You dont have javascript enabled! Please enable it!

খন্দকার মােশতাক আহমেদ ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট ও পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের এ্যাডভােকেট। জন্ম কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। পিতা পীর খন্দকার কবির উদ্দিন আহমেদ। গড়ন হালকা-পাতলা, উচ্চতা মাঝারি, মাথায় অবাঙালি-সুলভ ‘নেহেরু টুপি। চেহারায় ধূর্ততার আভাস। তিনি কথা বলতেন মন জুগিয়ে। গাফফার চৌধুরীর। বর্ণনায়, তার ছিল মাথায় টুপি, মুখে মধু, মনভরা ছলনা। ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার স্বামীবাগে রােজ গার্ডেনে (কাজী মুহাম্মদ বশীর হুমায়ুনের বাসভবন) ৩০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে একটি বিরােধী রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয় এবং মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সম্পাদক করে ৪০ সদস্যের একটি কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। খন্দকার মােশতাক ও শেখ মুজিব-উভয়ই কমিটিতে যুগ্ন-সম্পাদক নির্বাচিত হন।

(মুজিব তখন জেলে। যুগ্ম সম্পাদকদের মধ্যে মােশতাকের নামটি মুজিবের আগে উল্লিখিত হওয়ায়, মােশতাক নিজেকে মুজিবের সিনিয়র বলে প্রচার করার প্রয়াস পায়। কিন্তু ১৯৫৩ সালে মুকুল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত প্রথম কাউন্সিল সভাতে মুজিব মােশতাককে ডিঙ্গিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন)।  ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনােনয়ন না পেয়ে মােশতাক স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন (মনােনয়ন না পাওয়ার পেছনে মুজিবের হাত ছিল বলে গুজব ছিল) এবং আইন পরিষদের হুইপ পদ পাওয়ার লােভে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টিতে যােগ দেন।  ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক করার সময় আবদুস সালাম, খন্দকার মােশতাক প্রমুখ এর বিরােধিতা করেন এবং নাজিমুদ্দিন রােডে আলাদা ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘ চালু রাখেন। এদের নিকট দলটি আওয়ামী শব্দ যুক্ত মুসলিম লীগের বেশি কিছু ছিল না। কিন্তু তাদের সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে তিনি ছিলেন একজন অপরিবর্তিত মুসলিম-লীগার’। ১৯৬৪ সালে মােশতাক যখন পুনঃ আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন তখন তার ‘অবস্থান’ চলে যায় বেশ পেছনে। কেননা ততদিনে কামারুজ্জামান, নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, তাজউদ্দিন প্রমুখ নিজেদেরকে দলে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগে আবার ভাঙন দেখা দেয়। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ-সালাম খান প্রমুখ অপর একটি আওয়ামী লীগের (পিডিএম বা ৮ দফাপন্থী) জন্ম দেন। সহ-সভাপতি খন্দকার মােশতাক এঁদের সাথে যােগ দেন ; কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে আবার মুজিবের নেতৃত্বাধীন মূলদলে ফিরে আসেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯১টি এবং প্রদত্ত ভােটের ৭২ শতাংশ লাভ করে। অথচ মােশতাক মাত্র ৭০০ ভােটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। তাও সম্ভব হয়েছে শেষ মুহূর্তে মুজিব তার নির্বাচনী এলাকা সফর করেছেন বলে। একজন পুরনাে সহকর্মীর বিজয় নিশ্চিত করতে পেরে মুজিব খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু মােশতাক মুজিবের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষায় কাতর হন।  ২৪ মার্চ বিকাল থেকে ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতের প্রথম প্রহর পর্যন্ত সাক্ষাৎ করতে আসা সকলকে মুজিব আত্মগােপনের পরামর্শ দেন। সকলেই সে-মতে আত্মগােপন করেন এবং কারফিউ শিথিলের প্রথম সুযােগে ঢাকা ত্যাগ করে প্রথমে গ্রামাঞ্চলে ও পরে ভারত গমন করেন। অথচ জাতীয় পরিষদের স্পিকার পদপ্রার্থী মােশতাক নির্বিঘ্নে তার বাসায় অবস্থান করেন।

২৮ মার্চ বন্ধু ডা. টি. হােসেন তাকে সেখান থেকে তার নার্সিংহােমে নিয়ে যায়। জনৈক অবাঙালি ডা. রব তাকে দেখার পরও তিনি সেখানে প্রায় ১০ দিন অবস্থান করেন এবং ১০ এপ্রিল ঐ টি, হােসেনই তাকে আগরতলায় নিয়ে যান।  আওয়ামী লীগের দলীয় ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক সভা ১১ এপ্রিল আগরতলায় অনুষ্ঠিত হয়। এ সভাতেই মন্ত্রিসভা চূড়ান্ত করা হয়। মােশতাক তথাকথিত “সিনিয়রিটির দাবিতে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে-সম্ভাবনা তিরােহিত দেখে তিনি আক্ষেপ করে বলেন আমাকে আর কী দরকার? আমাকে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। সারারাত ধরে শলাপরামর্শের পর শেষ পর্যন্ত পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার শর্তে তিনি মন্ত্রিসভায় থাকতে রাজি হন। মােশতাকের দাবি অনুযায়ী মাহবুবুল আলম চাষী ও তাহেরুদ্দিন ঠাকুরকে আগরতলা থেকে কলকাতায় আনা হলে চাষীকে তিনি পররাষ্ট্র সচিব পদে নিয়ােগ। করেন। তিনি বাংলাদেশ মিশন’ থেকে পররাষ্ট্র ব্যতীত অন্যান্য বিভাগ সরিয়ে দেন।

তাজউদ্দিনের সাথে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব বা স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি ভিন্ন। মনােভাব, যে-কোনাে কারণেই হােক না কেন, মােশতাক মুজিবনগর সরকারের অনেক কাজেই বাধা সৃষ্টি করেন। তিনি তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে শেখ মণিসহ যুবনেতাদের উসকিয়ে দেন। যুদ্ধ চলাকালে তার ভাবশিষ্য তাহের ঠাকুর স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পীদের দিয়ে ধর্মঘট করার ‘পাকা ব্যবস্থা করে ব্যর্থ হন।  হানাদার কবলিত বাংলাদেশে যখন আমেরিকার অস্ত্রে ও সমর্থনে মরমেধ যজ্ঞ চলছিল, কলকাতার সার্কাস এভেনিউতে তখন সেই আমেরিকার সরকারি ও বেসরকারি নানা সাহায্যসংস্থা দানছত্র খুলে বসেছিল। বিদেশীদের ভিড়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে১. কর্নেল তাহেরের বিশ্লেষণ, মােশতাকের কোনাে রাজনৈতিক ভিত ছিল না, একটি ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া সমগ্ন সেনাবাহিনীতে তার সমর্থন ছিল না এবং জনগণের মধ্যেও তার সমর্থন ছিল না। (এএল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৮-২৯) আমীর-উল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৯৬ঢােকা মুশকিল ছিল। ওদের অধিকাংশই মার্কিন সাংবাদিক, সেবা ও সাহায্যসংস্থার কর্মকর্তা। এদের সার্বক্ষণিক সাথী হলেন মাহবুবুল আলম চাষী, তাহের ঠাকুর, হােসেন আলী, আর,আই. চৌধুরি, আনােয়ার চৌধুরি জয়, আমিনুল হক বাদশা, কর্নেল ওসমানী প্রমুখ এবং অবশ্যই ওদের নেতা খন্দকার মােশতাক।

কিছুদিনের মধ্যে জানা গেল, সরকারের গােপন ফাইলের বিষয়বস্তু ফাস হয়ে আমেরিকা, পাকিস্তানে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেখা গেল, মুজিবনগর প্রশাসনের একটা শক্তিশালী অংশ ভারত ও সােভিয়েট-বিরােধী সূক্ষ্ম প্রচারণা এবং গুজব ছড়াতে ব্যস্ত। তাজউদ্দিনের ভাষায়, ‘শত্রু এখন বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকেছে। ওরা ঔষধ, দুধ, কম্বল, নগদ টাকা, বিদেশ ভ্রমণের টিকেট প্রভৃতি দিয়ে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, মিলিটারি ও মুক্তিযােদ্ধাদের নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলার চেষ্টা করে। সরকারের মধ্যে তাদের গ্রুপ’ তৈরি করে। বেনামা প্রচারপত্র প্রকাশ করে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিলি করে।  আওয়ামী লীগের দলীয় মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ এবং যুব অংশের বাংলার বাণী থাকার পরও মােশতাক ‘অভিযান’ নামে নিজের একটি পত্রিকা বের করেন। পত্রিকাটিতে অতিকৌশলে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি ও তাজউদ্দিনবিরােধী প্রচারণা করা হত। মুক্তিযুদ্ধ যখন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের রূপ নিতে চলেছে তখন মােশতাক গ্রুপ ‘স্বাধীনতা, না মুজিব?’ শিরােনামে একটি প্রচারপত্র মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিলি করেন। প্রচারপত্রটির বক্তব্য ছিল :আমরা যদি পাকিস্তানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করি, তাহলে পাকিস্তানিরা। কারাগারে শেখ মুজিবকে হত্যা করবে। শেখ মুজিবকে ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।

