বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ২৭শে আগস্ট, মঙ্গলবার, ১০ই ভাদ্র, ১৩৮১
শক্ত হাতে ধরতে হবে
খাদ্যশস্য চুরি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। মজুতদারী। মুনাফাখোরী। চোরাচালান ইত্যাদি সমাজ বিরোধী তৎপরতা আশানুরূপভাবে হ্রাস পায়নি। সরকার এ সম্পর্কে বার বার সতর্কবাণী উচ্চারণ করা সত্ত্বেও সীমিত হয়নি সমাজবিরোধীদের গতি। এমনিতেই গোদ তার উপর বিষফোড়ার মত বন্যা এসে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। বন্যার ফলে দেশের ৩ কোটি মানুষ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। আশ্রয়। আহার। জমির ফসল সবকিছুই ভাসিয়ে নিয়েছে সর্বনাশা বন্যা এমনই অবস্থার সুযোগ নিতেও পিছপা হচ্ছেনা সমাজ বিরোধীরা।
সম্প্রতি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে অসাধু ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর মনোভাব গ্রহণের ইঙ্গিতও ব্যক্ত হয়েছে। ইতিপূর্বেও তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। এছাড়াও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কথায় বলে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। সমাজবিরোধীদের অবস্থাটাও তাই। শক্ত হাতে চেপে ধরতে না পারলে এরা সহজে পিছু হটবে বলে মনে হয় না।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে প্রকাশ, রাষ্ট্র ও জনগণের দুশমন অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সারাদেশে একটি সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করার কথা সরকার সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছেন। এ ব্যাপারে শীঘ্রই সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে।
খাদ্যশস্য সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে মূল্যবৃদ্ধির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুমদার এবং খাদ্যদ্রব্যসহ ঔষধপত্রে ভেজাল মিশ্রণকারী অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করা হবে। এছাড়া অনুরূপ ব্যবস্থা নেয়া হবে সীমান্তে চোরাচালানির নিয়োজিত অসাধু ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও।
সংবাদে আরো প্রকাশ যে, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত সর্বাত্মক অভিযানে স্থানীয় প্রশাসন যন্ত্র এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের যৌথ উদ্যোগে পরিচালনা করা হবে। এতে কোনরকম দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির স্থান না পায় তার নিশ্চয়তা বিধানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো প্রাথমিক প্রস্তুতি চলছে। এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই নাকি পরিকল্পনার একটি খসড়া তৈরি করা হচ্ছে।
সংবাদটি নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। সরকার কঠোর হস্তে সকল সমাজ বিরোধী তৎপরতার অবসান ঘটান এটা সকলেরই কাম্য। সরকারের এ পদক্ষেপ দেশবাসীর অভিনন্দন কুড়াবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
সরকারের সমালোচিত সিদ্ধান্তকে অভিনন্দন জানিয়ে আমরা কয়েকটি কথা বলতে চাই। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে সরকারি প্রশাসনযন্ত্রকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য সেনাবাহিনী দেশের অন্ত-প্রত্যন্তে ছড়িয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীর ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসার পর সমাজ বিরোধী তৎপরতা খানিকটা হ্রাস পেয়েছিল। তারপর আবার সেই অবস্থা। অবশ্য সীমান্তে চোরাচালান অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। জনসাধারণ তখন আশা করেছিল যে অবস্থার উন্নতি হবে। বাস্তবে তা হয়নি। অথচ সেনাবাহিনী এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রচলিত প্রবাদ হলো, শাদীর পহেলা রাতেই নাকি বিড়াল মারতে হয়।
সরকার যদি বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করে যান তাহলে সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের মনের ভিতরে যাবে কেটে। ওরা সতর্কবাণীকে যত গর্জে তত বর্ষে না বলেই ধরে নেবে। আর এ অবস্থার সৃষ্টি হলে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলাটাই স্বাভাবিক। এবারে অতীত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি।
ইথিওপিয়াঃ ক্ষমতাহীন সম্রাট
একে একে সকল ক্ষমতাই হাতছাড়া হয়েছে সম্রাটের। বাকি ছিল রাজপ্রাসাদ। সেটিও ২৫শে আগস্ট দখল করে নিয়েছে ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সমন্বয় কমিটি থেকে এক বিশেষ বেতার ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে প্রাসাদটি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে পরিগণিত হবে।’ নাম হবে তার ‘জনগণের প্রাসাদ।’
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ইথিওপিয়ার সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ করার পর থেকে একের পর এক তারা আঘাত হানতে শুরু করে সম্রাট হাইলে সেলাসির উপর। চাটুকার পরিবেষ্টিত সম্রাট দেশের বিস্ফোরন্মুখ অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। যেসব মোসাহেব দল নিয়মিত সম্রাটের দরবারে হাজিরা দিতেন তারা কোন সময় দেশের বাস্তব অবস্থা সম্রাটের কাছে তুলে ধরতেন না। সরকারি সংস্থাগুলো ও ঠিক একই ভাবে তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যেত। ‘সব কুছ ঠিকঠাক হ্যায়’ -এমনই কথা পিন দেয়া রেকর্ডের মতো বাজানো হতো সম্রাটের সামনে।
দীর্ঘ ছ’চল্লিশ বছর মহাপরাক্রমশালী ইথিওপিয়া শাসন করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে কাউকে উচ্চবাচ্য করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। মাঝখানে ক’বছর শাসন ক্ষমতায় হাতবদল হয়েছিল। বিদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন সম্রাট। পুনরায় ফিরে সেই একই নিয়মে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। জনসাধারণের কোন মতামতকে গ্রাহ্য করবার প্রয়োজনীতা তিনি অনুভব করেননি।
ইথিওপিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক যেকোনো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে পারেনি। জনমতকে সংগঠিত করবার কোন পথে সেখানে খোলা ছিল না। এই রাজনৈতিক শূন্যতা এবং পাশাপাশি ভূস্বামীদের অবাধ শোষণ ও মধ্যযুগের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের ঘোষিত নীতি সামনে রেখে তাই সামরিক বাহিনীকে অবশেষে হস্তক্ষেপ করতে হয়। সামরিক বাহিনীর আক্রমণের মূল লক্ষ্য সম্রাট হাইলে সেলাসি হলেও তারা এ ব্যাপারে অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে অগ্রসর হবার নীতি গ্রহণ করে। সম্রাটের ছত্রছায়ায় থেকে যেসব ভূস্বামীরা অবাধ শোষণ এবং অত্যাচার চালিয়ে আসছিল তাদের একের পর এক গ্রেপ্তার করা হয়। দেড়শ’ প্রখ্যাত এবং নেতৃস্থানীয় ইথিওপিয়ানকে তারা কারারুদ্ধ করে। সম্রাট হাইলে সেলাসি শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে তারা সংকুচিত করতে থাকে। এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সম্রাটের সর্বশেষ ক্ষমতা তিনটিও কেড়ে নেয়া হয়। দেশের সর্বোচ্চ নীতি প্রণয়ন সংস্থা ‘ক্রাউন কাউন্সিল’ বাতিল ঘোষিত হয়, সম্রাটের এক্তিয়ারাধীন সর্বোচ্চ আদালত ভেঙে দেওয়া হয় আর সেলাসীর সামরিক উপদেষ্টা কাউন্সিল বিলোপ ঘোষিত হয়।
এমনিভাবে সম্রাট হাইলে সেলাসীর সকল কর্তৃত্বের অবসান ঘটিয়ে অবশেষে সেনাবাহিনী সমন্বয় কমিটি রাজপ্রাসাদ দখল করে নিয়েছে। নামমাত্র বেসামরিক সরকার সেখানে রয়েছে তারা যে খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছেন তা নিয়েও নাকি সেনাবাহিনীর সাথে মতানৈক্য ঘটেছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মিচেল ইমরু এই মতানৈক্যের ফলে কিছুদিন আগে তার অন্য চারজন মন্ত্রীসহ পদত্যাগ করবেন বলে গুজব ছড়িয়ে ছিল।
এই বেসামরিক সরকারের অস্তিত্ব কতদিন থাকবে তা একমাত্র ভবিষ্যতে বলতে পারে। গত ফেব্রুয়ারির পর দু’দুজন প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সাথে তাল মিলিয়ে মিঃ ইমরু শেষ পর্যন্ত চলতে পারলে হয়ত শাসন ক্ষমতার একটা বেসামরিক আবরণ থেকে যাবে।
ইথিওপিয়ার জনসাধারণ পরিবর্তন চায়। কিন্তু সেই পরিবর্তন কোন পথে আসবে তা কেউ বলতে পারে না। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক শূন্যতা ইথিওপিয়ার সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা পূরণ নিঃসন্দেহে একটা জটিল ব্যাপার। এছাড়া রক্ষণশীল ভূস্বামী আর ধর্মভীরু চার্চ অনুসারীদের প্রভাব কিছু খাটো করে দেখার মত নয়। ইতিমধ্যেই তারা পরোক্ষভাবে সামরিক বাহিনীর নানা সংস্কারমূলক কার্যকলাপের বিরোধিতা শুরু করেছেন। তাদের অধিকতর শক্তি সঞ্চয় এবং সংঘটিত করে তোলার ব্যাপারে যে স্বয়ং সম্রাটও ইন্ধন যোগাচ্ছেন না তাই বা কি করে বলা যায়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক