You dont have javascript enabled! Please enable it!

সিরাজ শিকদার নিজ দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে চট্টগ্রামের কাছাকাছি একটা এলাকা থেকে মাওপন্থী ‘পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির আত্মগােপনকারী প্রধান নেতা সিরাজুল হক শিকদার ১ জানুয়ারি ১৯৭৫ গ্রেফতার হন। বিশেষ প্রহরায় ঢাকায় এনে তাকে ‘আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হওয়ায় পুলিশকে ‘প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়। পুলিশ। তাকে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের পুলিশ কন্ট্রোলরুমে নিয়ে যায়। পরদিন সাভারের কাছে ‘পালানাের চেষ্টা কালে’ (মতান্তরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষকালে) তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শিকদারের বােন ভাস্কর শামীম জাকারিয়ার মতে, নিহতের বুকে ৬টি গুলির চিহ্ন ছিল। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ভাষণে মুজিব দম্ভোক্তি করে বলেন : আমি ফ্রি স্টাইল দিয়ে দিয়েছিলাম-যার যা ইচ্ছে তারা তা লেখেন, কেউ এই। নামে বাংলাদেশকে ডাকেন, ও নামে বাংলাদেশকে ডাকেন। বাংলাদেশের নাম। পর্যন্ত বলতে যারা লজ্জাবােধ করেন, তাদের অধিকার নাই বাংলার মাটিতে থাকার। কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? তারা বলেছিল, এই সরকারকে অস্ত্র দিয়ে উৎখাত করতে হবে। আপনরা কবে প্রস্তুত হইয়া উৎখাত করবেন? আমার যা শক্তি আছে-সে শক্তি দিয়ে দুই মিনিটের মধ্যে আমি (তাদের) উৎখাত করতে পারি।’ গুজব ছিল, শেখ মণির নেতৃত্বাধীন যুবলীগের উগ্র কর্মীরা পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে শিকদারকে হত্যা করে। নিঃসন্দেহে এটি একটি কাপুরুষােচিত ও মানবাধিকার-বিরােধী কাজ।  ১৯৭২-এর মার্চে স্বাধীনতার প্রথম বার্ষিকীতে শিকদারের অনুসারীরা মুজিববিরােধী পােস্টার দিয়ে ঢাকা শহর হেঁয়ে ফেলে।

বিজয় দিবসেও অনুরূপ করা হবে বলে গােয়েন্দা বিভাগ খবর পায়। শেখ কামাল তা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেন । কামাল তার পরিবার, দল বা সরকার বিরােধী সমালােচনা বা কাজকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা জ্ঞান করতেন। এম এ ওয়াজেদ মিয়া (তার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃষ্ঠা ২০৭) বলেন, “সিরাজ শিকদার গ্রেফতার হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মুজিবের ‘অতিভক্তরা শিকদারের এই আশা পূরণ করতে দেয়নি।১. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪১ জাতীয় সংসদের কার্যবিবরণী, ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩১১৫ ডিসেম্বর ১৯৭২। রাত গভীর হয়ে এলে কামাল তার সঙ্গীদের নিয়ে স্টেনগান আর রাইফেল সহ একটি মাইক্রোবাসে করে শিকদারের খােজে বেরিয়ে পড়ে।

ওদিকে ওপর থেকে নির্দেশিত হয়ে’ সার্জেন্ট কিবরিয়ার নেতৃত্বে একটি পুলিশ-স্কোয়াড একটা টয়ােটা গাড়িতে করে শিকদারের তল্লাশি চালাচ্ছেন। কোনাে দলই অপর দলের কথা জানে না। শিকার খোজের পালায় একে অপরকে দেখতে পেয়ে শিকদার-গ্যাং ভেবে অনুসরণের এক পর্যায়ে মতিঝিলস্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে উভয় দলের গুলি। বিনিময় হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই গলায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাইক্রোবাস থেকে লাফিয়ে পড়েআর গুলি ছুড়ােনা, আমি কামাল’ চিৎকার শুনে গােলাগুলি বন্ধ হয়। ক্ষতস্থান থেকে। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। সামান্যের জন্য শ্বাসনালী রক্ষা পায়। আহত কামালকে দ্রুত পিজি হাসপাতালে ভর্তি করে আতঙ্কিত সার্জেন্ট ডেপুটি কমিশনার আবুল হায়াতের বাসায় পেীছে ঘটনার বিবরণ জানিয়ে বলে, ‘আমরা এক মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। স্বৰ্গকে আমাদের মাথার উপর এনে দাড় করিয়েছি।”আবুল হায়াত কালবিলম্ব না করে সরাসরি মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে ঘটনা অবহিত করেন। নিজ হাতে আইন তুলে নেয়ার জন্য ক্ষুব্ধ হয়ে মুজিব বলেন, ‘তাকে মরতে দাও।’ মুজিবের প্রতিক্রিয়ায় আবুল হায়াত আশ্চর্য হন। সংশ্লিষ্ট পুলিশদের ব্যাপারে কী করা উচিত জিজ্ঞাসার জবাবে মুজিব তাদের কাজে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, তাদের ভয়ের কোনাে কারণ নেই। পুলিশের উপর কোনাে এ্যাকশন নেয়া হয় নি।

 এমনকি দু’দিন পর্যন্ত মুজিব ছেলে কামালকে দেখতে হাসপাতালেও যাননি।কিন্তু পরদিন সারা ঢাকা শহর চাউর হল-ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়ে কামাল। গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সিরাজ শিকদারের মৃত্যু সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে সারা শহরে এ-ও প্রচার হল যে, মুজিবের নির্দেশেই শিকদারকে হত্যা করা হয়েছে। সিরাজের বােন, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার অর্জনকারী ১৯ বছরের যুবতী ভাস্কর শামীম শিকদারও তাই বিশ্বাস করে এবং ‘ভ্রাতৃহন্তা’ মুজিবকে হত্যা করে প্রতিশােধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটি রিভলভার সংগ্রহ করে সুযােগের অপেক্ষায় থাকে এবং একই সাথে সুযােগ সৃষ্টিরও চেষ্টা করে। শামীম বহুবার মুজিবের সাথে সাক্ষাতের আর্জি পেশ করে ব্যর্থ হয়।

তারপর একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে আমন্ত্রণ জানালে মুজিব তা গ্রহণ করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হন। পরে স্মৃতিচারণ করে শামীম জানায়, ‘আমি ভয়ানক বেপরােয়া হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু শত চেষ্টা করেও তাকে আমার গুলির দুরত্বের মধ্যে আনতে পারলাম।’ ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। পরে শামীম জনৈক জাকারিয়া চৌধুরীর প্রেমে পড়ে বিয়ে করে স্বামীর সাথে বিদেশ চলে যায়। ২. অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩২ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪১প্রকাশ্য বা গােপন সকল মাওপন্থী মুজিববিরােধী ছিল। সিরাজ শিকদার হত্যাকাণ্ড তাদের বিরােধিতাকে আরও তীব্র করে। তাদের অধিকাংশই প্রতিবছর শিকদারের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে এবং মুজিব ও তার শাসনের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে। একাত্তরের মার্চে মাওবাদীদের কেউ কেউ (মাহফুজউল্লাহ গং) অসহযােগ আন্দোলনকে ‘অর্থহীন’ ভেবেছেন, কেউ কেউ (মেননগং) অস্ত্র সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত থাকায় অ-যােগদানযােগ্য ভেবেছেন। অন্য অর্থে চীনপন্থী বিপ্লবীরা জনগণের আন্দোলনে অংশ নিতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন (পরে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পাটি) ২ মার্চ ১৯৭১ শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্যে খােলা চিঠিতে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক পাটি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সম্বলিত’… ‘অস্থায়ী সরকার কায়েম…’ করে ‘প্রয়ােজনবােধে এ সরকারের কেন্দ্রীয় দফতর নিরপেক্ষ দেশে স্থানান্তরিত করে… ‘সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন, মুক্ত ও স্বাধীন করে ছয় দফার অর্থনৈতিক দাবিসমূহ বাস্তবায়ন করার প্রস্তাব করে।মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে, আবদুল হক গং মূল শক্র ভারতের বিরুদ্ধে পাকবাহিনীর মিত্র।

হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের খতমের লাইন গ্রহণ করে সশস্ত্র লড়াই করেন। তােয়াহা গং একই সাথে পাকবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়ার লাইন গ্রহণ করলেও পাকসামরিক অফিসারদের সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্রমে প্রবল হয়ে ভারসাম্য সেদিকে হেলে পড়ে। এসময় কোনাে কোনাে চৈনিকদের ‘দুই কুকুরের লড়াই, এর মাঝে আমরা নাই’ মতবাদটি বহুলত বুলির অন্যতম । যাদু মিয়ার গােয়েন্দাগিরি ও অন্তর্ঘাত কার্যক্রম, আনােয়ার জাহিদের ক্যান্টনমেন্টে মুরগি সরবরাহের ঠিকাদারী প্রভৃতি মােটা দাগে বিভ্রান্ত মাওপন্থীদের পাকিস্তান প্রীতির পরিচায়ক। জাতীয় প্রশ্নে এদের কারও কারও অবস্থানকে লরেন্স লিফশুলৎস ভদ্রলােকের ভাষায় দ্বিধান্বিত’ আর নিন্দুকের ভাষায় ‘দালালির সমতুল্য’ বলে অভিহিত করেছেন। সিরাজ শিকদার গং ভারতকে পাকিস্তানের সমতুল্য মূল্যায়ন করে দেশের অভ্যন্তরে থেকে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয়। ৭ জুন ১৯৭১ প্রকাশিত দলের এক প্রচারপত্রে বলা হয় :পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন প্রতিনিয়ত আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী, সকল দেশপ্রেমিক পার্টি ও জনসাধারণের প্রতি ঐ বিদ্ধ হয়ে সঠিক পথে সংগ্রাম পরিচালনা করতে আহ্বান জানায়। বরিশাল জেলার ঝালকাঠির মুক্তিবাহিনী ও আওয়ামী লীগের দেশপ্রেমিকরা এ আহ্বানে সারা দেয়। তাদের অংশগ্রহণ সহ অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের নিয়ে, স্থানীয় ভিত্তিতে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা হয়। ঐক্যবদ্ধ মুক্তিবাহিনী তফসিলী হিন্দুসম্প্রদায় অধ্যুষিত পূর্ববাংলার বৃহত্তম পেয়ারা বাগান, চুরিয়ান, ডুমুরিয়া, ভীমরুলী এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। এই গেরিলা যুদ্ধের রূপ হয় প্রধানত জাতীয় শত্রু খতম করা। অতি অল্প সময়ের৪. লরেন্স লিফলস, অসমাপ্ত বিপ্লব, তাহেরের শেষ কথা, (অনুবাদ মুনীর হােসেন), কর্ণেল তাহের সংসদ, ঢাকা; ১৯৮৮, পৃষ্ঠা ৩৩

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!