You dont have javascript enabled! Please enable it! আতাউল গনি ওসমানী - সংগ্রামের নোটবুক

আতাউল গনি ওসমানী কর্নেল (স্বাধীনতার পর জেনারেল) মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নিত্য সাথী ছিল। পােষা কুকুর ‘মন্টি’ (পাকবাহিনীর গুলিতে হত) ও একজোড়া জঙ্গী গোঁফ (যাকে খাড়া রাখার জন্য মােম ঘষার কাজে দৈনিক ২ ঘন্টা ব্যয় হয়)। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড আইয়ুববিরােধী (কিন্তু চলনে-বলনে আইয়ুবকে অনুকরণকারী)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার তার কৃতিত্বের অনেক কাহিনী (অধিকাংশের কাছে অতিশয়ােক্তি) শােনা গেলেও কর্নেল হিসেবেই তিনি অবসর নিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন, শুধু বাঙালি হওয়ার কারণেই তাকে কর্নেলের উপর প্রমােশন দেয়া হয়নি, এমনকি সিভিল সার্ভিসে কোনাে উচ্চপদও দেয়া হয়নি। পাকিস্তানি আমলে ইপিআর ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট এই দুটি বাহিনীর তিনিই উদ্যোক্তা বলে দাবি করতেন। নিজের অতীত কৃতিত্ব বর্ণনায় তিনি ছিলেন ক্লান্তিহীন। তিনি নিজের সামরিক জ্ঞান ও কৌশল সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পােষণ করতেন। ২ এপ্রিল ১৯৭১ -এর পর ওসমানী কুমিল্লার মতিনগর সীমান্ত পার হয়ে ভারতে গমন করেন। বিএসএফ-এর ব্রিগেডিয়ার পান্ডে তাকে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া (বেঙ্গল) হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসেন। ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চাবাগানে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী, লে. কর্নেল আব্দুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর কাজী নূরুজ্জামান, মেজর নূরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরি প্রমুখ বঙ্গশার্দুলেরা প্রতিরােধ যুদ্ধের নকশা প্রণয়নে’ মিলিত হন এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সকল বিদ্রোহী ইউনিটের সমন্বয়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ’ গঠন করে ওসমানীকে তা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেঙ্গলকে দিয়ে ভারতের সােনামুড়া সংলগ্ন গােমতি নদী পার হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে দখল করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু উর্ধ্বতন অফিসারদের প্রবল আপত্তির মুখে এই অসাধ্য ও অবাস্তব প্রস্তাব নাকচ হয়ে ব্যাটালিয়ন দুটো অঙ্কুরেই বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে রক্ষা পায়। মঈদুল হাসান, মূলধারা ১৯৭১, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫।

মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল এইড ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পৃষ্ঠা ৯৪) জানাচ্ছেন, সাংসদ থাকা সত্ত্বেও ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি করায় বহু সামরিক অফিসার অসন্তুষ্ট ছিলেন এবং তাকে এড়িয়ে চলেছেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে জিয়া একই সঙ্গে সিইসি, সিএমএলএ, সিএএস পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়া অবৈধ ও অসাংবিধানিক’ -এই প্রশ্নের জবাবেও ওসমানী সাংসদ হয়েও সিইসি থাকার উল্লেখ করেন। যদিও এটি ছিল জিয়ার ছোঁদো যুক্তি। কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর। সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৮, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে তেলিয়াপাড়া হেডকোয়ার্টারে একটি বড় ধরনের কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এতে ওসমানী, জিয়া, রুস্তমজি (বিএসএফ প্রধান), পান্ডে, ২য় ও ৪র্থ ব্যাটালিয়ান এবং বিএসএফ-এর কয়েকজন সিনিয়র অফিসারসহ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার এসডিও কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও খাদ্য সামগ্রী দিয়ে ভারতের সহায়তাদান এবং মুক্তিযুদ্ধকে বৈধতাদান ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিলাভের জন্য একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের অত্যাবশ্যকতা বিশেষ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরা হয়।কনফারেন্স চলাকালে সকাল সােয়া আটটায় একজন সিগন্যাল জেসিও একটি ToT at 8.30′ মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে আনে। যার অর্থ বাংলাদেশের কোনাে একটি জায়গায় সাড়ে আটটায় বিমান থেকে বােমা হামলা হবে। ওসমানী এতে বেশ অস্থির হয়ে পড়েন এবং বিমান হামলার ভয়ে চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। অথচ অবস্থান ও কৌশল উভয় বিবেচনায় তেলিয়াপাড়ায় তখন বিমান হামলার সম্ভাবনা ছিল । তার ভীরুতা ভারতীয়দের সামনে উপস্থিত বাঙালিদের অপ্রস্তুত করে। ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় তাজউদ্দিন প্রমুখ শিলিগুড়ি থেকে আগরতলায় ফিরে এসে দেখতে পেলেন ওসমানীসহ বেশকিছু নেতৃবৃন্দ ইতােমধ্যে এখানে এসে পৌঁছেছেন। ওসমানী ও নগেন্দ্র সিং (ভারত সরকার নিযুক্ত যুদ্ধ সহায়ক (অব.) জেনারেল সার্কিট হাউসের একই কক্ষে অবস্থান করছেন। ওসমানী ইতােমধ্যে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা তৈরি করে ফেলেছেন। তাকে সশস্ত্রবাহিনী প্রধানের (প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব নেয়ার আমন্ত্রণ জানানাে হলে তিনি (সম্মত হয়ে) পূর্বশর্ত হিসেবে যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামের কথা উল্লেখ করেন। ১৩ এপ্রিল মন্ত্রীবর্গের সাথে একই বিমানে ওসমানী কলকাতা পৌঁছেন এবং ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর সরকারের অভিষেকানুষ্ঠানে যােগদান করেন।| যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি কদাচিৎ যেতেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে অফিসের মানচিত্র দেখে নির্দেশ পাঠাতেন। মে মাসের দ্বিতীয়/তৃতীয় সপ্তাহে শাফায়াত জামিল ওসমানীর সাথে সীমান্তকর্নেল শাফায়াত জামিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩৯। অন্য একটি ঘটনায়ও তার ভীরুতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যুদ্ধ চলাকালে জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল গাফফার চৌধুরী সাক্ষাৎকারের জন্য তার সেক্রেটারি ক্যাপ্টেন নূরের (পরে মুজিব-ঘাতক মেজর) সাথে দিনক্ষণ ঠিক করে সার্কাস এভেনিউর অফিসে যান এবং তিনি প্রবেশমাত্র রিভলবার উঁচিয়ে ওসমানী তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। পরিচয় পেয়ে নিশ্চিত হয়ে বলেন, পাকিস্তানিরা তাকে হত্যা করার জন্য প্রায় শ’দেড়েক গুপ্তঘাতক নিযুক্ত করেছে। তাই নিরাপত্তার কারণে এই সতর্কতা, এমনকি অপরিচিত দর্শনার্থীদের দেহতল্লাশিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে (আব্দুল গাফফার চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৬)। শাফায়াত জামিল সীমান্ত ক্যাম্প পরিদর্শনে ওসমানীর সফরসঙ্গী হিসেবে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জানাচ্ছেন, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ভারতের মতাে নিরাপদ জায়গাতেও পাকিস্তানি কমান্ডাে হামলার ভয়ে তিনি সারাক্ষণ আতঙ্কিত হয়ে থাকতেন (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৫) আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮ক্যাম্প পরিদর্শনে যান। তিনদিনের এই কর্মসূচিতে তারা প্রায় আড়াইশশা মাইল পথ পরিভ্রমণ করেন। যাত্রাপথে বেশকয়েকটি ক্যাম্পে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন এবং তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু সর্বত্রই তিনি অসহিষ্ণুতার পরিচয় দেন। শাফায়াত জামিলের ভাষায় :ওসমানীকে এ সময় বেশ অসহিষ্ণু মনে হতে লাগল।

কোনাে বড় ধরনের সমস্যা দেখলেই তিনি শুধু বলছিলেন, “আমার পক্ষে এত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। আই উইল রিজাইন। পুরাে সফরে তিনি প্রায় কুড়িবার পদত্যাগের হুমকি দিলেন। প্রায় সবক’টি ক্যাম্পের কমান্ডার এবং কোনাে কোনাে জায়গায়। স্থানীয় সাংসদদের সাথেও দুর্ব্যবহার করলেন। বসিরহাটের কাছে একটি ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন জলিলের (পরে মেজর, ও জাসদ নেতা) সাথে দেখা হয়। ওসমানী জলিলকে রীতিমতাে অশালীনভাবে তিরস্কার করলেন। তার এহেন আচরণ আমাকে লজ্জিত না করে পারল না। জলিলের অপরাধ ছিল, বরিশালে পাকবাহিনীর আচমকা হামলায় বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্রসহ তার একটি লঞ্চ ডুবে যায়। ক্যাপ্টেন জলিল চুপচাপ ওসমানীর বকাঝকা মাথা পেতে নিল। আমার তখন যুদ্ধক্ষেত্র আর কলকাতার নিরাপদ জীবনের ফারাকটা বেশি করে মনে পড়ছিল। মনে হল, ওসমানী সশরীরে যুদ্ধক্ষেত্রে থাকলে হয়তাে জলিলকে এভাবে দোষারােপ এবং তিরস্কার করতে পারতেন না।…(বাগডােগরা) এয়ারফিল্ডের কাছাকাছি মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আওয়ামী লীগের। সাংসদ সিরাজ সাহেবের সাথেও দুর্ব্যবহার করলেন কর্নেল ওসমানী। একপর্যায়ে দু’জনের মধ্যে হাতাহাতির উপক্রম হলে অতিকষ্টে আমি সেটা সামাল দিলাম। কমান্ডার ইন চিফ কর্নেল ওসমানীর এহেন কার্যকলাপ ও আচরণে অত্যন্ত নিরাশ হলাম আমি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সন্দেহ জাগল। হিরতাহীন, মানসিকভাবে অশান্ত একজন লােককে মুক্তিবাহিনীর সর্বোচ্চপদে বসানাে কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে, এরকম প্রশ্ন জাগল মনে। তিনদিনের এই সফরে মুক্তিযুদ্ধ, অপারেশন, যুদ্ধকৌশল, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদের সংস্থান সম্পর্কে বলতে গেলে একটি কথাও উচ্চারণ করেননি ওসমানী। দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আইনের ক্ষেত্রে MPML (Manual of Pak Military Law) কতটুকু গ্রহণযােগ্য আর কতটুকু বাদ দেয়া উচিত, সারাপথ সেই আলােচনাতেই মেতে রইলেন তিনি। যুদ্ধের কেবল শুরু, বিজয় কতদূরে রয়েছে তার কোনাে ঠিক-ঠিকানা নেই, অথচ সেনাবাহিনীর আইন নিয়ে এখনি চিন্তার অন্ত নেই তার!’…যুদ্ধে তিনি বীরত্বপূর্ণ বা কৌশগত বিশেষ অবদান রেখেছেন-এমন কাহিনী জানা যায় না। তিনি কোন বিশেষ পদকে ভূষিত হননি। সামরিক কর্মকর্তাগণ যে তাকেস্বাধীনতার পর ‘যৌথ বাহিনী কর্তৃক দখলকৃত পাকিস্তানি অস্ত্রশস্ত্র ভারতে সরিয়ে নেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সরকার জলিলকে ‘অবাধ্যতার অভিযােগে গ্রেফতার করে এবং সামরিক ট্রাইবুসালে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে এক বছর পর জেলে থেকে মুক্তি পান।

উল্লেখ্য, ট্রাইব্যুনালের চেয়ারমান ছিলেন কর্নেল তাহের। কর্ণেল সাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪-৫৫এড়িয়ে চলত তার একটি কারণ উপরের বর্ণনা থেকেও বােধগম্য হয়। স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম বাজেট প্রণয়নকালে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন না খেয়ে মরব, তবু শর্তযুক্ত ঋণ নেব’ ঘােষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক যে, সেবা ও সাহায্যের নামে যুদ্ধ চলাকালেই আমেরিকা ও তার পাশ্চাত্য বন্ধুরা বাংলাদেশকে অদৃশ্য শর্তে আবদ্ধ করতে শুরু করে। সার্কাস এভেনিউ ও বাংলাদেশ দূতাবাস তখন বিদেশী সাংবাদিক ও সাহায্যসংস্থার কর্মকর্তার ভিড়ে রাতদিন গমগম করে। কেউ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিককে নগদ সাহায্য দিচ্ছেন, কেউ উদ্বাস্তু শিবিরের জন্য ঔষধ, দুধ, কম্বল দিচ্ছেন। তাজউদ্দিনের ভাষায়,শত্রু এখন বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকেছে… এখন আমাদের ভেতর। থেকে শুরু হয়েছে অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানাে। আমাদের সাহায্যকারী মিত্র দেশগুলাের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে গুজব ছড়ানাে হচ্ছে। এমনকি আমাদের নিজেদের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবচাইতে বিপদের কথা, সাহায্য দেওয়ার নাম করে এগিয়ে এসে টাকা ছড়িয়ে পাশ্চাত্যের কোনাে কোনাে দেশ আমাদের সরকারের মধ্যেই তাদের শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করেছে এবং মুক্তিবাহিনী (অফিসারদের সাথে গােপন যােগাযোেগ প্রতিষ্ঠা করে) ও বুদ্ধিজীবীদের নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলার জন্য চেষ্টা করছে।… শুধু গুজব প্রচার নয়, বেনামা প্রচারপত্রও প্রকাশ করা হয়েছে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে।…  বিদেশীদের মধ্যে আমেরিকানদের সংখ্যাই বেশি। আর এই আমেরিকানদের সাথেই মােশতাক, হােসেন আলী, চাষী, ঠাকুরদের ঘনঘন ওঠাবসা। এই দলের সাথে যুক্ত হয়েছেন ওসমানীও।… মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহের নামে মেজর মােশাররফ, মেজর জলিল ও মেজর জিয়ার সাথে তাদের (বিদেশী সাংবাদিকদের) নিত্য-বৈঠক।”একটা ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের খােন্দকার মােশতাকের সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর ছিল দারুণ মিল, দুজনই ভারতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ; দু’জনেরই মূল আস্তানা সার্কাস এভেনিউতে এবং মাখামাখি ব্রিটিশ ও আমেরিকান সাহায্যসংস্থার লােক, কূটনীতিক ও সাংবাদিকের সঙ্গে। মিলিটারি সার্ভিস থেকে রিটায়ার করিয়ে দেওয়া ওসমানী ১৯৭০ সালে তখনকার জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগে যােগদান করে কার্যত মােশতাক গংদের ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তি বৃদ্ধি করেন।

শােনা যায়, ওসমানির সুপারিশে তার প্রিয় পাত্র লে, কর্নেল ফিরােজ সালাহউদ্দিন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদে নিযুক্তি পান। একসময় তিনি ব্রিগেডিয়ার এবং আশির দশকের শেষদিকে রাষ্ট্রদূত হন। কর্নেল ফিরােজ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনের আগস্ট পর্চাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৮-১০০, ১০৫-১০৯। কিছুদিনের মধ্যে সরকারের গােপনীয় ফাইলের বিষয়বস্তু ফাঁস হয়ে আমেরিকা ও পাকিস্তানে প্রচার হয়ে যাচ্ছে জানতে পেরে সার্কাস এভেনিউর দূতাবাসে বিদেশীদের আনাগোনার ওপর কঠোর নজর রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বিদেশমন্ত্রী মােশতাকের সাথে তাজউদ্দিনের বিরােধীতার সূচনা হয় এ-নিয়েই। আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনের আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্তি, পৃষ্ঠা ১০৭পাকিস্তানিদের সঙ্গে আত্মসমর্পণকারী বাঙালি অফিসার। জনশ্রুতি যে, তিনি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পনের পূর্ব পর্যন্ত পাকবাহিনীর প্রধান রাজাকার রিক্রুটিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উল্লেখ্য, শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত-পছন্দ অপছন্দ ও গোঁ ধরার কারণে একই ব্যাচের মধ্যে সিনিয়র জিয়াকে ডিঙিয়ে সফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীপ্রধান করায় বহু অনর্থের সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ। কাজের জন্য নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন পদক বিতরণেও তার। পক্ষপাতিত্বের অভিযােগ শােনা যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বে ফাটল সৃষ্টি, সামরিকবাহিনীতে পাকিস্তানি মনােভাবাপন্ন অফিসারদের শক্তিবৃদ্ধি ও মুজিববিরােধী মনােভাব তৈরিতে ওসমানী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধকারী পাকমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনের ছেলে জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনের সাথে তার আঁতাতের কথা সর্বজনবিদিত। মন্ত্রিত্বকালে বিলাতে বিমানের টিকেট বিক্রির এজেন্সি বণ্টন ও শিপিং কর্পোরেশনের বাণিজ্য-জাহাজ সংগ্রহে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ উঠেছিল। বিমানবালাদের পক্ষ থেকেও তার বিরুদ্ধে অনৈতিক সম্পর্কে বাধ্য করার অভিযোেগ একসময় সারা ঢাকায় চাউর হয়েছিল।১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ওসমানীকে জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। ৭ এপ্রিল তিনি অবসর গ্রহণ করেন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী পাস হয়।

এতে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকার ব্যবস্থা, একটিমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল গঠন ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হয়। সংসদে ব্রুট মেজরিটি’ থাকার কারণে তা সম্ভব হয়। এর প্রতিবাদে ওসমানী ও মঈনুল হােসেন ১১ ফেব্রুয়ারি সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেন। গণতন্ত্রের প্রতি নিষ্ঠা ও মুজিবের বিরােধিতা করার সাহস প্রদর্শনের জন্য সারাদেশে তিনি ও মঈনুল আলােচিত ও প্রশংশিত হন। কিন্তু মাত্র ৬ মাসের মাথায় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে, মানবতাকে ধ্বংস করে, স্বাধীনতার স্থপতিকে নির্বংশ করে অবৈধ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়া মােশতাকের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হতে ‘পাপা টাইগার’ ওসমানী বিবেকে এতটুকুও দংশনবােধ করেননি। অ্যান্থনির ভাষায়, ওসমানী ছিলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের কর্নেল ইন চিফ এবং তাকে তিনি (মােশতাক) সবচাইতে বেশি বিশ্বাস করতেন বলে প্রতীয়মান হয়। ১৫ আগস্ট সকালে রেডিও অফিসে সেনা প্রধানদের সাথে ওসমানীও উপস্থিত ছিলেন। মােশতাক যে অপাত্রে বিশ্বাস স্থাপন করেননি তা অচিরেই বােঝা গেল। অক্টোবরের মাঝামাঝি বঙ্গভবনে ডাকা সিনিয়র সেনা-কর্মকর্তাদের এক কনফারেন্সে ওসমানী সবাইকে রাষ্ট্রপতি মােশতাক ও তার সরকারের প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ১০ আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনের আগস্ট পঁচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৭| অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯২। ১২ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অব.), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর,পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩১দেন। তিনি আরও বলেন, যারা সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করবে তারা ভারতীয়দের প্ররােচনাতেই করবে, তারা সব ভারতীয় এজেন্ট। যে-কোনােরকম অবাধ্যতা সমূলে উৎখাত করা হবে বলেও তিনি হুঙ্কার দেন।

 ২ নভেম্বর দিবাগত রাত তিনটায় (৩ নভেম্বর ১৯৭৫) বঙ্গভবনে পাহারারত জনৈক পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে খালেদ মােশাররফের অভ্যত্থান সূচনার কথা জানতে পেরে মেজর রশিদ সাহায্যের জন্য নানা স্থানে ফোন করে কোথাও থেকে উপযুক্ত সাড়া না পেয়ে ক্যান্টনমেন্টের বাসায় ওসমানীকে ফোন করেন। তিনি সাথে সাথে বিডিআর, জিয়া ও খালেদ মােশাররফকে ফোন করেন। বাসায় গাড়ি না-থাকায় বহু কষ্টে তিনি বঙ্গভবনে এসে পৌছেন। ততক্ষণে খালেদ মােশাররফের পক্ষ থেকে একটি নেগুসিয়েশন টিম’ বঙ্গভবনে এসে” ট্যাঙ্কগুলাে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত পাঠানাে, জিয়ার পরিবর্তে অন্য একজনকে সেনাবাহিনীপ্রধান করা, পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা প্রভৃতি দাবি জানায়। মােশতাক ভাের ৬টার পর থেকে রাষ্ট্রপতি না-থাকার ঘােষণা দিয়ে দাবি মানতে অস্বীকৃতি জানান। তখন তারা ওসমানীকে এ-সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, মােশতাক প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায় প্রেসিডেন্টের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে তার ক্ষমতা আপনাআপনি শেষ হয়ে গেছে। ডালিম তখন কর্কশভাবে ওসমানীকে বলেন :তাদেরকে আত্মসমর্পণ করতে বলুন। আমি জানি, আইয়ুব খান কেন আপনাকে বৃদ্ধ নকুল বলে ডাকতেন। কিন্তু এই অবস্থায় জেদ দেখাবার চেষ্টা করবেন না।”শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে প্রেসিডেন্ট মােশতাক কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ওসমানী মুজিবের হত্যাকারীদের দেশত্যাগের জন্য সেফ প্যাসেজের অঙ্গীকার দাবি করেন। সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষতি এড়ানাের জন্য এবং প্রয়ােজনে ইন্টারপােলের সাহায্যে ধরে আনা যাবে বিবেচনা করে তাওয়াবকে ফারুক-রশিদ গংদের ব্যাঙ্কক পৌছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। অভ্যুত্থানকারীরা তখনও না জানলেও ওসমানী ও খলিলুর রহমান (ডিফেন্স স্টাফ প্রধান) জেলে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার কথা জানতেন বলে ধারণা করা হয়।

৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় মােশতাক ও খালেদ মােশাররফের মধ্যে বঙ্গভবনের করিডােরে। উত্তেজিত বাক্য বিনিময়ের একপর্যায়ে সেখানে অবস্থানরত মেজর ইকবালের (পরে মন্ত্রী) নেতৃত্বে সৈনিকরা গুলি চালানাের প্রস্তুতি নিলে পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা ওসমানী শাফায়াতকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘Stafayat’ save the situation. Dnot’ repeat Burma!” শাফায়াত তখন ইকবালকে বাধা দিয়ে মােশতাকসহ কেবিনেট কক্ষে প্রবেশশাফায়াত জামিল জানান, দরদস্তুরকারী দলটি ‘দুপুরের পর’ পাঠানাে হয়েছিল (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-১৩৫) অ্যান্থনি ম্যাসকরেনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৮ কর্নেল শাফায়াত জামিল (অর), একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫-৩৬। কর্ণেল শাফায়াত জামিল (অব.) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়য়ত্রময় নভেম্বর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৮করেন। অন্য একটি সূত্রমতে, হঠাৎ দরজায় সজোরে চিৎকার শুনে ভেতরের গরম বাক্য বিনিময় থেমে যায়। শাফায়াত জামিল আরাে পাঁচজন অফিসার নিয়ে স্টেনগান হাতে কেবিনেট রুমে জোরপূর্বক ঢুকে পড়েন। এতে কেবিনেট রুমে ত্রাসের সঞ্চার হয় এবং মন্ত্রীরা চেয়ার ছেড়ে যে-যেভাবে পারে পালাতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট মােশতাককে মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে দেখা যায়। তার মাথার উপর এক মেজর স্টেনগান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। ওসমানী তাকে বাঁচানাের জন্যে দৌড়ে যান এবং অনুরােধের সুরে বলতে থাকেন, ‘খােদার দোহাই, কিছু করােনা। এই অবস্থায় কিছু করা পাগলামাে ছাড়া আর কিছুই নয়। তােমরা দেশটাকে ধ্বংস করে ফেলবে। প্রচণ্ড হটগােল বেশকিছুক্ষণ ধরে চলে। যতবারই বন্দুকধারী অফিসাররা মন্ত্রীদের প্রতি বন্দুকের নল উঁচিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল ততবারই ওসমানী তাদের ধাক্কিয়ে ফিরিয়ে রাখছিল।’৭।কী বলিহারি দেশপ্রেম। মােশতাক ও তার দোসরদের মারলে বার্মার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, দেশ ধ্বংস হয়। আর শেখ মুজিবকে তার শিশুপুত্র ও পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনসহ হত্যা করলে সূর্যসন্তান’ আখ্যা পাওয়া যায়। আর এই ‘সূর্যসন্তানদের সেফ প্যাসেজের ব্যবস্থা করার জন্য গণতন্ত্রী ওসমানীর কী অন্তহীন চেষ্টা!১৭ অ্যান্থনি ম্যাসকারনহাস, বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১১

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান