বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৬শে আগস্ট, সোমবার, ৯ই ভাদ্র, ১৩৮১
চীন ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি
বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ভৌগলিক কারণে ভারত ও চীনের দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে আমাদের উন্নত ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আবশ্যক। কারো সাথে বৈরীভাব জিইয়ে রাখা বা জাগিয়ে তোলা বাংলাদেশের জন্য বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের পররাষ্ট্র নীতির মৌলিক আদর্শ জোট নিরপেক্ষতা। সামন্তবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদ এর বিরুদ্ধে লড়াই গুলিকে সমর্থন দান ও স্বাধীন সমতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার জন্য কাজ করা। এগুলো ঘোষিত নীতি। এবং এই নীতির অধীনেই আমরা ভারতের সাথে মৈত্রী ও সহযোগিতার একটি ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তি করেছি। অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন এবং বলেছেন এই চুক্তি চীনের বিরুদ্ধে। বস্তুতঃ এ ধরনের চুক্তি কারো বিরুদ্ধেই নয়। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সব প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বপক্ষে। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু করতে গেলে তা চীনের বিপক্ষে যাবে এমনটা ভাবা আত্ম প্রবঞ্চনারই সামিল। সম্প্রতি আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ বাগদাদে চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৭ মিনিটে একটি বৈঠকে বসেছিলেন। এ বৈঠকটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বিরোধিতা করেছে। স্বাধীনভাবে চীনাপন্থী বলে যারা পরিচিত তাদের কেউ কেউ এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সংশয় ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু এই দুটি কারণেই আমরা গণচীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন থেকে বিরত থাকতে পারিনা। ঢাকায় একটি ধারণা রয়েছে, বাংলাদেশ চীনের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুললে ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়ন অসন্তুষ্ট হতে পারে। এ ধরনের ধারণার কোন ভিত্তি নেই। ভারত নিজেও চীনের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী এমন কথা ওখানকার নেতারা বারবার বলছেন। উত্তর ভিয়েতনাম, দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকার এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য প্রগতিশীল সরকার গুলি বরাবর চীন ও রাশিয়ার সাথে সমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত রেখেছেন। এর জন্য কারো পক্ষেই রুষ্ট হবার কোন কারণ ঘটেনি। উত্তর ভিয়েতনামের গণ সরকার চীনের সাথে প্রগতি প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন বলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে সাহায্য দান থেকে বিরত হননি। হওয়ার কারণও নেই। জাতীয় সরকার গুলি স্বদেশের কল্যাণে, তার নিজস্ব প্রয়োজনে বন্ধু খুঁজবেন। তাদের সকল বন্ধুদেশকেই যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা অপর বন্ধু দেশগুলোর মিত্র হতে হবে এমনটা তারা আশা করেন না। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নীতির মূল শক্তি এখানেই। জাতীয় সার্বভৌমত্বের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে প্রণীত এই নীতির বিজয় ঐ বাস্তবতাকে গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। তাই স্থানীয়ভাবে যারা মনে করেন বা প্রচার করেন চীনের সাথে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠলে ভারত বা সোভিয়েত ইউনিয়ন অসন্তুষ্ট হবেন তারা ভুল করছেন অথবা বিভ্রান্ত করতে চাইছেন।
বস্তুতঃ ভারতের আণবিক বিস্ফোরণের পর উপমহাদেশে উন্নয়নশীল দেশগুলির মর্যাদা ও ক্ষমতা দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। যে কারিগরি ও প্রযুক্তি বিদ্যার উপর পৃথিবীর ধনবানদের এতদিন একচেটিয়া দখল ছিল ভারত তা আত্মস্থ করার ফলে এবং তার সফল প্রয়োগের মাধ্যমে এ কথাটি প্রমাণ করল যে, ওই ব্যয়সাধ্য বিদ্যাটি এখন আর পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর একচেটিয়া রাজত্ব নয়। ইন্দোচীন এর রণাঙ্গন থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের চুক্তিতে স্বাক্ষর দানের মাধ্যমে আমেরিকার এশীয় নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। এশিয়ার মূল ভূখণ্ডে (Main land) সৈন্য রাখার কাজটি সহজ নয় বাস্তব বুদ্ধি ও এর শিক্ষা তারা পেয়েছে। সুতরাং সৈন্য নামিয়ে দখল রাখার বদবুদ্ধি তার উড়ে যাবারই কথা। বাধ্য হয়েই তাঁকে ‘এয়ার কভার’ বা ‘এয়ার স্ট্রাইকিং ফোর্স’ গড়তে হবে অথবা আকাশ পাহারাদাড়দের ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। হচ্ছেও তাই। এশিয়ার পানিতে ঘাঁটি নির্মাণের নতুন কর্মসূচি এই কূটবুদ্ধি থেকেই। এতে করে তাবেদার সরকারগুলিও অভাবে আর পাহারাদারদের কাজটিও চলবে। আনবিক প্রযুক্তি বিদ্যার উপর ভারতের দখল এবং চীনের ‘এটমিক পাওয়ার’ এক্ষেত্রে দুটি শক্তিশালী নিউট্রালাইজিং ফোর্স (Neatralising force)। এই দুই দেশের প্রায় মাঝামাঝি বাস করে এবং ভারত মহাসাগরের উপকণ্ঠে অবস্থান করে ভৌগলিক দিক দিয়ে আমরা এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করব কিভাবে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় শুধুমাত্র চীন বিরোধিতা করেনি। আমেরিকা বিরোধিতা করেছিল। বিরোধিতা করেছিল সৌদি আরব, ইরান ও আরো অনেকে। পাকিস্তানের সাথে হয়েছিল যুদ্ধ। তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি। আর চীনের কথা উঠলেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অজুহাত। নিরপেক্ষতার নজির হিসাবে এটা কোন ক্রমেই আদর্শ আচরণ নয়। আমরা আগেই বলেছি, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ যে সকল দেশ বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু হিসেবে দুঃসময়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের সাথে আমাদের বন্ধন ও সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে হবে। কেতাবি ও বাগাড়ম্বরের পরিবর্তে সত্যিকারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যাতে করে পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতে পারে তার জন্য যত্নশীল হতে হবে। পাশাপাশি যে সকল দেশ বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তাদের নিজেদের পুরাতন নীতির ভ্রান্তি কাটিয়ে আমাদের সাথে সম্পর্ক করতে আগ্রহী তাদের আমরা দূরে ঠেলে দেবো কেন?
বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য আগামী মাসের শেষের দিকে নিউইয়র্কে যাচ্ছেন। বিশ্ব সভায় তিনি ভাষণ দেবেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপুঞ্জে প্রবেশের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অধিবেশন গ্রহণ করবে। আমরা জাতিসংঘের সভ্য হতে চলেছি। আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে এটি একটি মাইলস্টোন। চীন এবার আর নিরাপত্তা পরিষদে আমাদের বিরোধিতা করেনি। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে চীনের নেতাদের এ পর্যন্ত যে সকল মন্তব্য পাওয়া গেছে সেগুলিও তুচ্ছ নয়। কেবল টাকার পেছনে ছুটে ছুটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল আদর্শ কুয়াশাচ্ছন্ন করার পরিবর্তে আমরা এখন নতুন বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো এটাই সকলের কাম্য। মনে রাখা দরকার ‘কারো সাথে বৈরী নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ এটাই আমাদের বৈদেশিক নীতির মূল আদর্শ।
পর্যাপ্ত টেস্ট রিলিফের ব্যবস্থা চাই
‘দীর্ঘদিন স্থায়ী এবারের বন্যায় লাখ লাখ কৃষি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। যেসব বন্যাকবলিত এলাকা থেকে পানি সরে যেতে শুরু করেছে সেখানে চাষিরা আবার শুরু করায় বেকার কৃষি শ্রমিকের একাংশ পুনরায় কাজ পেলেও অবশিষ্টদের অবিলম্বে টেস্ট রিলিফ বা অন্যান্য কাজে নিয়োগ করা দরকার।’ পত্রিকান্তরে পরিবেশিত গতকালকের এক রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে। কত জেলায় কত লোক এইভাবে বেকার রয়েছে প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই, তবে গত ১৭ই আগস্ট আহুত সাংবাদিক সম্মেলনে খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব আব্দুল মমিন এ সম্পর্কে যে তথ্য পরিবেশন করেছেন তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সাম্প্রতিক বন্যায় শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ লোক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। আগামী ডিসেম্বরে আমন ধান উঠা পর্যন্ত তাদেরকে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সিলেট, ময়মনসিংহ ও কুমিল্লার হাওর এলাকায় আগামী বছরের এপ্রিলে বোরো ফসল উঠা পর্যন্ত আরো ৩০ লাখ লোককে খাদ্যের যোগান দিতে হবে।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রায় ১ কোটি লোক যাদের চাল-চুলো কিছুই নেই, বন্যা সর্বশান্ত করে দিয়েছে, তাদেরকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ ৪ মাসের অধিক সময় খাবার সরবরাহ করতে হবে এবং হাওর এলাকার আরো ৩০ লাখ মানুষকে এপ্রিল পর্যন্ত অর্থাৎ এখন থেকে আগামী ৮ মাসাদিককাল খাবার জোগান দিতে হবে। বলাবাহুল্য, দুর্গত এই বিপুল জনসংখ্যার খুব অল্প লোকই পানি সরে গেলে পুনরায় কাজ পাবে। তাহলে এতগুলো লোককে এই দীর্ঘদিন ধরে সরকারি রিলিফের উপর নির্ভর করতে হবে। দুর্গত মানুষ সময় মত দু’মুঠো খাবার খেয়ে জঠর জ্বালা নিবৃত্ত করুক আমরা বিভিন্ন সময়ে এ কথা বলে এসেছি। তবে কোন লোকই বসে বসে চাল-গম লাভ করতে চায় না এবং এ ধরনের কাজকে সরকারো প্রশ্রয় দেবেন না বলে আমরা আশা করি।
সাম্প্রতিক বন্যায় দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু, বাঁধ, বাসগৃহ এবং শিক্ষায়তন ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এগুলোর মেরামত অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন এবং আজ হোক বা কাল হোক সরকারকেই এগুলোর মেরামতের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতে হবে। সুতরাং যারা আজ রিলিফ প্রত্যাশী তাদেরকে বিনামূল্যে রিলিফ প্রদান না করে অবিলম্বে দেশকে পুনর্গঠনের মহান ব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে টেস্ট রিলিফ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এতে করে বিশাল জনশক্তিকে কাজে লাগানো হবে এবং পরনির্ভরশীলতাকেও প্রশ্রয় দেওয়া হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক