You dont have javascript enabled! Please enable it!

নিউক্লিয়াস স্বাধীনতার পক্ষে কর্মী সৃষ্টির লক্ষ্যে’, ‘ছাত্রলীগকে গতিশীল ও সুশৃঙ্খল সংগঠন রূপে গড়ে তুলতে’ ও ‘স্বাধীনতার পথে পরিচালিত করতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে থেকেই একটি আত্মসচেতন কেন্দ্র হিসেবে পিকিং ও মস্কোপন্থী ধারার পাশপাশি ‘তৃতীয় মার্কসীয় ধারা’ হিসেবে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণীকে একত্র করে এদেশে সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য ১৯৬২ সালে একদল সচেতন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন বলে দাবি করা হয়।  আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদী দল’ আর শেখ মুজিব স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত ছিলেন’ বলে ‘সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে এরা স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে আওয়ামী লীগে যােগ দেয় ও দলের সাথে নিজেদের আত্মস্থ করে। এরা বরাবরই ছিল দলের ভেতর একটি সুস্পষ্ট, সচেতন ও স্বাধীন নিউক্লিয়াস।” এটি স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’, ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’, ও ‘বাংলাদেশ বিপ্লবী কেন্দ্র’ নামেও অভিহিত বলে দাবি করা হয়।  বলা হয়, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ -এ তিনজন -এ গােপন সংগঠন সৃষ্টি করেন। আবুল কালাম আজাদ (পরে অধ্যাপক ও প্রাথমিক শিক্ষক নেতা) ও চট্টগ্রামের এম এ মান্নান যথাক্রমে ১৯৬৩ ও ১৯৬৫ সালে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত হন। তবে তারা শেষাবধি সক্রিয় ছিলেন না। আরাে বলা হয়, ১৯৭০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বঙ্গবন্ধুকে নিউক্লিয়াস ও এর রাজনৈতিক শাখা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বি এল এফ) -এর কর্মপদ্ধতি, সাংগঠনিক বিস্তৃতি ও বিস্তারিত কার্যাবলি সম্পর্কে অবহিত করার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপােষহীন হন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুজিবের সুপারিশে শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমেদকে বি এল এফ’র ‘হাইকমান্ডে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৬৮,৬৯,৭০ সালে মহকুমা (বর্তমানে জেলা) পর্যন্ত নিউক্লিয়াসের শাখা বিস্তৃত হয়। প্রতিটি মহকুমায় ৪-৫ জন সদস্য সংগৃহিত হয়। এর সদস্য মূলতঃ ছাত্রলীগ থেকে এবং সমর্থক-শুভানুধ্যায়ী বাইরে থেকে সংগৃহিত হত দাবি করা হয়, ‘১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সবকটি আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন সবকিছুরই মূলে ছিল নিউক্লিয়াস। ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের ফলে পূর্ব ।

১. লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩ নিউক্লিয়াসের শাব্দিক অর্থ মূলধারা অর্থাৎ যাকে ঘিরে অন্যান্য অংশ বিন্যস্ত/সংহত হয়পাকিস্তানে অবাঙালি অধ্যুষিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে নিউক্লিয়াস সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে বিকল্প সমাজ শক্তি হিসেবে ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক ‘ব্রিগেড’ গড়ে তুলে নৈশ প্রহরা, ট্রাফিক-ব্যবস্থা, মেইল-ট্রেন চালু, লঞ্চ-স্টিমার-নৌ বন্দর পরিচালনা, এমসিসি-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা পরিচালনা, থানা পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনকে সহায়তা করা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, শিল্প-কল-কারখানায় শৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি’ যাবতীয় কাজে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে।আরাে দাবি করা হয়, ১২ আগস্ট ১৯৭০ ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় কমিটির এক বর্ধিত সভায় জনৈক স্বপন কুমার চৌধুরীর মাধ্যমে এরা স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং এদের সাথে আলােচনা করেই মুজিব ৭ মার্চের ভাষণদানও অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। ২৫ মার্চের আগেই এরা বিএলএফ।  গড়ে তােলে যুদ্ধকালে যা মুজিব বাহিনী হিসেবে পরিচিতি পায়। অসহযােগকালে এরাস্বাধীনতার ইশতেহার ঘােষণা, পতাকা তৈরি ও উত্তোলন, জাতীয় সঙ্গীত প্রভৃতি নির্ধারণ করে। এক কথায় ১৯৬৫-র পর থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কৌশল নির্ধারণ ও পরিকল্পনার নির্দেশনা নিউক্লিয়াস থেকেই আসতাে।’  মাওলানা ভাসানী, সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন, পূর্ব। পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (হক-তােয়াহা) ও ন্যাপের (ভাসানী) একাংশ এবং শ্রমিককৃষক সমাজবাদী দলের সঙ্গে নিউক্লিয়াস যােগাযােগ রক্ষা করতাে। মরহুম কামরুদ্দিন আহমেদ ও ড. আহমদ শরীফ শুরু থেকেই এদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন বলেও দাবি করা হয়। | ১৯৭৪ সালের জুনে জাসদের জাতীয় কমিটির বর্ধিত সভার পর একটি ক্ষুদ্র সমন্বয় কমিটি গঠন করা হলে ‘নিউক্লিয়াস’ নিজেদেরকে বিলুপ্ত করে উক্ত সমন্বয় কমিটির সাথে একীভূত হয়।এ প্রসঙ্গে ষাটের দশকের গােড়া থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে যুক্ত ও ১৯৬৭-৬৮ সালের সভাপতি ফেরদৌস আহমদ কোরেশী জানান :ছাত্রলীগের ষাটের দশকের তথাকথিত নিউক্লিয়াসের কথা কখনও ঐ দশকে শুনিনি।…

এটা প্রচারিত হয় স্বাধীনতার পরে, জাসদ গঠনের পর থেকে। এটা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় কারাে কারাে অতিরিক্ত অবদান সিরাজুল আলম খান, একুশ শতকে বাঙালি, এম. এন. ও. পাবলিকেশন্স, (প্রা.) লিমিটেড, ঢাকা,২০০০, পৃষ্ঠা ১৪-১৬ (টাকা)। উল্লেখ্য, এর প্রতিষ্ঠাঁদের অন্যতম কাজী আরেফ আহমেদ প্রয়াত। নির্ধারিত সাক্ষাৎ-সূচি অনুযায়ী ১৮ ও ২৩ ডিসেম্বর ২০০৩ নাখালপাড়াস্ত সাংসদ হােস্টেলের ৪২ নং কক্ষে গিয়ে সাক্ষাৎলাভে সমর্থ হলেও ব্যস্ততার অজুহাতে জনাব আবদুর রাজ্জাক এ প্রসঙ্গে কিছু বলার সময় করতে পারেন নি। লরেন্স লিফশুলৎস, অসমাপ্ত বিপ্লব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬৬। প্রসঙ্গক্রমে প্রতিষ্ঠাতাক্রয়ীর অন্যতম। আবদুর রাজ্জাক যেহেতু জাসদের সাথে যুক্ত হননি এবং নিউক্লিয়াসের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধির কোন উল্লেখ পাওয়া যায়নি সেহেতু স্বাধীনতার পর এর অস্থিত্ব ও জাসদে বিলুপ হওয়ার বিষয়টি প্রশ্নের উদ্রেক করে বৈকি।দেখানাের মানসেই এই প্রচারণা, এ প্রচার রাজনৈতিক অসততার পরিচায়ক। ষাটের দশকের অন্যতম ছাত্র নেতা (পরে চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতা) রাশেদ খান মেননের অভিমত হচ্ছে, নিউক্লিয়াস সম্পর্কিত তথ্য পরবর্তীকালের বানানাে কথা, এরকম চক্রের অস্তিত্বের কথা তারা কোন দিনও শােনেননি। | ১৯৬৮-৭০ কালপর্বে প্রতিটি মহকুমায় ছাত্রলীগ থেকে ৪-৫ জন সদস্য সংগ্রহ করে নিউক্লিয়াসের শাখা গঠন সম্পর্কে কিশােরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৬৪) গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৬২/৬৩) ও সহ-সভাপতি (১৯৬৪-৬৫) বর্তমানে সংসদে বিরােধীদলীয় উপনেতা আবদুল হামিদ এডভােকেট এক সাক্ষাৎকারে জানান : গােটা ষাটের দশকে (১৯৬২-৬৯) ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকা কালে কিশােরগঞ্জ বা অন্য কোথাও নিউক্লিয়াস নামে কোন সংগঠনের কথা শুনিনি। ছাত্রলীগের মধ্যে দু’চারজন অপেক্ষাকৃত অগ্রসর চিন্তার সমর্থক থাকলেও নিউক্লিয়াস বা অন্য কোন নামে কোন সংগঠিত রূপের কোন অস্থিত্ব কখনও টের পাইনি। আর সে-সময় আমার জানার বাইরে, কিশােরগঞ্জে ও মহকুমা ছাত্রলীগে কিছু হওয়া বা ঘটা অকল্পনীয় বলা যায়।ষাটের দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় রাজনীতির সাথে জড়িত অপর এক ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান চৌধুরী জানান, ছাত্রলীগে এমন সংগঠিত তথাকথিত নিউক্লিয়াসের কথা আমার জানা ছিলনা।

তবে আজ যারা তা দাবি করেন, সে সময় স্বাধীনতার প্রশ্নে  তাদের ভূমিকা ছিল প্রতিক্রিয়া পন্থি।৩. ড, মােহাম্মদ হাননানকে প্রদত্ত ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর সাক্ষাৎকার। উদ্ধৃত: ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব) পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২৮-২৯ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৩০ ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব) পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২৯। জনাব চৌধুরী আরাে জানাচ্ছেন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘােষণার পর এর প্রচারে কোন জেলায় গেলেই মুজিবকে গ্রেফতার করা হতাে। এর প্রতিবাদে ৮মে (১৯৬৬) পল্টনে ছাত্রলীগ আহুত একটি প্রতিবাদ সভায় ‘জাগো জাগাে-বাঙালি জাগাে’, ‘পিণ্ডি না ঢাকা-ঢাকা-ঢাকা’ স্লোগান দেয়া হলে সিরাজুল আলম খান ও শাহ মােয়াজ্জেম স্লোগানদাতাদের হাত থেকে মাইক কেড়ে নেন এবং এ ধরনের স্লোগান দেয়ার জন্য তাদের ভৎর্সনা করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য, ১৯৬৩ সালে ‘পাকিস্তান মাঠে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে অন্যতম সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ফেরদৌস আহমদ কোরেশী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব উত্থাপনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বিদায়ী সভাপতি শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন তাকে তা পড়ার অনুমতি দেন নি। অধিকন্তু শাহ। মােয়াজ্জেমের সহায়তায় সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শাহ মােয়াজ্জেম ও সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগে এক গ্রুপ হয়ে কাজ করতেন।

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!