সুতরাং স্বাধীনতার আগে মুজিবের মুক্তি দরকার এবং মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তানের সাথে আলাপ-আলােচনা দরকার। প্রচারপত্রটি মুক্তিযােদ্ধাসহ সকল মহলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। একই সাথে তারা কৌশলে গুজব ছড়ালেন যে, তাজউদ্দিন পাকিস্তানের সাথে কোনাে আলাপ-আলােচনাসমঝােতা চান না, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান কারণ তিনি চান জেলে শেখ মুজিবের মৃত্যু হােক। তাহলে তিনি নির্বিঘ্নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদটি স্থায়ীভাবে পাবেন, ভাগ্যবিধাতা হবেন। (এ প্রচারণাটি স্বাধীনতার পর বেগম মুজিব এবং মুজিবের কানেও তােলা হয়। তাজউদ্দিনের সাথে মুজিবের সম্পর্কের অবনতিতে এটি কোনাে ভূমিকা রেখেছে কিনা, গবেষকরা তা খুঁজে দেখতে পারেন। মােশতাক এ প্রচারণার মাধ্যমে তাজউদ্দিন ও স্বাধীনতা উভয়ের বিরােধিতা করে এক ঢিলে দু-পাখিই মারতে চেয়েছিলেন)।জাতিসংঘের লবিতে বাংলাদেশের বক্তব্য পেশ করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে মােশতাকের নিউইয়র্ক যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তার সচিব মাহবুবুল আলম চাষী কর্তৃক২. আবদুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশ পনেরই আগস্ট পচাত্তর, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৫৪ওয়াশিংটনে প্রেরিত একটি গােপন বার্তা ধরা পড়ে। বার্তায় পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে মার্কিন সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে আলােচনা শুরু করার জন্য ওয়াশিংটনে নিযুক্ত বাংলাদেশ প্রতিনিধিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তাজউদ্দিন সাথে সাথে চাষীকে বরখাস্ত করেন, মােশতাকের নিউইয়র্ক যাত্রা বাতিল করেন এবং তার বদলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘ লবিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার নির্দেশ দেন। এ ঘটনার পরও সৈয়দ নজরুলের আনুকূল্যে মােশতাক বেঁচে যান।

তবে মন্ত্রী থাকলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজে তাকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয় এবং স্বাধীনতার পরপর ২৯ ডিসেম্বর তার হাতে আইন মন্ত্রণালয় রেখে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। আমেরিকার সাথে মােশতাক গংদের যােগাযােগ প্রসঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জার বলেন : We established contact with the Bangladesh people in Calcutta and during August, September and October of this Year (1971), no fewer than eight such contacts took place. We approached President Yahya Khan three times in order to begin negotiations with Bangladesh people in Calcutla. The government of Pakistan accepted. মােশতাক গং শেষদিকে এত মরিয়া হয়ে গিয়েছিল যে, ১৩ ডিসেম্বর বরখাস্তকৃত চাষী মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব স্বাক্ষরের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের কাছে নিয়ে যায়। অথচ পরিস্থিতি তখন এমন পর্যায়ে যে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কর্তৃক স্বাক্ষর করা হলেও যুদ্ধবিরতি তখন সম্ভব হত না। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ মুজিব তার সােনার বাংলায় প্রত্যাবর্তন করেন। সবাই করমর্দন, কোলাকুলি করলেও মােশতাক অতিরিক্ত একটি চুম্বন দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। 

৩১ মে ১৯৭৪ মুজিবের মা সায়রা খাতুন মারা যান। মুজিব তার মায়ের জন্য যতনা কাঁদলেন, তারচেয়ে বেশি কাদলেন মােশতাক। মায়ের দাফন কাজে টুঙ্গীপাড়ায় মুজিবের সফরসঙ্গী হলেন মােশতাক ও তাহের ঠাকুর। আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ থাকায় হেলিকপ্টার কয়েকঘন্টা আকাশে উড়তে পারেনি। ফলে তাদের পৌছতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়। মুজিব মাকে স্পর্শ করতে চাইলে তার বড়বােন মিসেস ফাতেমা অনুমতি দিলেন না। কিন্তু মােশতাক অলক্ষে কাছে গিয়ে খালাম্মার মাথা স্পর্শ করেন।  সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাঙালি মােরারজী’ মােশতাক ছিলেন মুজিবের ‘ছায়া-সহচর। যখন তখন তিনি মুজিবের বাড়িতেও যেতেন। তিনি ছিলেন মুজিবের সকল ছেলেমেয়ের বিশেষ করে রাসেলের খুব প্রিয় চাচা। মুজিবের সামনে তিনি থাকতেন ভেজা বেড়াল হয়ে, বলতেন মন ভেজানাে কথা। এসবের পুরস্কারও তিনি৪. ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯০ India Pakistan, Background briefing with Henry A. kissinger on December, 1971, Congressional record, December-9, 1971, Page 15735, মঈদুল হাসানের মূলধারা গ্রন্থে উদ্ধৃত ড, মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২৯০পেয়েছেন। বহুবার তার বহু অন্যায় মুজিব ক্ষমা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বাসঘাতকতার জন্য বিচার না করে মুজিব তাকে আইনমন্ত্রী থেকে প্রমােশন দিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী করেন।

