্বশীল মহল থেকে এ অভিযােগগুলি করা হয়, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অর্ধ সত্য কৈফিয়ৎ দিয়ে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। এখনও সরকারী ফাইল খুঁজলে আমাদের বক্তব্যের যথার্থ প্রমাণিত হবে। একই প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন সাধারণ মানুষের মনে জাগছে। গােটা সীমান্ত এলাকায় বর্তমান কাফু বলবৎ আছে, আলােচ্য ঘটনার ক্ষেত্রটিও কাফু এলাকার মধ্যেই পড়ে। রাত সাড়ে দশটায়ও ঐ লাইন দিয়ে নিরাপদে যাত্রীবাহী ট্রেন এসেছে, কাজেই মাইন পােতা হয়েছে কাফু সময়সীমার মধ্যেই। এতগুলি (দুটি ফেটেছে, আরাে চারটি উদ্ধার করা হয়েছে) মাইন পুঁততে যে সময় লাগল, তার মধ্যে কোনও কাফু বলবকারী পুলিশ দল কি ঐ রাস্তা অতিক্রম করে নি? অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কাফু জারী করার পর দীর্ঘ দিন চলে গেছে, কিন্তু কাফু কার্যকরী করার কোন ব্যবস্থাই হয় নি। যে জরুরী সরকারী নির্দেশ কাৰ্য্যকারী হয় না, তা জারী করার সার্থকতা কোথায়? বরঞ্চ সাধারণ মানুষের ধারণা, স্বাভাবিক লােক চলাচল অব্যাহত থাকলে দুষ্কৃতকারীরা নিশ্চয়ই নজরে পড়ত। এখন কাফু জারী করে রাস্তা জনমানবশূন্য করে দেওয়া হয়েছে, অথচ পুলিশ পেট্রোলের ব্যবস্থা নেই, এতে শুধু দুষ্কৃতকারীদেরই ফাঁকা ময়দানে চলাফেরার সুবিধা হয়েছে।
আসলে আমাদের সরকারী যন্ত্রের ঢিলেঢালা গড়িমসি ভাবটা বর্তমান সংকটেও কোনরূপ উন্নতি লাভ করে নি। জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে গুরুতর বিষয় নিয়েও সেই রুটিনমাফিক কাজ হচ্ছে, কেউ একটু অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে রাজী নন। পথে ঘাটে মটার শেল পাওয়া বর্তমান নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্ঘটনায় পাঁচ পাঁচটী মৃত্যু পর্যন্ত ঘটল, কিন্তু কারা এর জন্যে দায়ী তা জানা গেল না। সীমান্তে গুপ্তচর সন্দেহে ধরার পর কোন তদন্ত ছাড়াই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
প্রশাসনিক অক্ষমতার সঙ্গে এসে যুক্ত হয়েছে ভােটের রাজনীতি। কোথাও সন্দেহজনক কিছু ঘটলেই একদল লােক এগিয়ে আসবেন তার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়ার জন্যে। গুপ্তচর বৃত্তির অভিযােগ কাউকে ধরা হলেও দেখবেন কোন কোন নেতা এগিয়ে এসেছেন তদ্বিরের জন্যে। নীলামবাজারের গুপ্তচর চক্রের ব্যাপারে তাই ঘটেছে। লামাজোয়ারের ব্যাপারে আরাে প্রভাবশালী রাজনৈতিক হস্তের প্রলেপ পড়বে বলে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে আশংকা করা হচ্ছে। ভােটের কাঙ্গাল ছাড়াও এক ধরণের রাষ্ট্র বিরােধী মনােভাব সম্পন্ন লােকও আমাদের এখানকার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ ক্ষমতাবান, উপরে শক্ত খুঁটি থাকার জন্যে এরা প্রায়ই পুলিশী তদন্তে বাধা সৃষ্টি করেন। সরকার যদি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অক্ষম হন, তবে সাধারণ মানুষকে সহযােগিতার আহ্বান জানিয়ে কোন লাভ হবে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ সরকারকে সহযােগিতা করতে ইচ্ছুক, কিন্তু, সে সাহায্য গ্রহণ করার মত মনােবল এবং দৃঢ়তা সরকারের আছে কি?
সূত্র: যুগশক্তি, ২০ আগস্ট ১৯৭১