You dont have javascript enabled! Please enable it!

জিয়াউর রহমান–১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন

১৯৩৬

জিয়াউর রহমান ১৯৩৬ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বগুড়া জেলার গাবতলী থানার মহিষাভান গ্রামের মনসুর রহমান ছিলেন একজন রসায়নবিদ এবং মা জাহানারা খাতুন একজন গায়িকা।

১৯৫৩

পিতার কর্মস্থল করাচি থেকে ১৯৫২ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন এবং ১৯৫৩ সালে কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে কাকুলে অবস্থিত পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যােগ দেন।

১৯৫৫ সালে তিনি দ্বিতীয় পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কমিশন পান। পরে তাকে ফাস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। পড়াশােনায় তেমন মেধার পরিচয় দিতে না পারলেও ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে তিনি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।

লাহােরের খেমকারান সেক্টরে ফার্স্ট ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিতে তিনি কমান্ডার হিসেবে সাহসিকতার সাথে নেতৃত্ব দেন। শত্রুবাহিনীর একটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করে তার বাহিনী দ্বিতীয় বীরত্ব পদক পায়। কমিশন পাপ্তির ৪ বছর পরই বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে গােয়েন্দা-বিভাগে নিয়ােগ করা হয়।

সেখানে তিনি ১৯৫৯-৬৪ পর্যন্ত ৫ বছর কাজ করেন। তিনি রাইনে অবস্থানরত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথেও তিনমাস কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে তাকে মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষক নিয়ােগ করা হয়।

এ সময় প্রশিক্ষণরত ফারুক ও রশিদের সাথে তার পরিচয় হয়। ইতােমধ্যে তিনি মেজর পদে পদোন্নতি পান এবং ১৯৭০ সালে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড কমান্ডার হিসাবে চট্টগ্রামে বদলি হয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করে তিনি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেন।

তিনি কিছুদিন ১নং সেক্টরের কমান্ডার ও পরে ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যুদ্ধশেষে তাকে বীরােত্তম পদকে ভূষিত করা হয়।

১৯৭২ সালে তিনি কর্নেল, ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার ও শেষদিকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে (২০ আগস্ট) তিনি সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। সাহসিকতা, ব্যক্তিগত সততা ও ভদ্র ব্যবহারের জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন। জনপ্রিয় অফিসার।

এজন্য তার পদোন্নতিও ঘটে অসম্ভব দ্রুতগতিতে। ১৯৭১ সালের মার্চে ‘অসহযােগ’ চলাকালে ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে আলােচনার নামে সময়ক্ষেপনের সুযােগে নানাভাবে সৈন্য, অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে মজুদ করছিল।

১৯ মার্চ ১৯৭১

তাদের পরিকল্পিত অভিযানকে নির্বিঘ্ন করার জন্য তারা বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নেয়। এর প্রখম পদক্ষেপহিসেবে ১৯ মার্চ ১৯৭১ জয়দেবপুরে (গাজীপুর) ।

অবস্থানরত এক ব্যাটালিয়ান বাঙালি সৈন্যকে কর্তৃপক্ষ অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাঙালি সৈন্যরা কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলে ২২ মাইল দূরবর্তী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল পাঞ্জাবি সৈন্য বাঙালিদের নিরস্ত্র করতে সেখানে পৌছে।

এ খবর বিদ্যুৎবেগে পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহে ছড়িয়ে পড়ে এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য শামসুল হকের নেতৃত্বে হাজার হাজার মানুষ বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের পক্ষে রাস্তায় নেমে এসে স্থানে স্থানে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে গােলাগুলি শুরু হয় এবং কমপক্ষে ২০ জন এতে নিহত হয়। এ ঘটনার মধ্যদিয়ে প্রকৃত প্রস্তাবে পাক-বাংলা যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

এমতাবস্থায় খালেদ মােশাররফ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে ২৪ মার্চ জিয়াসহ । তার অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার আগেই পাকিস্তানিদের উপর আঘাত হানার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে জিয়া খালেদকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে মন্তব্য করেন : ঘাবড়ানাের কিছু নেই। ওরা অতদূর যাবে না।

 হাজী গােলাম মাের্শেদের মাধ্যমে মুজিব চট্টগ্রামে মেজর জিয়ার কাছে সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামতে না দেয়ার জন্য একটি নির্দেশ পাঠান।

কিন্তু এ ব্যাপারে জিয়া কোনাে সক্রিয় ভূমিকা পালন না করায় পরবর্তীকালে তার সাথে আর যােগাযােগ করা হয়নি। মেজর রফিকের বরাত দিয়ে অ্যান্থনি ম্যাসকরনহাস জানাচ্ছেন ।

২৬ তারিখে জিয়া চট্টগ্রাম বন্দরে এমভি সােয়াত থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ খালাসের কাজ তদারকি করার জন্য রওয়ানা হয়ে যান। পথিমধ্যে তিনি শুনতে পান যে, পাকিস্তানি হানাদারেরা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কেন্দ্রে আক্রমণ চালিয়ে বহু। নিরস্ত্র বাঙালি সৈন্য হত্যা করেছে।

এই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গেই জিয়া ফিরে আসেন এবং বিদ্রোহে যােগ দেন। তারপরই তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে তিনি পটিয়ায় চলে যান, যেখানে কবি বেলাল তাকে আবিষ্কার করেন। অসহযোেগকালে ৭ মার্চ ১৯৭১ প্রদত্ত ঐতিহাসিক ভাষণে মুজিব বলেন।

প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোেল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা-যা আছে সবকিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তােমরা বন্ধ করে দেবে।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এরূপ ঘােষণার পর এবং ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের পর ২৫,২৬ বা ২৭ মার্চ কোনােরূপ ঘােষণা না দেয়া হলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে কোনাে।

১. ড. মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস (মুক্তিযুদ্ধ পর্ব), পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯। অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩২ আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৮ অ্যান্থনি ম্যাসকরনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৩২ইতর-বিশেষ হত না।

পাক হানাদারবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের পর কার্ফ শিথিলের প্রথম সুযােগেই ঢাকাবাসী ঢাকা ছেড়ে গ্রামাঞ্চল হয়ে ভারতে গমন শুরু করে এবং স্থানে স্থানে দেশবাসী প্রতিরােধ আন্দোলন শুরু করে। দু’সপ্তাহ পর ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র প্রকাশ ও প্রচার করা হয় এবং অস্থায়ী সরকার ঘােষণা করা হয়।

তবে ইতােপূর্বে মুজিব, হান্নান ও বিশেষ করে জিয়ার ঘােষণা জনগণের মনােবল বৃদ্ধি করেছে -এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। ৭ মার্চের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কবি বেলাল মােহাম্মদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বেতারের শব্দ সৈনিকেরা ২৬ মার্চ ১৯৭১ হানাদার সামরিক সরকারের সংবাদ প্রচার বন্ধ করে দেয়।

এবং অপরাহ্নে শহর থেকে দূরে কালুরঘাট থেকে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেন। সেখান থেকে বেলা আড়াইটায় এমএ হান্নানের কণ্ঠে। মুজিবের স্বাধীনতা ঘােষণা সম্প্রচার করা হয়।

পরদিন ২৭ মার্চ শহর থেকে ১৬ মাইল দূরে পটিয়ায় অবস্থানরত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের অধিনায়ক মেজর জিয়াকে বেলাল মােহাম্মদ। ও তার বন্ধুরা বেতার কেন্দ্রটির নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণের অনুরােধ জানালে সাথে সাথে তিনি রাজি হয়ে ৩ ট্রাক সৈন্য নিয়ে বিকালে কালুরঘাটে আসেন এবং বেতার কেন্দ্রের চারদিকে তাদের মােতায়েন করেন।

সন্ধ্যায় নিতান্ত কৌতূহলবশে বেলাল মােহাম্মদের অনুরােধে জিয়া স্বকণ্ঠে নিম্নোক্ত ঘােষণা দেন : I Major Zia, Provisional Commander in Chief of the Bangladesh Liberation Army hereby proclaim on behalf of our great leader the Supreme Commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, the indeperndence of Bangladesh.

এভাবেই ২৭ মার্চের ঘােষণার মাধ্যমে জিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে তার স্থান করে নেন। অথচ ২৬ মার্চ পর্যন্ত এটিকে একটি রাজনৈতিক এবং বেসামরিক ব্যাপার বিবেচনায় জিয়া বাংলাদেশ-আন্দোলনে নিজেকে জড়াতে চাননি।

চট্টগ্রামে প্রতিরােধ যুদ্ধে জিয়ার সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তিনি রামগড়ে অবস্থান নেন। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিএসএফ -এর ব্রিগেডিয়ার পান্ডের তথ্য ও অনুরােধ অনুযায়ী তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টার থেকে চতুর্থ ও দ্বিতীয় বেঙ্গলের দুটো শক্তিশালী কোম্পানিকে জিয়ার সাহায্যার্থে রামগড়ে পাঠানাে হয়।

পরের সপ্তাহে তেলিয়াপাড়ায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে জিয়া রামগড় থেকে এসে যােগদান করেন।৫. দু’দিন পর ‘বিপ্লবী’ শব্দটি পরিহার করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামকরণ করা হয়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গ্রেফতারের কিছুক্ষণ আগে তিনি স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান করেন সিরাজউদদীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৪৬ অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩১ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার জেল হত্যাকাণ্ড গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ৭) বলেন যে, ৪ এপ্রিল ১৯৭১ সামরিক অধিনায়কগণ তেলিয়াপাড়ায় মিলিত হয়ে ওসমানীকে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন।

শফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে যথাক্রমে এস, জেড ও কে নামে তিনটি ফোর্স গঠন করা হয়পরে জিয়া গারাে পাহাড়ের পাদদেশে তেলঢালায় এসে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং তৃতীয়, প্রথম ও অষ্টম বেঙ্গল একত্রিত হয়ে ২৫ জুন নাগাদ বাংলাদেশের প্রথম পদাতিক ব্রিগেড হিসেবে ‘জেড ফোর্স’ সংগঠিত হয়। জেড ফোর্স ২৮ জুলাই পর্যন্ত সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ৩১ জুলাই স্বদেশে প্রবেশ করে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত স্বাধীনতার পর ৭ এপ্রিল ১৯৭২ জেনারেল ওসমানী ও জেনারেল আব্দুর রব সামরিকবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ৮ এপ্রিল সম্মিলিত কমান্ড বাতিল করে সেনা, নৌ ও বিমান-এই তিনটি বাহিনী গঠন করা হয়। সেনাবাহিনী প্রধান পদের জন্য শফিউল্লাহ ও জিয়া সমযােগ্যতা সম্পন্ন হলেও বাই-নম্বরে জিয়া সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু ওসমানীর সুপারিশে সফিউল্লাহকে প্রধান করা হয়। সপ্তাহখানেক পর একটি নতুন পদ “ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ’ সৃষ্টি করে ঐ পদে জিয়াকে পােস্টিং দেয়া হয়। প্রধান হতে না পারার ক্ষোভ নিয়েই জিয়া উপ-প্রধানের পদে যােগ দেন। | ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াত জামিলকে মুজিব হত্যার খবর দেয় এবং একই সাথে এর বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা না নেয়ার হুমকি দেয়। এমতাবস্থায় শাফায়াত ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার পথে জিয়ার বাসায় যান। জিয়া তখন শেভ করছিলেন এবং ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে শাফায়াতকে বলেন :So what, President is dead? Viee President is there, Get your troops ready. Uphold the constitution?জেনারেল সফিউল্লাহ জানান : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে আমার কাছে খালেদ মােশাররফ ছুটে আসেন নাইটড্রেসেই, আর জিয়া হাজির হয় ক্লিন শেভ-ধােপদুরন্ত হয়ে।মুজিব হত্যা মামলায় সফিউল্লাহর সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ভােরে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তােলে আর্মার ও আর্টিলারি শহরে রেডিও সেন্টার, গণভবন ও ৩২ নম্বর রােডের (ধানমন্ডি) দিকে যাচ্ছে জানানাে হলে, তিনি শঙ্কিত হয়ে তার ডিএমআই লে. কর্নেল সালাহউদ্দিনের মাধ্যমে শাফায়াত জামিলকে ৩টি পদাতিক ব্যাটালিয়ান দিয়ে ওদের প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। একই সাথে তিনি নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধান এবং সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়া ও চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মােশাররফকে ফোনে ঘটনা জানিয়ে দ্রুত তার বাসায় আসতে বলেন।

১৫২০ মিনিটের মধ্যেই জিয়া ইউনিফরম পরিহিত হয়ে ও খালেদ নাইট-ড্রেসে এসে পৌছান। ইতােপূর্বে প্রেরিত নির্দেশের কোনাে প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে শফিউল্লাহ।১১. কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৮ কর্নেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৩ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৫৭ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৬-৯৭খালেদকে দ্রুত ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে শাফায়াতকে সাহায্য করার নির্দেশ দিলে জিয়া বলেন : Don’t send him, he is going to spoil it’. কিছুক্ষণ পর শফিউল্লাহর অফিসে অবস্থানকালে রেডিওতে মুজিব হত্যার ঘােষণা প্রচারিত হলে জিয়া শফিউল্লাকে বলেন :সিজিএস খালেদ মােশাররফকে আর বাইরে যে দিও না। তাকে বললাে Ops order তৈরি করতে, কারণ ইন্ডিয়ান আর্মি মাইট গেট ইন – ইন দিস প্রিটেক্ট। এ সময় মেজর (অব.) ডালিম ১০-১৫ জন সশস্ত্র সৈন্যসহ অফিসে ঢুকে শফিউল্লাহকে রেডিও স্টেশনে যেতে পীড়াপীড়ি করে। অল্পক্ষণ পরে নৌ ও বিমান প্রধান আসেন। একটি জিপে করে মেজর রশিদ ও মেজর (অব.) ডালিম জেনারেল শফিউল্লাকে এসকর্ট করে রেডিও অফিসে নিয়ে যায়। পেছনে সশস্ত্র আর্মির গাড়িসহ নৌ ও বিমান প্রধানের গাড়ি তাদের অনুসরণ করে। জিয়াও এই বহরের অনুগামী হয়ে। রেডিও স্টেশন ও পরে বঙ্গভবনে যান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৫-২৪ আগস্ট ১৯৭৫ শফিউল্লাহ সেনা প্রধান থাকা পর্যন্ত জিয়া ও তাকে সর্বক্ষণ একসাথে একে অপরের ছায়ার মতাে লেগে থাকতে দেখা যায়। শফিউল্লাহ আরাে জানাচ্ছেন, আলােচনা, সভা প্রভৃতি অজুহাতে তাদেরকে ১৮ আগস্ট সকাল পর্যন্ত বঙ্গভবনে আটকে রাখা হয়। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ১৮ আগস্ট রাতে একটি কনফারেন্স এবং ১৯ আগস্ট ফরমেশন কমান্ডারদের অপর একটি কনফারেন্স ডেকে ‘চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা ও উচ্ছঙ্খল অফিসারদের শাস্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেন।

২২ আগস্ট বঙ্গভবনে গিয়ে একই উদ্দেশ্যে ট্রপস ফিরিয়ে এনে রিপিং -এর প্রস্তাব করলে মােশতাক তাকে অপেক্ষায় থাকতে (wait and see) বলেন। এরপর ২৪ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে একটা নিউজ বুলেটিনে জেনারেল ওসমানীকে প্রেসিডেন্টের ডিফেন্স এ্যাডভাইজার করার ঘােষণা দেওয়ার পরই মােশতাক শফিউল্লাহকে বিকাল সাড়ে পাঁচটায় বঙ্গভবনে যেতে বলেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি বঙ্গভবনে গিয়ে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল খলিলকে সেখান থেকে বের হয়ে আসতে দেখেন। ওসমানী ও মােশতাক উভয়ই তাকে বিদেশে দূতাবাসে নিয়োগের প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মতি না দিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এসে দেখেন, জিয়া ইতােমধ্যে চিফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে অফিসারদের সাথে সভা করছেন। দেশের রাষ্ট্রপতির মৃত্যুসংবাদ শুনে জিয়ার ‘তাতে কী? (so what) বলা, অন্যরা যেখানে শােনামাত্র নৈশ-পােশাকে সেনাপ্রধানের বাসায় হাজির, সেখানে তার ধােপদুরস্ত হয়ে আসা,১৩/১ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, ১১১ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৮-৯৯। শফিউল্লাহ তার সাক্ষ্যে এ-ও জানান যে, কর্নেল তাহের একদিন তার অফিসে এসে তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে জিয়ার জন্য সেনাপ্রধানের পদটা ছেড়ে দিতে বলে। এজন্য তাহেরকে মেডিকেলি অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ফোন পেয়ে ২৪ আগষ্ট ৪টায় বঙ্গভবনে গেলে ওসমানী তাকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ ও জিয়াকে চিফ অব আর্মি স্টাফ ঘােষণা করেন (ড. হাননান, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৯৫-৯৬ ও ২০১)নিরুত্তাপ থাকা, সিজিএস খালেদকে একশান গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে বলা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করা, অযাচিত হয়ে বেতারকেন্দ্র ও বঙ্গভবনে যাওয়া, শফিউল্লাহর সাথে ছায়ার মত লেগে থাকা, ১০ দিনের মধ্যেই প্রেষণে। শফিউল্লাহকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলিজনিত সেনাপ্রধানের শূন্যপদে যােগদান করা প্রভৃতি বিষয় বিশ্লেষণ করলে হত্যাকারে সাথে জিয়ার সংলগ্নতা/বিদিততা প্রতীয়মান ১৯৭৪-এ সেনা-অভিযানে এসে ফারুকগং শাসকদলের নেতৃবৃন্দের সাথে অপরাধীদের সম্পর্ক দেখতে পায় এবং তখনই প্রতিকারের জন্য একটা কিছু করার কথা ভাবে। একপর্যায়ে সবকিছুর জন্য মুজিবকে দায়ী করে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তার বিকল্প হিসেবে জিয়ার কথা ভাবে। ফারুকের ভাষায় : ঐ সময় জেনারেল জিয়ার প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধাবােধ ছিল। আমার ইচ্ছে ছিল, সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাকে দেশের শাসনভার তুলে নেয়ার অনুরােধ জানাবাে।

তবে এ কথা সরাসরি বলা সম্ভব ছিল না বলে দেশের দুর্নীতি, খুন-রাহাজানি প্রভৃতি প্রসঙ্গে আলােচনার একপর্যায়ে দেশে একটা পরিবর্তন প্রয়ােজন এবং সেক্ষেত্রে তার সমর্থন ও নেতৃত্ব কামনার উত্তরে জিয়া বলেন : আমি দুঃখিত। আমি এ ধরনের কাজে নিজেকে জড়াতে চাই না। তােমরা জুনিয়র অফিসাররা যদি একটা কিছু করতে চাও, তাহলে তােমাদের নিজেদেরই তা করা উচিত। আমাকে এসবের মধ্যে টেনে না। তবে রশিদের ধারণা ছিল, শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারলে জিয়াও তাদের সমর্থন করবে। কারণ জিয়া কখনােই তাদের এ-কাজ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেননি। | কানাডা টেলিভিশনের জন্য অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্যাসেট ও ৩০ মে ১৯৭৬ সংখ্যা সানডে টাইমস পত্রিকা লন্ডন থেকে সংগ্রহ। করে আদালতে প্রদর্শন করা হয়। এতে দেখা যায় ফারুক বলছেন :পঁচাত্তরের ২৮ মার্চ জেনারেল জিয়াকে ম্যানেজ করি। সে সময় জিয়ার বক্তব্য ছিল সিনিয়র অফিসারদের পক্ষে সরাসরি কিছু করা সম্ভব নয়। তােমরা জুনিয়ররা করতে চাইলে গাে এ্যাহেড।” উক্ত পত্রিকার ১১ নং পৃষ্ঠায় I halped to kill Mujib, dare you put me on trial শিরােনামে প্রকাশিত স্টেটমেন্টে (যা ঐ ক্যাসেটের সাক্ষাৎকারের অনুরূপ) বলা১৩.  অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের, ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮। ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৭ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০the man who engineered the killing of the ‘father’ of Bangladesh, Sheikh Mujibur Rahman, in August last year, challenges the present resime to put him on trail for murder. The man, Lieutenant Colonl Farook Rahman, accuses the present resime, led by Ceneral Ziaur Rahma of betraying a movement that considered reform so vital that it killed the state’s founding father in an effort to achive it.” এছাড়া কার্যবিধির ১৬৪ ধারামতে আদালতে প্রদত্ত দোষ স্বীকারােক্তিমূলক। জবানবন্দিতে ফারুক বলেন : ‘ আলাপের মাধ্যমে তিনি (জিয়া) আমাকে instegate করে বললেন, দেশ বাঁচানাের জন্য একটা কিছু করা দরকার।’ ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস ফারুকের বলা এসব কথা ।

সম্পর্কে সামনাসামনি জিজ্ঞাসা করলে জিয়া তা স্বীকার বা অস্বীকার না করে জবাবদান থেকে বিরত থাকেন। অ্যান্থনির ভাষায়, ‘আমি পুনরায় জবাব পাওয়ার প্রচেষ্টা চালালে , তিনি আমাকে বহুবছর ধরে বাংলা দেশের বাইরে রাখার ব্যবস্থা করেন। রহস্যময় কারণে জিয়া শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযােগে চাকরিচ্যুত মেজরদের প্রশ্রয়দান করেন। শফিউল্লাহর ভাষায়,খুনিচক্র সবসময়ই পেয়েছে জিয়ার আশ্রয়-প্রশয় ।… সেনা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় মেজর নূরকে চাকরিচ্যুত করেছিলাম, কিন্তু তাকে শেল্টার দেয় জিয়া। পঁচাত্তরের আগস্টের প্রথম থেকেই ডালিম ও নূরকে ক্যান্টনমেন্টে লন-টেনিস। কোর্টের আশেপাশে ঘােরাফিরা করতে ও টেনিস খেলতে দেখা যেতাে। ওরা জুনিয়র ও চাকরিচ্যুত অফিসার হওয়ায় এ ছিল অস্বাভাবিক। ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল হামিদের ‘তােমরা কার অনুমতি নিয়ে এখানে খেলিতে আস’ প্রশ্নের জবাবে মেজর নুর। জানায় যে, তারা জেনারেল জিয়ার অনুমতি নিয়ে খেলতে আসে। শুধু তাই নয়, সেনাপ্রধান হয়েও জিয়া আর্মিতে চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার কোনাে চেষ্টা করেন।নি।| এমন কি মুজিবের হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাসীন মােশতাক-জিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত। সেনাবাহিনী থেকে চাকরি হারানােদের চাকরিই কেবল ফেরত দেননি, রাতারাতি প্রমােশন দিয়ে ওদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল।২০. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২২ ড, মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০৬ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৬ ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০-৬১কার্যবিধির ১৬৪ ধারামতে লে. কর্নেল মহিউদ্দিন (আর্টিলারি) আদালতে তার দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন :… জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর বিদেশে পাঠানাে সকল মেজরদেরকে কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দেন। কিন্তু মেজর রশিদ ও ফারুক চাকরি নিতে অস্বীকার করেন এবং আর্মিতে পুনর্বহাল হওয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।

মেজর রশিদ, মেজর ফারুক ও মেজর ডালিম ১৯৭৬ সনে গােপনে হঠাৎ বাংলাদেশে চলে আসেন এবং মেজর ফারুক সাভার সেনানিবাসে গিয়ে বেঙ্গল কেভালরির কমান্ড হাতে তুলে নেন। বগুড়ায় অবস্থানরত বেঙ্গল কেভালরির অন্য ইউনিটের সৈন্যরাও ফারুক রহমান সেখানে না গেলে তারা মার্চ করিয়া ঢাকা আসিবে বলিয়া হুমকি দিলে ফারুক রহমান বগুড়া চলিয়া যায় এবং সেখানে গিয়ে ল্যান্সার ইউনিটের কমান্ড গ্রহণ করেন। জেনারেল জিয়া ফারুক রহমানকে ঢাকায় ফেরত আনেন। পরে এই অপরাধে এই ইউনিটের অনেক সৈনিককে কোর্ট মাশাল করে বিন্নি মেয়াদের সাজা দেন, এমনকি ইউনিটটিকে নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু মেজর ফারুককে সাজা না দিয়ে বিদেশে প্রেরণ করেন। ইতিমধ্যে মেজর ফারুকের সঙ্গে আগত মেজর রশিদ এবং মেজর ডালিম ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে ২-ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ড ও কন্ট্রোল হাতে নেওয়ার চেষ্টা চালান এবং সৈনিক লাইনে গিয়ে বিদ্রোহ করার উসকানি দিতে থাকেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান তাদের বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ৩/৪ দিন পরে বিদেশে ফেরত পাঠান। ইহাতে আমার মনে হয় যে, ১৫ আগস্টের ঘটনায় জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিল, যার জন্য তিনি ফারুক এবং রশিদের কাছে খুবই দুর্বল ছিলেন।২৮২৮. মুজিব হত্যা মামলার ৬০ নং সাক্ষী রাষ্ট্রদূত আব্দুল্লাহ আল হাসান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি ও সেনা-সদরের চিঠি উপস্থাপন করে বলেন জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসন আমলে ১৯৭৬ সালের ১৬ আগস্ট সেনা-সদরের এই চিঠিতে পঁচাত্তরের আগস্ট হত্যাযজ্ঞের সাথে জড়িত ১২ জন সেনা-অফিসারের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসে পাঠানাের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খুন হওয়ার আগে সাড়ে ৫ বছরের শাসনামলে জিয়ার বিরুদ্ধে ২০টি বিদ্রোহ/অ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৮০ সালের শেষদিকে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসের চাকরিতে পুনর্বাসিত আগস্ট-হত্যাকারীরা গােপনে মিলিত হয়ে জিয়াকে উৎখাতের একটি ষড়যন্ত্র করে। একপর্যায়ে তা ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। ষড়ন্ত্রকারীরা সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে (চাকরি ত্যাগ করে) যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ বা ফেরারি জীবনযাপন করে।

যদিও এজন্য সেনাবাহিনীতে কর্মরত লে. কর্নেল দীদারুল আলম, লে. কর্নেল নুরুন্নবী খান প্রমুখের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু সৌভাগ্যবান’ খুনীরা পরবর্তী এরশাদ আমলে বিনা অনুমতিতে প্রায় তিন বছরের অনুপস্থিতিকালের পুরাে বেতন-ভাতাসহ দ্বিতীয়বার পূনবাসিত হয় এবং ১৯৯৬ সালের জুনে শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বপর্যস্ত বেগম খালেদার আমলেও অনুরূপ ‘জামাই আদর’ লাভ করে। সুতরাং এদের প্রাপ্ত সুযােগ-সুবিধা ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর কৃত জেল হত্যাকাণ্ডেরই পুরস্কার ছিল বলে প্রতীয়মান হয়। ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১৮। রশিদ ফারুক, ডালিমের বাংলাদেশে আগমনের সালটি উক্ত গ্রন্থে মুদ্রণ প্রসাদ বশত ১৯৭১ উল্লিখিত হয়েছে।কার্যবিধির ১৬৪ ধারামতে তাহের উদ্দিন ঠাকুরের দোষ স্বীকারােক্তিমূলক জবানবন্দিতে দেখা যায়, ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দুপুরে সচিবালয়ের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সাক্ষাৎ করতে গেলে ঠাকুরকে মােশতাক বলেন যে : ..এই সপ্তাহে ব্রিগেডিয়ার জিয়া দুইবার এসেছিলেন। সে এবং তাহার লােকেরা তাড়াতাড়ি কিছু একটা করার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছেন। ঠাকুরের জিজ্ঞাসার জবাবে মােশতাক আরাে জানায় : বলপূর্বক ক্ষমতা বদলাইতে চায়। প্রয়ােজনবােধে যে-কোনাে কাজ করতে প্রস্তুত।… আমার ডাকের জন্য অপেক্ষা করাে। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। পরদিন ভােরেই তাদের ক্ষমতা দখলের ডাক এসে যায়। কিন্তু হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ৮১ দিনের মাথায় ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান (রক্ষীবাহিনীর সাবেক প্রধান) ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে একটি স্বল্পস্থায়ী সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হলে জিয়া বন্দী হন এবং ৬ নভেম্বর রাত ১২টায় নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবার’, “সিপাই সিপাই ভাই ভাই-অফিসারদের রক্ত চাই’ প্রভৃতি স্লোগান দিয়ে এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়তে ছুড়তে সিপাইরা খুনী মেজর মহিউদ্দিনের (আটিলারি) নেতৃত্বে মতান্তরে হাবিলদার সারােয়ারের নেতৃত্বে বেঙ্গল ল্যান্সারের একদল সৈন্য জিয়াকে মুক্ত করে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। মুক্ত হয়েই জিয়া জেনারেল খলিলকে ফোন করে বলেন, ‘আমি মুক্ত।

আমি বেশ আছি। আমার জন্য কিছু ভাববেন না। আপনি দয়া করে খবরটা মার্কিন, ব্রিটিশ এবং ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের জানিয়ে দিন (অ্যান্থনি, পূর্বাক্ত-১২১), পরদিন সকালে মিশনগুলােতে রিং করে খলিল জানতে পারেন, ইতােমধ্যে জিয়া তাদের সাথে কথা বলেছেন । ৭ নভেম্বর দুপুরে জিয়া সৈনিক সংস্থার ১২ দফায় স্বাক্ষর করলেও সেনাবাহিনীর বেতন বৃদ্ধি, বাসস্থান, পােশাকের ব্যবস্থা গ্রহণ ও অবমানাকর ‘ব্যাটম্যান’প্রথা বাতিল করার ঘােষণা দান ছাড়া অন্য দাবিগুলাে সম্পর্কে নীরব থাকেন এবং ২৩ নভেম্বর বিপ্লবের’ ‘অভিভাবক’ রব, জলিল, ইনু, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ২০. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২২০ গ্রানাডা টেলিভিশনের জন্য অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাসের কাছে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে রশিদ বলেছিলেন, ‘আগস্টের প্রথম সপ্তাহেই হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে মােশতাকের সাথে কথা হয়।’ (ড, হাননান, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৬০)। মুজিব-হত্যা মামলার ৪৭ নং সাক্ষী মেজর জেনারেল (অব.) খলিলুর রহমান বিডিআর এর। ডাইরেক্টর থাকাকালে (১৯৭৪) সশস্ত্রবাহিনীতে ক্ষুব্ধতা লক্ষ্য করেন। তার ভাষায় ‘তখন। সামরিকবাহিনীর জন্য পৃথক বেতন কমিশন গঠন না করার কারণে সামরিকবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছিল। সামরিক-বেসামরিক যৌথ বেতন কমিশনে সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেন জেনারেল জিয়া। কিন্তু জে, জিয়া এই বিষয়টি কখনও কমিশনে তুলে ধরেন নাই।’ (ড, হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২০০)(তাহেরের বড়ভাই) ও কর্নেল তাহেরকে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে লুকিয়েথাকা অবস্থায়) গ্রেফতার করার মাধ্যমে কার্যত সিপাহী বিপ্লবের সমাপ্তি ঘটান। পরে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ‘বৈধভাবে গঠিত সরকার উৎখাতের প্রচেষ্টা, ও অন্যান্য অভিযােগে তাহেরসহ জাসদ, বিপ্লবী গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ৩৩ জনকে কেন্দ্রীয় কারাগারে বিশেষ ভাবে গঠিত সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। রহস্যজনক তড়িঘড়ির এই বিচারে তাহেরের ফাসি, রবের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডসহ বিভিন্নজনের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি হয়। জিয়াকে বন্দিত্ব থেকে মুক্তকারী। তাহেরই হল তার প্রথম শিকার। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ আরও একটি সিপাহী বিপ্লব/বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। এবার জিয়াকে নায়কের পরিবর্তে বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে তার অপসারণ চাওয়া হয়। কয়েকজন সঙ্গীসহ শহরে একটি গােপন স্থানে আত্মগােপন করে তিনি রক্ষা পান। ২ অক্টোবর বিদ্রোহ থেমে গেলে পরবর্তী দু’মাসের মধ্যে এজন্য ১,১৪৩ জনকে ফাঁসিসহ বহুশত সৈনিককে ১০ বছর থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

কোর্ট মার্শালের প্রচলিত নিয়মও এক্ষেত্রে মানা হয়নি। বিচারকের লাইসেন্স নিয়ে সৈন্যদের হত্যা করা হয়েছিল মাত্র। | ৬ নভেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে (৭ নভেম্বর) অন্তরীণাবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়া। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘােষণা। করেন। উচ্ছলতাপূর্ণ রাত্রির অবসানের পর ৭ নভেম্বর বেলা ১১টায় ২য় ফিল্ড আর্টিলারির সদর-দফতরে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ঠিক করার উদ্দেশ্যে জিয়া একটি সভা ডাকেন। সভায় অন্যান্যদের মধ্যে জেনারেল ওসমানী, জেনারেল খলিল, বিমানবাহিনীর প্রধান তাওয়াব, নৌবাহিনীর প্রধান এমএইচ খান, প্রেসিডেন্টের সচিব মাহবুবুল আলম চাষী, কর্নেল তাহের প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সভায় ওসমানী ও চাষী উত্থাপিত। রাষ্ট্রপতি পদে মােশতাককে পুনর্বহালের প্রস্তাব গ্রহণ না করে সায়েমকে বহাল রাখা। হয়। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ওপরে অন্য কারাে ক্ষমতা থাকা ঠিক নয়’ জেনারেল খলিল ও কর্নেল তাহেরের এই যুক্তি গ্রহণ করে সায়েমকেই সিএমএলএ এবং তিন বাহিনীপ্রধানকে সমমর্যাদার ডিসিএমএলএ করা হয়। বলা বাহুল্য, এ সিদ্ধান্ত জিয়ার পছন্দ হয়নি এবং ২৮ নভেম্বর ১৯৭৬ রাতে এরশাদ, মঞ্জুর, মীর শওকত এবং নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানদ্বয় সমভিব্যাহারে বঙ্গভবনে গিয়ে জিয়ার অনুকূলে সিএমএলএ’র পদ হস্তান্তরের কাগজে স্বাক্ষর দিতে সায়েমকে বাধ্য করেন। এরপর ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সায়েম শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে৩২. রব, জলিল ও মােহাম্মদ শাহজাহান আগে থেকেই বন্দি ছিলেন এবং বিপ্লবের ফলে ৭ নভেম্বরইমুক্তি পান। রবকে পরে এক ক্ষমা ঘােষণায় মুক্তি দেয়া হয়। অ্যান্থনি মাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৪-৫৯ পাঠানী জেনারেল আজম খান যেমন পিস্তল উঁচিয়ে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগপত্রে ইস্কান্দার মির্জার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে আইয়ুব খানকে ক্ষমতায় বসাতে সাহায্য করেছিলেন।জিয়াকে মনােনীত করে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার অর্পণ করেন। তখন তার বয়স মাত্র ৪৩ বছর। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক থাকাকালে জিয়া একই সাথে স্বরাষ্ট্র, অর্থ ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। সে-সময় তাে বটেই, এমনকি তার সাড়ে ৫ বছর শাসনামলে জেলহত্যাকাণ্ড তদন্ত কমিশনকে কাজ করতে তিনি সম্মতি দেননি। আগস্ট হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে নানা মহলে আলােচনা থাকলেও জেলহত্যার ব্যাপারে মানুষ তাকে সন্দেহ করে না। কিন্তু এ-ব্যাপারে আইনকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে না দেয়ার কারণ বােধগম্য নয়।

সায়েমকে সরিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পরদিন এক ঘােষণায়। জিয়া সংবিধান সংশােধন করেন। রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বহাল রেখেই সংবিধানের প্রারম্ভে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ শব্দসমূহ সংযােজন করে দেশকে ইসলামী চরিত্রের ধারণা দিয়ে জনগণের সাথে প্রতারণা করা হয়। বাঙালি। জাতীয়তাবাদে অবিশ্বাসী ও স্বাধীনতাবিরােধী পাকিস্তানি মনােভাবাপন্নদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য নাগরিকত্ব বাংলাদেশীকে ‘জাতীয়তাবাদ’ অভিধায় উপস্থাপন করা হয়। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরের মাসে জিয়া একটি লােক-দেখানাে গণভােটের আয়ােজন করেন। ১৯৭৮ সালে সাংবিধানিকভাবে অযােগ্য হয়েও জিয়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির আশ্রয় নিয়ে নির্বাচিত হন। ১ ডিসেম্বর ১৯৭৮ জিয়া এরশাদকে এপ্রিল মাসের ব্যাক ডেট’ দিয়ে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়ােগ করেন। যার অর্থ রাষ্ট্রপতি নিবার্চনের সময় তিনি চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে সরকারি চাকরিতে থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করেছেন। এ কারণে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার অযােগ্য ছিলেন। এই অযােগ্যতাকে এড়ানাের জন্য তিনি ‘অবৈধভাবে ২৯ এপ্রিল দ্বিতীয় ঘােষণা (ত্রয়ােদশ সংশােধনী) ১৯৭৮, জারি করেন। এ প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিয়া বলেন :ওসমানী এম.পি, হয়েও (মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখক) কমান্ডার ইন চিফ পদে বহাল ছিলেন। আমি তাে সিইসি হয়ে তিন বাহিনী প্রধানের মাধ্যমে আমার ক্ষমতার ব্যবহার করছি মাত্র। আমার পদত্যাগ দেশের জন্য খুব ভালাে হবে না।”অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৪-৩৫। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, কয়েক বছর পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে জিয়া বলেছিলেন আমি ক্ষমতা দখল করিনি। আমাকে ক্ষমতায় বসানাে হয়েছিল।’ (অ্যান্থনি, বাংলাদেশ রক্তের ঋণ, পৃষ্ঠা-১৩৫)। সায়েম প্রেসিডেন্ট ও সিএমএলএ-উভয় দায়িত্বই যথাযথভাবে পালন করছিলেন এবং পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করছিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার জন্য এবং নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য জিয়া সিএমএলএ পদ জোর করে দখল করেছিলেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, জেল হত্যাকাণ্ড, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭ ঘােষণা দিয়ে এরূপ সংশােধন সংবিধানের পরিপন্থী কাজ। পরে এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ ঘােষণা করে একই প্রতারণা করেন অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৭ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৮এ সময় তিনি সাফারি-স্যুট পরিহিত জেনারেল হিসেবে আখ্যায়িত হন।

কিন্তু মার্শাল-ল রেগুলেশন বলবত থাকায় এর বিরুদ্ধে সেদিন বৈধতার প্রশ্ন কোনাে কোর্টে উত্থাপন করা সম্ভব হয়নি।১৯৭৯ সালে সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন ও মাস্তানবাহিনী কাজে লাগিয়ে জিয়া একটি রাবার স্টাম্প পার্লামেন্ট নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তার মনােনীত প্রার্থীদের মধ্যে ২৫০ জনই ছিল দালাল-গােত্রের রাজনীতিবিদ। তিনি রাজাকার কূল শিরােমণিদের অন্যতম শাহ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ পার্লামেন্টে সংবিধানের পঞ্চম সংশােধী পাস করে মােশতাকের জারিকৃত সামরিক আদেশ ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ যাবতীয় কালাকানুন সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা| পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গােয়েন্দাবিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে। তিনি ক্ষমতার শীর্ষে আরােহণ করেন এবং গণভােট, রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুলভােট জয়ী হয়ে ক্ষমতাকে সংহত করেন। এরপর তিনি আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার বাসনা মনে পােষণ করতে থাকেন। এজন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকলেও উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করে তুলেন। তিনি একদিকে ঘােষণা দিলেন : ‘I will make politics difficult for the politician.’ অন্যদিকে তার অনুগ্রহভােগীদের জন্য ঘােষণা দিলেন ‘Money is no problem.’ তরুণ সমাজকে তার পেছনে কাতারবন্দি করা ও তাদের নৈতিকতাকে ধ্বংস করে ক্রীড়নকে পরিণত করার জন্য তিনি সৃষ্টি করেন যুব কমপ্লেক্স। কেবল ১৯৭৯-৮০ ও ৮০-‘৮১ -এই দুই অর্থবছরে হাট-বাজার থেকে সংগৃহীত প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকা ওরা আত্মসাত করে। অন্যান্য উৎসের টাকা যােগ হলে টাকার অঙ্ক অনেক বড় হবে।দুর্নীতির অপর একটি খাত ছিল জিয়ার তথাকথিত স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে খালকাটা বিপ্লব। কোদাল হাতে শ্রমিক জিয়া ও তার মন্ত্রীরা অনেক ঢােল-সহরত করে টিভি পর্দায় এ বিপ্লব সাধন করেন। বাস্তবে কেউ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেনি। কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও অন্যান্য উৎস থেকে এ কর্মসূচিতে অর্থ যােগান দেয়া হয়। অথচ ঐ অর্থের সিংহভাগ চলে যায় বিএনপি কর্মীদের পকেট কিংবা স্থানীয় কর্মকর্তাদের পকেটে।জিয়ার অপর একটি সখ ছিল মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে নৌ-বিহার করা।

এর মাধ্যমে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ওদের সাথে পরিচিত হন ওঅ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূবােক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৯ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪০ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪০পরে তাদেরকে তার দলের ছাত্রফ্রন্টে রিট করেন। অবশেষে তাদের অনেকেই দেশখ্যাত শন্ত্রপাণি সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত হয়েছে।  জিয়ার সাড়ে ৫ বছরের শাসনামলে কোনাে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। বৈদেশিক সাহায্যপ্রাপ্ত অর্থে সুবিধাভােগীদের জন্য ঢাকার বাজার সৌখিন পণ্যে ভরে ওঠে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে মানুষের অভাব বাড়তে থাকে। এ ধরনের অবস্থায় সন্ত্রাস, অপরাধজনিত ঘটনা আর হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। জিয়া আর জনগণউভয়পক্ষের জন্যই রঙিন স্বপ্ন মান হয়ে যেতে থাকে। রাজনৈতিক হত্যা আর ডাকাতি প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। কুষ্টিয়ায় পুলিশ কনস্টেবলের হাতে জেলা প্রশাসক প্রহৃত হয়। স্ত্রীলােকদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে যায় এবং এতে পুলিশের হাত থাকার প্রমাণও পাওয়া যায়। এ ধরনের অপকর্ম বাংলাদেশে এর আগে এমন ব্যাপকহারে ঘটতে কখনও শােনা যায়নি। সে-সময় এক সাংবাদিক সম্মেলনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে বলে স্বয়ং জিয়াও স্বীকার করেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ভাষায় : “ঠিক শেখ মুজিবের শেষ দিনগুলাের মতাে, রিপোের্ট ও গুজব চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল যে, অচিরেই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। এমনই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মঞ্জুরের পৃষ্ঠপােষকতায় লে, কর্নেল মতিউর রহমান, লে. কর্নেল মাহবুবুর রহমান, লে. কর্নেল দেলােয়ার হােসেন, ৬৯ পদাতিকের ব্রিগেড মেজর এসএম খালিদ প্রমুখের পরিকল্পনায় ৩০মে,১৯৮১ অতি প্রত্যুষে চটগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়াকে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা বিনা বাধায় সার্কিট হাউসে ঢুকে সকলকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য কিছু গােলাগুলি ছুড়ে এবং প্রেসিডেন্টের ৪ নং কক্ষের একটি দরজা লাথি মেরে ভাঙার চেষ্টা করে। অপর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে জিয়া তােমরা কী চাও?’ জিজ্ঞাসা করার মুহূর্তেই লে. কর্নেল মতি এসএমজি থেকে গুলি চালিয়ে তার বুক ঝাঝরা করে দেয়। দরজার কাছেই মেঝেতে মুখ-থুবরে লুটিয়ে পরে জিয়ার প্রাণহীন দেহ। মতি এসএমজির নল দিয়ে দেহটিকে উল্টিয়ে মুখমণ্ডল আর বুকের উপর ট্রিগার টিপে রেখে ম্যাগজিন খালি করে খুনের নেশা মেটায়।  পুরাে অভিযানটি ২০ মিনিটেরও কম সময়ে সম্পন্ন হয়। সফরসঙ্গী, স্থানীয় অনুসারী ও প্রশাসনের কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। মৃত্যুর পর সামান্য শ্রদ্ধাও কেউ দেখায়নি। একপর্যায়ে মিজান চৌধুরী তার বিছানার চাদর দিয়ে মৃতদেহকে ঢেকে দেয়ার পূর্বপর্যন্ত তা পড়েছিল বেওয়ারিশ লাশের মত।* অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪৩অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪৪ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা ১৪৪

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!