বাণিজ্যে তার লক্ষ্মীর বসতি হয়েছিল। ধর্মের ধ্বজাধারী হয়েও তিনি ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অবশেষে জড়িয়ে পড়েন মুজিবকে হত্যা করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ষড়যন্ত্রে। মুজিব-হত্যা মামলার রাষ্ট্রপক্ষের মূল কৌসুলি সিরাজুল হক তার ফিরতি আরগুমেন্টের সমাপ্তিকালে বলেন, মােশতাক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা তিন আর্মি অফিসারকে নিয়ে কুমিল্লায় ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত করে, পরে ঢাকায় তা বাস্তবায়ন করা হয় ১৫ আগস্ট পঁচাত্তরে।’ মামলার অন্যতম আসামি তাহের , রশিদ, ফারুক ও সাক্ষী অধ্যাপক খুরশিদ আলমের বক্তব্য থেকে জানা যায়, মােশতাক ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীরা কুমিল্লার বার্ড, মােশতাকের গ্রামের ও ঢাকার বাড়ি, মন্ত্রণালয়, গাজীপুরের সালনা প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন সময় মিলিত হয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে। মােশতাকের মুজিব-হত্যা পরবর্তী কার্যক্রম থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যবর্তী রাতে মােশতাকের চোখে ঘুম ছিল।। সেদিন তার ৫৪ নম্বর আগা মসীহ্ লেনের বাড়িতে অনেকের মধ্যে মেজর রশিদ ও তাহের ঠাকুর এসেছিলেন। কোনাে ফোন এলে তিনি নিজেই রিসিভার উঠাচ্ছিলেন, সীমাহীন অস্থিরতায় নিজেকে ঠিক রাখার জন্য তিনি দোয়া-দরুদ পড়ছিলেন। রাতে গােসল করে তিনি যেন কোথায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন।

অবশেষে তার প্রতিক্ষার অবসান হল পরদিন সকাল সাড়ে ৭টায়। একটা ট্যাঙ্ক পেছনে নিয়ে রশিদের জিপ এসে থামে তার বাড়ির সামনে। ডালিমের মারাত্মক বেতার ঘােষণা ইতােমধ্যে প্রচার হয়ে গিয়েছে। তিনি নেমে এলেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘রেডিও অফিসে যাওয়ার জন্য। এর আগে রশিদের আগমনের উদ্দেশ্য পরীক্ষার করে নেন নানা নাটকীয়’ কৌশলে।  তাহের ঠাকুর তার আগেই রেডিওতে পৌছে প্রেসিডেন্টের ভাষণ রচনায় নিয়ােজিত হন। সামরিক ও পুলিশবাহিনী প্রধানদের ওকালতি বুদ্ধিতে ফাঁদে ফেলে। মােশতাক ‘বেসামরিক ও গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের সম্মতি ও আনুগত্য আদায় করে। নেন এবং বেতারে তা প্রচার করাতে থাকেন। বেলা ১১-১৫ মি, তিনি নিজে ভাষণ দেন এবং বলেন, সকলেই এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন চাইছিল। কিন্তু প্রচলিত নিয়মে তা সম্ভব ছিলনা বলে ঐতিহাসিক প্রয়ােজনে সেনাবাহিনী এগিয়ে এসে জনগণের জন্য সুযােগের স্বর্ণদ্বার খুলে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলার পরিবর্তে ‘পাকিস্তানি কায়দায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে তিনি ভাষণ শেষ করেন। সামরিক আইন ও কাফু জারি করা হলেও দুপুরে জুম্মার নামাজের জন্য তা শিথিল করা হয়।

৭. ড. মােহাম্মদ হাননান, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ইতিহাস, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৬৮ এ এল খতিব, কারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০সব মিলিয়ে একটা ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়। হত্যাকাণ্ডের পর মােশতাক দায়িত্ব গ্রহণের ১ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। অল্পসময়ের মধ্যে মােশতাক তার বিশেষ দূত হিসেবে দালাল পীর দুদু মিয়াকে পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। এছাড়া শফিউল আজম, তােবারক হােসেন, সালাহউদ্দিন, এবিএম সফদর প্রভৃতি দালালকে গুরুত্বপুর্ণ সরকারি দায়িত্বে নিয়ােজিত করেন। পাকিস্তানি পােশাকের সাথে তার টুপি যােগ করে জাতীয় পােশাক’ প্রবর্তন করেন। এসব তার ১৯৭১ -এর অতৃপ্ত বাসনার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হয়। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে, তার বিরােধী বা প্রতিদ্বন্দ্বীদের ফাঁসিতে ঝােলানাের জন্য মােশতাক একটি ফরমান জারি করেন। এতে বলা হয়, কোনাে ব্যক্তি যদি দুর্নীতি করে বা কারাে বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ ওঠে (reputed to be corrupt) তাহলে তাকে বিচারপূর্বক মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে।  বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘােষণা না করায় এবং মন্ত্রীসভায় আওয়ামী লীগাররাই নিয়ােগ পাওয়ায় মানুষ এই হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্রপতি পদে মােশতাকের অধিষ্ঠান ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছিল না। বরং ক্রমে মানুষের মনে মুজিবের প্রতি সহানুভূতি বাড়তে থাকে। ২৪ সেপ্টেম্বর তার চল্লিশার দিনের ‘গুরু গম্ভীরতা হত্যাকারীদের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশের নামান্তর হিসেবে বিবেচিত হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর “দি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫-এর মাধ্যমে হত্যাকারীসহ হত্যার পরিকল্পনা, কুমন্ত্রণা প্রভৃতির সাথে যুক্ত সকলকে বিচারের হাত থেকে রেহাই দেয়া হয়।

তবে এটি করা হয় গােপনে। তাছাড়া ৩ অক্টোবর প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে তিনি খুনীদের ‘সেনাবাহিনীর সাহসী সূর্যসন্তান বলে প্রশংসা করা ছাড়াও ডালিম, ফারুক আর রশিদকে প্রমােশন দিয়ে লে. কর্নেল পদে উন্নীত করেন। এসব কাজে মুজিব হত্যায় মােশতাকের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়। মীরজাফর শব্দটি যেরূপ বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিশব্দে রূপান্তরিত হয়েছে; মােশতাক শব্দটিও প্রায় অনুরূপ ব্যঞ্জনার দ্যোতক। আবদুল গাফফার চৌধুরী ক্লাইভের ওপর লেখা একটি প্রাচীন বই পাঠ করতে গিয়ে মীরজাফরের চারিত্রিক ও শারিরীক বৈশিষ্ট্যের সাথে মােশতাকের বিস্ময়কর মিল দেখে চমকে উঠেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরও কিছু মিলের সন্ধান পেয়েছেন। যেমন : সিরাজ-হত্যা আর মুজিব-হত্যার ষড়যন্ত্রের সূচনা একই এলাকায়, পুরনাে ঢাকায় আগামাসিহ লেন-নওয়াব গঞ্জে। পলাশীর ‘৫৭ কে উল্টিয়ে সাজালেই হয় ‘৭৫। মাঝখানে ২১৮ বছরের ব্যবধান। তাই পাত্রপাত্রীর বদল, কিন্তু নাটক একই।৯. ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ অবৈধভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে প্রদত্ত ভাষণে মােশতাক বলেন, ‘এই সরকার কখনও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, কিংবা সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আপস করবে না। কিন্তু মাত্র ৮৩ দিনের ক্ষমতাচ্যুতির পর তিনি দুর্নীতির অভিযােগে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ভােগ করেন। (এ এল খতিব, কারা মুজিবের হত্যাকারী? পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ২১০)।

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান

 

Readers comments

Paritosh Sarker ১৯৭৩সাল । জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আমি তখন গৌরীপুর ডিগ্রী কলেজের বি.কম ক্লাশের ছাত্র। সেই নির্বাচনে মোস্তাকের নৌকা ডুবু ডুবু। কলেজমাঠে এক জনসভায় এই মীরজাফর বক্তৃতায় বলেছিল বাংলার ইতিহাস যদি লেখা হয় তবে একদিন দাঈদকান্দির ইতিহাস লেখা হবে। আজও ভাবি সেদিন এই জাফরআলী পরের সব কিছুর ইংগিত করেছিল কিনা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!