মানবাত্মার আর্তনাদ
আজ দু সপ্তাহ হতে চলল বাংলার বুকে ইয়াহিয়া পৈশাচিক নরহত্যার তাণ্ডব ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে। এই নরমেধ যজ্ঞে গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। নারী শিশু কেউ রেহাই পাচ্ছে না। চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, রংপুর, কুষ্টিয়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, সমসেরনগর সবগুলি শহর ও উপশহরগুলিতে দখলদার পশ্চিমী সৈন্যরা দিনের পর দিন বােমাবর্ষণ করে চলেছে।
মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নেই অস্ত্র, বল আছে শুধু লাঠি আর সড়কি। তথাপি এই নিয়েই মুক্তিযােদ্ধারা শহর এবং ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চলে কোণঠাসা করে রেখেছেন দখলদার পশ্চিমী সেনাদের। হানাদার সেনারা সুযােগ বুঝে মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসে সব ছারখার, লােটপাট করে আবার ফিরে যাচ্ছে সেই সুরক্ষিত পকেটে।
ইয়াহিয়া পশ্চিম থেকে হাজার হাজার সৈন্য পাঠাবার নতুন নতুন ফন্দী আঁটছেন। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্তে স্নান করার এ রাক্ষুসী পরিকল্পনা স্ব[স]ত্বেও স্বাধীন বাংলার জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আবাল বৃদ্ধ বনিতার মনােবল এতােটুকুও ভেঙে পড়েনি। এই নারকীয় ও দানবীয় তাণ্ডবের কলঙ্ক যাতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টিগােচর অথবা বােধগম্য না হয় সেজন্য জঙ্গী সরকার নির্লজ্জভাবে সমগ্র পূর্ব বাংলার সংবাদপত্র অফিস ও প্রেসগুলি ধ্বংস করে দিয়েছেন। বৈদেশিক সংবাদদাতাদের নজরবন্দী রেখে বের করে দিয়েছেন দেশ থেকে। আর্ত জনতার সেবায় আগত রেডক্রশের ত্রাণ-বিমানটিকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি পূর্ব বাংলায় লক্ষ লক্ষ নিহত লােকের সৎকার হচ্ছে না। কর্ণফুলি নদীর জল রক্ত রাঙা হয়ে সংখ্যাহীন শব ভেসে চলছে। প্রতিটা শহরের রাজপথগুলিতে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে পড়ে পচছে। তুলে নিতে দেয়া হচ্ছে না।
এত অত্যাচারের পরও অক্ষুন্ন মনােবল নিয়ে মুজিববাহিনী বাংলার সমগ্র গ্রামাঞ্চল দখল করে রয়েছেন। বেশিরভাগ শহরও আজ মুক্তিযােদ্ধাদের কবলে। তথাপি অতর্কিত বােমাবর্ষণ ও আক্রমণে শহরগুলি জনমানবহীন হয়ে পড়েছে। ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র শহরগুলি স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে সরবরাহের অভাবে সমগ্র বাংলায় খাদ্যাভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলে চাউল ভিন্ন কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। টাকা দিয়েও ডাল তেল লবণ কিছুই সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। টাকার মূল্য শূন্যতে দাঁড়িয়েছে। পেট্রোলের গুদামগুলাে হানাদাররা বােমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। ফলে পেট্রোল, কেরােসিন সব ফুরিয়ে গেছে, কিছুই পাওয়া যাচ্ছে।
সূত্র: দৃষ্টিপাত, ৭ এপ্রিল ১৯৭১