মাওলানা ভাসানী ধারণা করা হয়, মাওলানা ভাসানী কারাগারে আটক থাকাকালে আইয়ুব খানের সাথে এক গােপন সমঝতায় পৌছেন। আইয়ুব খানের প্রতি নমনীয় মনােভাব এবং তার অনুসারী কয়েকজনের ওপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার হওয়াই এরূপ ধারণার ভিত্তি। এ প্রসঙ্গে অলি আহাদ বলেন :১৯৬৩ সালে আইয়ুব খান ও মাওলানা ভাসানীর মধ্যে এক গােপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকের পর থেকে মাওলানা প্রকৃতপক্ষে সরকারবিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণে তীব্র অনীহা প্রকাশ করতেন এবং বিরত থাকতেন। কালক্রমে এই প্রবণতাই ন্যাপ (ভাসানী) আইয়ুব খানের গদি রক্ষার সহায়ক শক্তিতে পরিণত করে। ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যখন প্রবল ছাত্র আন্দোলন ও বিস্ফোরণােন্মুখ পরিস্থিতি তখন মাওলানা ভাসানী আইয়ুব কর্তৃক মনােনীত হয়ে সরকারি দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে অক্টোবর বিপ্লব বার্ষিকী উপলক্ষে চীন সফর করেন। চীন কমিউনিস্ট’ দেশ হলেও ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পর শত্রুর শত্রু বন্ধু সমীকরণে পাকিস্তানের সাথে তার নতুন সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। এ সময় মােল্লাদের একাংশও হঠাৎ করে স্মরণ করেন যে, মহানবী (দ.) জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন যাওয়ার কথা বলেছিলেন। হুজুগে বাঙ্গাল, হেকমতি চীনা’ প্রবাদকে প্রমাণ করতেই যেন ‘আন্তর্জাতিক দায়িত্ব হিসেবে বন্ধুদেশের নেতাকে এমন ‘অতিপ্রমুখ’ সমাদর করা হয় যে, ভাসানী একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েন। অতঃপর মাও সেতুং তাকে বলেন :আপনি আমাদের বন্ধু এবং বর্তমান সময়ে যদি আপনি আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে। আপনার সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন তবে তা কেবল রাশিয়া, আমেরিকা ও ভারতের হাতই শক্তিশালী করবে। আপনার কাজে হস্তক্ষেপ করা আমাদের নীতি-বিরুদ্ধ, তথাপি আমরা আপনাকে ধীরে ও সতর্কতার সাথে অথসর হতে উপদেশ দেই।
আপনার সরকারের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব গভীর হওয়ার সুযােগ দেন। ১২ অক্টোবর ১৯৫৭ তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৬২ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি পান। অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫, ঢাকা, পৃষ্ঠা ৩৬৬। উল্লেখ্য, আইয়ুব খানের আমন্ত্রনে তিনি মার্চ ১৯৬৩ রাওয়ালপিন্ডিতে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাত করেন। Tariq Ali, Pakistan Military Rule or Peoples Power, William Morrow and Company Inc, New York, 1970, Page 150. উদ্ধৃত ; ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, (দ্বিতীয় খণ্ড) ওয়ার্সী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৮৭, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪০বলা বাহুল্য, লাল চীনের সাথে শাদা-সবুজ পাকিস্তানের এই বন্ধুত্ব গভীর করার সুযােগ করে দেয়ার জন্যেই মাওলানার ‘don’t disturb Ayub’ উক্তি বিখ্যাত হয়ে আছে। তবে, আইয়ুব আমলে কয়েকমাস মাওলানাকে গৃহবন্দি করে রাখা হলেও এজন্য তাকে মােট ৯ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল বলে তৎকালীন আইনমন্ত্রী বিচারপতি ইব্রাহিম যে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন, তা-ও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে তথ্যাভিজ্ঞমহল মনে করে। চীনা নেতাদের উপদেশে মাওলানা ভাসানী হয়ে পড়েন আইয়ুবের অনুগত। ফলে আইয়ুবের ‘মৌলিক গণতন্ত্র মাওলানার অনুসারীদের কাছে গণতন্ত্রের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে প্রতিভাত হয়। এরশাদের ‘ঝাড়ুদার মন্ত্রী আনােয়ার জাহিদ তাে পাকিস্তানে আইয়ুব আর ভাসানী এই দুই জন ছাড়া অন্য কোনাে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কণ্ঠস্বরই শুনতে পাননি। ডাকসাইটে এইসব অনুসারীরা কালে কালে যে সামরিক বেসামরিক সৈরাচারের সেবাদাস হয়েছেতার শেকড়ও এখানেই প্রােথিত। মাওলানা ভাসানীর এই নীতি আইয়ুবের উন্নয়নের দশক জুড়েই কার্যকর ছিল। তােফায়েল আহমেদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৬৯ সালের শুরুতে ১১ দফা দাবির প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য ছাত্রনেতৃবৃন্দ মাওলানাকে অনুরােধ করলে তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠেয় দলের সম্মেলনে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে এর সমর্থনে বিবৃতি দিতে পারছেন না বলে জানান। লক্ষণীয়, এই সময়কালে (৫ জানুয়ারি ১৯৭১) ন্যাপের ৮২৯ জন নেতাকর্মী মাওলানার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করে দল থেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগীদের অন্যতম হাজী দানেশ তার পদত্যাগপত্রে অভিযোেগ করে বলেন…।আমাদের ব্যর্থতার কারণ হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে আপনার একনায়কত্ববাদী নীতি। ইসলামী সমাজতন্ত্রকে ন্যাপের লক্ষ্য হিসাবে ঘােষণা করার পূর্বে আপনি কখনও দলীয় কাউন্সিল অথবা ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলােচনা করার প্রয়ােজনবােধ করেননি। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা।
ঘােষণার পূর্বেও আপনি দল, দলীয় কাউন্সিল অথবা ওয়ার্কিং কমিটির সঙ্গে আলােচনার প্রয়ােজন বােধ করেননি।… দলের জাতীয় কাউন্সিল নির্বাচনে (১৯৭০) অংশগ্রহণের পক্ষে সিদ্ধান্তগ্রহণ করা সত্ত্বেও কোনাে পূর্ব সিদ্ধান্ত ছাড়াই আপনি নির্বাচন বর্জনের স্লোগান দেন। নির্বাচনেরআবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু, র্যডিক্যাল এশিয়া পাবলিকেশন্স, লন্ডন, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮৭, পৃষ্ঠা ১৯-২০ তারিক আলী, পাকিস্তান : মিলিটরি রুল অর পিপলস পাওয়ার, পূর্বোক্ত (দিল্লি সংস্করণ), পৃষ্ঠা ১৪৩ ২ নভেম্বর ১৯৭০ ঢাকা শহর থেকে মুজিবের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী খাজা খয়ের উদ্দিন নির্বাচনকে পাকিস্তান টিকে থাকবে কি থাকবে না ইস্যুর গণভােট আখ্যা দেন। ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১-এ এসএম সােলায়মান, লে. কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন (আহবায়ক, লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি), মেজর আফসার উদ্দিন, আতাউর রহমান খান, পীর মােহসীন উদ্দিন দুদু মিয়া, শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখদের সমন্বয়ে সন্তোষে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভাসানী লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়নে ফিরে যানমাত্র কয়েকদিন পূর্বে আপনি হঠাৎ বিবৃতি দিয়ে দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানাের নির্দেশ দেন।… ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আপনি ভবিষ্যৎবাণী করেন যে, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না; অথচ তখন ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত ছিল। ১৯৬৮ সালে করাচি থেকে ফিরে এসে আপনি ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন যে, দেশে সামরিক আইন জারি হবে। আপনি বিশ্বাস করতেন যে, ইসকান্দার মির্জা ও আইয়ুব খান দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম করবেন। আইয়ুবের বিরুদ্ধে বামপন্থী শক্তিগুলােকে সংগঠিত করার ব্যাপারে আপনার অনীহা এটাই প্রমাণ করে যে, শশাষকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে আপনার যােগ ছিল।’…এই শশাষকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী শাসকগােষ্ঠীর সাথে থাকা ‘যােগই প্রকৃত প্রস্তাবে মাওলানাকে শুরুতে ১১ দফা সমর্থনে বিরত রাখে। ‘দলের সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অন্তত আইয়ুবী আমলে তিনি দল পরিচালনা করেননি, ওটা ছিল অজুহাত। তাছাড়া ১১ দফাতে অন্তর্ভুক্ত আওয়ামী লীগের ৬ দফাকে তাে তিনি বহুপূর্বেই সিআইএ কর্তৃক প্রণীত বলে খারিজ করে দিয়েছিলেন।
মাওলানা ভাসানী ধর্মীয় ও অতিবাম রাজনীতির এক বিপজ্জনক মিশ্রণ। রেড মাওলানা অব দি ইস্ট’ -এর আচরণ প্রায়শই স্ববিরােধী ও রহস্যময়। ১৯৬৮-৬৯ সালে আইয়ুববিরােধী আন্দোলন যতই দানা বাঁধতে থাকে মাওলানার আচরণে স্ববিরােধিতাও ততই বাড়তে থাকে।২ জানুয়ারি ১৯৬৫ অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুব খান নাজায়েজ নারীপ্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ থেকে মাত্র ২,৫৭৮টি (মৌলিক গণতন্ত্রীর) ভােট বেশি পান। সকল সুযােগ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের পরও এই ফলাফল আইয়ুবের জনসমর্থনহীনতার পরিচায়ক। সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধাবসানে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আইয়ুব কর্তৃক পাকিস্তানকে হেয় করার শামিল গণ্য করে। ফলে উভয় অংশেই তার সমর্থন হ্রাস পায়। ১৯৬৭ সালের শেষদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র উদঘাটিত হয়। ১৯৬৮ সালের ২০ জুন ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ১৩ ডিসেম্বর সাক্ষ্যদান সমাপ্তির তারিখ নির্ধারিত হয়। ২৭ অক্টোবরে আইয়ুবের ক্ষমতা দখলের ১০ বছর পূর্তিতে উন্নয়নের এক দশক’ ‘তামাশার আয়ােজন বাঙালির জন্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটারূপ প্রতিক্রিয়া হয়। নভেম্বর থেকে আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দল আন্দোলন গড়ে তােলার চেষ্টা করে। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষ্য সমাপ্তির দিনে) সকল বিরােধীদল মিলে জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করে।| পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মাওলানাও আন্দোলনের মাঠে নামেন এবং ১৩-র পূর্বে ৬ ডিসেম্বর পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই স্বউদ্যোগে জুলুম প্রতিরােধ দিবস আহ্ববান করেন। এদিন”পল্টনে জনসভায় ১২ ডিসেম্বর হরতাল আহ্বান করেন। তদুপরি স্কুটার ড্রাইভারদের অনুরােধে ৭ ডিসেম্বরও হরতাল ডাকেন। নীলক্ষেত এলাকায় পিকেটর’ স্কুটার ড্রাইভারদের দমন করতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ৩ জন নিহত ও অর্ধশতাধিক আহত হয় এবং পাঁচ শতাধিক লােক গ্রেফতার বরণ করেন। এই নির্যাতনের প্রতিবাদে সকল রাজনৈতিকদল পরদিন পুনঃ হরতাল ঘােষণা করে। ৮ ডিসেম্বর মাওলানা তার ১২-র অতিরিক্ত ১১ ডিসেম্বর আবার হরতাল আহ্বান করেন। স্বভাবতই মাওলানার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উত্থাপিত হয় এবং তিনি ‘জ্বালাও পুড়াও’ নেতা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। যাহােক ১৩ ডিসেম্বর দেশব্যাপী জুলুম প্রতিরােধ দিবস হরতালে রূপ নেয়।
আন্দোলনের এই ধারাবাহিকতায় সংগঠিত হয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। | উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে মুজিবসহ সকল রাজবন্দি মুক্তিলাভ করে। এঁদের মুক্তির জন্য মাওলানাও বিভিন্ন সময় দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়ায়, তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায়, মাওলানাও ঈর্ষান্বিত বােধ করতেন। এ সময় মাওলানার মধ্যে আরও একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়-তিনি ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। বদরুদ্দিন উমরের ভাষায় :১৯৬৯ সালের মার্চ মাসের গােড়া থেকেই মাওলানা ভাসানী ইসলামী সমাজতন্ত্রের প্রচারক। প্রায় পনেরাে ষােল বছর পর রাজনীতির ক্ষেত্রে সেই প্রথম তার ইসলাম আমদানী ।… সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে মাওলানার ইসলামী সমাজতন্ত্রের ধ্বনী আকস্মিক হলেও তার আসল উদ্দেশ্য জনগণের গণতান্ত্রিক অগ্রগতিকে রােধ করা।২১ মার্চ ১৯৭০ পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রাকালে ঢাকা বিমানবন্দরে ভাসানী মন্তব্য। করেন :পূর্ববাংলায় হিন্দু বামপন্থী নেতারা তাদের ভক্ত নগণ্য মুসলমান কর্মীদের সাথে নিয়ে ন্যাপ ও কৃষক সমিতিকে ধ্বংস করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। … পূর্ববাংলার জনসংখ্যার শতকরা ৯৯ জনই মুসলমান, কাজেই তাদের এ-ব্যাপারে বিভ্রান্ত করা। সম্ভব নয়।” ভাসানীর এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বদরুদ্দিন উমর বলেন : বামপন্থী নেতাদেরকে হিন্দু হিসাবে আখ্যায়িত করে মাওলানা ভাসানী যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইছেন, তা মূলত মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামীর উদ্দেশ্য থেকে পৃথক নয়, বরং তার পরিপূরক।… রাজনীতিতে ধর্ম টেনে। আনার এর থেকে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে? এই কাজই তাে এতদিন পর্যন্ত এদেশে মুসলিম লীগ ও জামাতে ইসলামী একটানাভাবে করে এসেছে। মাওলানা ভাসানীও -এ কাজে শরিক হয়েছেন।”…আজাদ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৮ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ১২ এপ্রিল ১৯৭০ দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান অবজারভার, ২২ মার্চ ১৯৭০ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ২৯ মার্চ ও ১৯ এপ্রিল ১৯৭০উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান মানুষকে রাজনীতিমুখী করে তালে।
এতদিন রাজনীতি ছিল কতিপয় রাজনীতিকদের বিষয়। এ নিয়ে তারাই ভাবতেন, কর্মসূচি দিতেন। সংশ্লিষ্ট কিছু লােক এসবে যােগ দিত। কিন্তু এখন এমনকি গ্রামের খেয়াঘাট-চায়ের দোকানও রাজনীতির আলােচনায় মুখর। ৬ দফা, ১১ দফা, আগরতলা মামলা, নির্বাচন, মুজিব প্রভৃতি নিয়ে নিত্য তর্ক, যুক্তি, অভিমত শােনা যায়। এ সময় হঠাৎ করে মাওলানা ঘােষণা দিলেন, তিনি আর কৃষক সমাবেশ করবেন না। ১ জুন ১৯৭০ থেকে তিনি গ্রামে গ্রামে চোর-ডাকাত ধরবেন। তিনি আশা করেন, ইয়াহিয়া না হলেও সাহেবজাদা ইয়াকুব খান (পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রধান) একজন পরহেজগার মুসলমান হিসাবে তাকে নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন।বলতে কি, এ-ও এক ‘রাজনীতি’ এবং এর কুফল সম্পর্কে বদরুদ্দিন উমরের ভাষ্য হচ্ছে :এদেশের সামন্ত-বুর্জোয়া শশাষকদের সাথে পরােক্ষভাবে হাত মিলিয়ে মাওলানা ভাসানী চোর-ঘুসখাের ধরার যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন তার স্বরূপ সম্পর্কে আজ গণতান্ত্রিক কর্মীদেরকে সচেতন হতে হবে।”বস্তুত রাজনীতি থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্যই তিনি এসব ফালতু কর্মসূচি দিচ্ছিলেন। তার শুভাকাঙ্ক্ষী ও গণতান্ত্রিক শক্তি এ নিয়ে ব্ৰিত ও শঙ্কিত হলেও দৈনিক পূর্বদেশ’ ‘সংগ্রাম’ প্রভৃতি ডানপন্থী মহল মাওলানাকে সাধুবাদ জানায়।১৪| ‘চোর পালানাের পর মাওলানা আবার তার বুদ্ধি বাড়ার প্রমাণ দিলেন। ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০ সন্তোষে (টাঙ্গাইল) এক কৃষক সমাবেশে তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানি রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তের পরিকল্পনা সংবলিত একটি গােপন সিআইএ রিপাের্ট তিনি পেয়েছেন। এর একটি কপি তিনি ইয়াহিয়ার কাছে। পাঠিয়েছেন, অপর এক কপি জনগণের জ্ঞাতার্থে সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্য মােহাম্মদ তােয়াহাকে (ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক) দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু তােয়াহা তা প্রকাশ করেননি। এই অভিযােগের উত্তরে তােয়াহা জানাচ্ছেন :যখন সন্তোষে মাওলানা সাহেব আমার ওপর দোষ আরােপ করিতেছিলেন, তখন সন্তোষেই ঐ দলিলের কয়েকশত সাইক্লোকরা কপি ছিল, তাকে তা জানানােও হয়, কিন্তু তিনি তা সেখানে বিলি করেন নাই।”১২ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ২৬ এপ্রিল ১৯৭০সাপ্তাহিক গণশক্তি, ১০ মে ১৯৭০ দৈনিক পূর্বদেশ, ২৩ মে ১৯৭০ ও দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ মে ১৯৭০ বাংলাদেশ অবজারভার, ২০ জানুয়ারি ১৯৭০ সাপ্তাহিক গণশক্তি, ৩১ মে ১৯৭০| তােয়াহা যদি তা প্রকাশের দায়িত্ব পালন না করে থাকেন, ভাসানী নিজেই তা করতে পারতেন এবং তার উচিত ছিল এসব তথ্যের সূত্র ও বিবরণ সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে বিভ্রান্তির অবসান ঘটানাে।
তিনি এ-কাজ না করায় জনগণ তার উদ্দেশ্যের সততা সম্পর্কে স্বভাবতই নানা প্রশ্ন তুলে এবং এসব প্রশ্ন তুলেই তখন দলে দলে তার কর্মীরা তাকে ত্যাগ করে।১৯৭০ সালে পাকিস্তান যখন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমনি সময় ১২ নভেম্বর (১১ নভেম্বর রাতের শেষ প্রহরে) পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্রোপকূলাঞ্চলে ঘটে যায় এক প্রলয়ঙ্করি ঘূর্ণিঝড়। এতে ১০ লক্ষাধিক মানুষ নিহত ও তাদের ঘরবাড়ি, পশুপাখি, ফল-ফসল প্রভৃতি যাবতীয় সম্পদহানী হয়। আহতদের উদ্ধার ও ত্রাণকার্য ছিল অপ্রতুল এবং শুরুও হয় দেরিতে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ‘ওরা কেউ আসে নি। পঁয়ষট্টির পাকভারত যুদ্ধের পর প্রদেশবাসী আবারও দেখল শােকে-দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। তাই কাদো দেশবাসী কাঁদো’ বলার পাশাপাশি নিজেরাই ঝাপিয়ে পড়ে ত্রাণকার্যে। এসব অবহেলা, শশাষণ-বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া প্রতিফলিত হয় ক’দিন পরের নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯ -এর মধ্যে ১৬৭টি পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্ধকৃত আসনে জয়লাভ করে-যা সমগ্র পাকিস্তানের ৩১৩টি আসনের তিপ্পান্ন শতাংশের বেশি। নির্বাচনের এই ফলাফল ছিল পাক-সামরিক শাসক ও তাদের গােয়েন্দাবিভাগের হিসেবের বিপরীত। মাওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ভােটের আগে ভাত (স্বায়ত্বশাসন) চান। কিন্তু কোনাে সাড়া পাননি। তার দলের যে অল্পকজন প্রার্থী ছিল তারাও শেষ মুহূর্তে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। নির্বাচনের ফলাফল ঘােষিত হওয়ার পরপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে (৯ ডিসেম্বর) তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন-সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানিদের রায় যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে একটি গণভােট অনুষ্ঠানের দাবি করেন। তিনি বলেন, দুদিন আগে একটি নির্বাচনে জনগণ যে রায় দিল, তা কোনাে ব্যক্তি বা পার্টি কিংবা দফার জয় নয়।
তিনিএ নির্বাচনের রায় ৬ দফা, ১১ দফা ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য জনগণের রায়’ বলে শেখ মুজিবের এই ঘােষণাকে নাকচ করেন।” স্মর্তব্য, নির্বাচনের প্রাক্কালে ৫ নভেম্বর ১৯৭০ রেডিও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে জাতির উদ্দেশে মাওলানা বলেছিলেন :Even if there are thousands of differance among us; all should love Pakistan. … The name of this country is Pakistan, there is no such country anywhere in the world.১৭ দৈনিক পাকিস্তান, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭০স্বাধীনতার দলিল, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৫৭উল্লেখ্য, নির্বাচনী ফলাফলকে অস্বীকার করে পিডিপি নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের ‘আবেগ ও উত্তেজনার পরিবেশে দেশে এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে’ এবং জামাতের নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি’ মন্তব্যের সাথে প্রাচ্যের লাল মাওলানা’র সুর। কী করে একই মূৰ্ছনায় বেজে ওঠে-তা নিশ্চয়ই কৌতুহলােদ্দীপক! ১ মার্চ ১৯৭১ ইয়াহিয়া ‘ভারাক্রান্ত হৃদয়ে জাতীয় পরিষদের (৩ মার্চ অনুষ্ঠেয়) বৈঠক স্তগিত করলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে পথে নেমে আসে। ৭ মার্চ মুজিব ‘অসহযােগ’ কর্মসূচি ঘােষণা করেন। মানুষ মুজিবের ডাকে সাড়া দিয়ে ‘স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। এ সময় ভাসানী ও তার সহযােগীরা কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। মেননের ভাষায় :এ সময় আমরা অস্ত্র সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে এ সময়েই আমরা বিস্ফোরক দ্রব্য ছিনতাই করি। এজন্য অসহযােগ আন্দোলনে আমরা ছিলাম না।”২৫ মার্চের পর পাকবাহিনী মাওলানার সন্তোষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তিনি যমুনায় নৌকায় আশ্রয় নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আসামের গােয়ালপাড়া জেলার শিশুমারীতে আশ্রয় নেন। সেখানে ইন্দিরার মন্ত্রী মঈনুল হকের সাথে বৈঠকের পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন এবং পার্ক স্ট্রিটের কোহিনুর ম্যানসনের পাঁচতলায় একটি ফ্ল্যাটে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে সেখানেই মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের সাথে তার এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কিছুদিন পর পুনঃ আসামের ভাসান চরে যাওয়ার পথে কুচবিহারে পুনডিবাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে সুচিকিৎসার জন্য বিমানযােগে দিল্লি নেয়া হয়। সুস্থ হওয়ার পর ইন্দিরার সাথে এক একান্ত বৈঠকশেষে পূর্ণ বিশ্রামের জন্য তাকে দেরাদুনের শৈত্যাবাসে পাঠানাে হয়। ৩১ মে বাংলাদেশের কোনাে এক স্থানে (মতান্তরে কলকাতায়) অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সকলপ্রকার প্রস্তাব। সরাসরি নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া ছাড়া অন্য কোনােভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না।*
নসরুল্লাহ্ খান ৩ জানুয়ারি ১৯৭০ খ্রি. ৬ দফার জন্য মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ভােটের আগেভাত চাওয়ার জন্য ভাসানীকে হনুমান বলে অভিহিত করেন (সিরাজউদ্দিন আহমেদ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা। ২৬৪) ড. মােহাম্মদ হাননান -এর সাথে রাশেদ খান মেননের সাক্ষাৎকার। উদ্ধৃত :বাংলাদেশের ছাত্র। আন্দোলনের ইতিহাস পূর্বোক্ত, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পৃষ্ঠা ১৬০ মাওলানা ভাসানী যখন বিভাগপূর্ব আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ও আসাম আইনসভার সদস্য ছিলেন, তখন মঈনুল হক মুসলিম লীগের একজন তরুণ নেতা ছিলেন একই ফ্ল্যাটে জোহরা তাজউদ্দিন সন্তানদের নিয়ে বাস করতেন। তাজউদ্দিন স্বয়ং থিয়েটার রােডে (বর্তমান সেক্সপিয়ার সরনি) বাংলাদেশ সরকারের সবিচালয়ে বাস করতেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৬২৪ জুন ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে তিনি। বলেন, একমাত্র পথ পূর্ণ স্বাধীনতা, নাহয় মৃত্যু।”২৪ | ৮ সেপ্টেম্বর তিনি দেরাদুন থেকে কলকাতা আসেন এবং সরকারের উপদেষ্টা কমিটিতে যােগ দেন। এ সময় তিনি আবার আসাম যান এবং সেখান থেকে ফিরে। এসে দেরাদুনের শৈত্যাবাসে ৭ সপ্তাহকাল অবস্থান কালে চীনের মাও সেতুং -এর কাছে বাংলাদেশকে সমর্থন জানানাের জন্য তারবার্তা প্রেরণ করেন। | স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যপর্নের আগের দিন (২১ জানুয়ারি ১৯৭২) আসামের ফকিরগঞ্জের এক জনসভায় মাওলানা বলেন, বাংলাদেশের জনগণ মিসেস গান্ধীর মতাে দয়ালু মহিলা এবং ভারতীয় জনগণের সহানুভূতির কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না : তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ ভারতবর্ষের মতাে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।১২ মার্চ ১৯৭২ ভারতীয়বাহিনী বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যায়। ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী শুভেচ্ছা-সফরে বাংলাদেশে আসেন। এদিন দু-দেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী, সহযােগিতা ও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে ২৪ মার্চ মাওলানা বলেন ‘ভারতই যে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু, স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে ভারত তার প্রমাণ দিয়েছে। আমি তা কখনাে ভুলতে পারি না।’ তিনি চান, দেশের সমস্যাগুলাে সমাধান করতে জনগণ মুজিব সরকারকে দুই-তিন বছর অন্তত সময় দেবে। কিন্তু তিনি নিজেই সময় দিলেন না। মে মাসের শুরুতেই ‘মাওলানা ভাসানী খােলাখুলিভাবে সরকারের ও তার মিত্র দলগুলির সমালােচনা শুরু করেন।
এইটি বােধহয় তার চৈনিক লাইনের প্রতিফলন। তিনি ‘হক কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন। হক কথা ও অপর মাওবাদী হলিডে’ সত্য-মিথ্যা-গুজব সংমিশ্রণে আজগুবি ‘খবর প্রচার করে মানুষকে সরকার এবং ভারত ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। এরা কথায় কথায় সরকারকে ভারতের পুতুল সরকার’ গাল দিয়ে খুব আনন্দ পেতেন। “চির বিদ্রোহী’ মাওলানা ভাসানী ৩ সেপ্টেম্বর২৫ সিরাজউদ্দিন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪০৪স্বাধীনতার পরপর ১১ সদস্যদের জাতীয় মিলিশিয়া কেন্দ্রীয় বাের্ডেরও তিনি সদস্য হন। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে ভারতীয় লােকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়, ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত সরকার মাওলানা ভাসানীকে ভিআইপি হিসাবে গণ্য করেন। তার থাকা-খাওয়া এবং চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয় ভারত সরকার বহন করে। হাত খরচের জন্য তাকে মাসিক দু’ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া হয় এবং শুধুমাত্র তার চিকিৎসার জন্য ৪৭ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। দ্র. Jyoti Sen Gupta, Histroy of Freedom Movemuent in Bangladesh, Naya Prokash Calcutta, 1974, page 461 Press Trust of India report date-line south Salmara, 22 January 1972. To: আবদুল মতিন, জেনভায় বঙ্গবন্ধু, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫ এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৬ কাজী ফজলুর রহমান, আশা ও ভগ্নআশার দিনগুলি, দিনলিপি :১৯৭২-১৯৭৫, প্রথম আলাে, ১৪ জুন ২০০২১৯৭২ ঢাকায় ভূখা মিছিল সংগঠিত করেন। এ উপলক্ষে পল্টন ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় তিনি মানুষ বাঁচানাের জন্য জাতীয় সরকার গঠনের দাবি জানান। তিনি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য অবস্থান করছে দাবি করেন আবার বাংলাদেশ, পশ্চিম বাংলা, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরার সমন্বয়ে ‘রহস্যঘেরা’ বৃহত্তর বঙ্গ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। তার এই ধরনের বক্তব্যে স্বভাবতই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।
পরদিন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমদ এ দাবিকে উদ্ভট ও ভিত্তিহীন। আখ্যায়িত করে দেশে একটিও ভারতীয় সৈন্য থাকলে তা প্রমাণ করার জন্য ভাসানীর প্রতি আহ্বান জানান। তাজউদ্দিন আহমদ এর নিন্দা করে বলেন, জনগণের সৌভ্রাতৃত্ব নষ্ট করার বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র ও পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি পূর্বাপর প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে ভাসানীকে ‘সাম্রাজ্যবাদ ও মাওবাদের ক্রীড়নক’ বলে দাবি করে। ভারতের পশ্চিমবাংলার বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা প্রমােদ দাশগুপ্ত এক বিবৃতিতে মাওলানা ভাসানীর বৃহত্তর বাংলার সাথে তার আন্দোলনের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে খাদ্যের সংকট স্বাভাবিক হলেও ভাসানী একে রাজনীতিকরণ করেন এবং ‘ভারত’কে রাজনীতির উপাদানে পরিণত করে পাকিস্তানি আদলের ভারতবিরােধী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অশুভ সূচনা করেন। ১৫ মে ১৯৭৩ ভাসানী ৩ দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন। ১৬ মে শেখ মুজিব তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তিনি অনশন ভাঙেননি উপরন্তু ২১ মে সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। ঐদিন হরতাল চলাকালে এশীয় শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে নির্মিত ভিয়েতনাম মণ্ডপ বিধ্বস্ত করা হয়। ২২ মে তিনি অনশন ভাঙলেন বটে তবে ২৯ আগস্ট পুনঃ হরতাল আহ্বান করেন। ভাসানী ন্যাপ একটি পুরনাে দল এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে এর ভিত্তি থাকলেও এর রাজনীতি এবং ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মওলানা ভাসানীসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের অসঙ্গতিপূর্ণ ভূমিকার কারণে বেশ আগেই এরা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। স্বাধীন বাংলাদেশে ভাসানী ন্যাপের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১০ ডিসেম্বর ১৯৭২। সম্মেলনে ভাসানীকে চেয়ারম্যান ও কাজী জাফরকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু অব্যাহত কোন্দলের ফলে ৩১ জানুয়ারি ১৯৭৩ নির্বাচিত কমিটি ভেঙে দেয়া হয় এবং ৪ মার্চ যাদুমিয়া পুনঃ সাধারণ সম্পাদক রূপে আবির্ভূত হন। অন্যদিকে ১৫ জুলাই মাওলানা সুধারামী ও রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে তলবী ন্যাপ’ গঠিত হয়।
ইতােমধ্যে ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ মাওলানা ভাসানীভুট্টো লণ্ডন থেকে বিশেষ বাহকের মাধ্যমে একড জনের মতাে চিঠি সন্তোষে মাওলানার নিকট পাঠান। এগুলােতে তিনি মুসলিম বাংলার ব্যাপারে মাওলানার সাহায্য চান এবং বিনিময়ে তিনি ভাসানীর আশা পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি দেন। (জ্যোতি সেন গুপ্ত, হিস্ট্রি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন বাংলাদেন র্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৭৬)। দু’বছর আগে এমন একটি প্রস্তাবকে তিনি সিআইএ-এর প্রস্তাব বলে আখ্যায়িত করে প্রকাশ করতে চেয়েও করেননি বলে ব্যাপক প্রচার রয়েছে। এসব প্রতিক্রিয়া ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ থেকে পর পর কয়েকদিন ‘সংবাদসহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায়। প্রকাশিত হয়।বিক্ষুদ্ধ হয়ে হুকুমতে রাব্বানী পার্টি গঠন করেন। এরপর ক্রমে তিনি নিজেকে রাজনীতিবিদ পরিচিতির ওপর ‘পীর’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করার অধিকার আওয়ামী লীগের নেই। প্রস্তাবিত চার মূলনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি পবিত্র কোরান, সুন্নাহ ও হাদিসকে ভিত্তি করে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার আহ্বান জানান। আবার তিনিই ৭ মার্চ ১৯৭৩ অনুষ্ঠিত। ‘নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশে অবিমিশ্র সমাজতন্ত্র কায়েমের ইঙ্গিতবহ’ বলে মন্তব্য করেন। মুজিবের ভাষায়, মাওলানা ভাসানীকে চেনা দুষ্কর। তাকে খুশি করা আরও কঠিন। মাওলানা ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫ গঠিত বাকশালে যােগ দেননি। তবে (৮ মার্চ) টাঙ্গাইলের কাগমারিতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি মঞ্চে উপবিষ্ট মুজিবকে দোয়া করে বক্তৃতা করেন। আবার মুজিব নিহত হবার পর পর মুজিব সরকারকে হঠানাের জন্য সাহসের তারিফ করে মােশতাককে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি তারবার্তা প্রেরণ করেন। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিদ্রোহী কৃষক জনতার নেতৃত্বদানকারী ফাদার গ্যাপনের সাথে মাওলানা ভাসানীর তুলনা করা চলে। সংগ্রামী। জনগণের নেতৃত্ব দেয়া সত্ত্বেও এরা দুজনই ছিলেন সামাজিক প্রতিক্রিয়াশীল নেতা।৩২১৭। মর্ণিং নিউজ, ঢাকা, ৮ অক্টোবর ১৯৭২ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ ” রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৫ আবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০ আবদুল মতিন, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু পৃষ্ঠা ২২
সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান