শহর করিমগঞ্জ ও যুদ্ধের এক পক্ষ
(স্টাফ রিপাের্টার)
২১শে নভেম্বর করিমগঞ্জ শহরের উপর পাক-হামলার মােকাবিলায় শহরবাসী যে মনােবল দেখিয়েছিলেন, ৩রা ডিসেম্বর থেকে যখন সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তখনও কিন্তু তাতে ঘাটতি পড়ে নি। ব্লাক আউটের দরুণ রাত্রি বেলাটা একটু নির্জন, কিন্তু এমনিতে শহর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং সচল। ঘুমের ব্যাঘাত অবশ্য সবারই হচ্ছে, সেটা গােলাবর্ষণের শব্দে এবং তজ্জনিত মাটির কাঁপুনিতে। শব্দের সেই বিকটতা কিন্তু কাউকে আতংকগ্রস্থ করে নি। গত আট মাসে শহরবাসী যতখানি শব্দ-সচেতন হয়েছেন, ঠিক ততখানিই সাহসী হয়েছেন। চূড়খাই-গােলাপগঞ্জের পতন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধের এই শাব্দিক অস্তিত্বটুকু থাকবেই।
রেডিওর দুটি ঘােষণাতে শহরবাসী স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ প্রকাশ করেছেন। ৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বীকৃতিতে এবং ৭ই ডিসেম্বর শ্রীহট্টের পতনের সংবাদে। দ্বিতীয় ঘটনাটি এই শহরবাসীর কাছে নিঃসন্দেহে একটা ব্যাপক আনন্দের বিষয় কারণ শ্রীহট্টের সঙ্গে নাড়ীর যোেগ এখনও সবাই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেন। ফলে আনন্দের প্রকাশটাও একটু লাগাম ছাড়া হয়ে গিয়েছিল, যে কারণে প্রচার বিভাগকে শেষ পর্যন্ত বাজী না পোড়ানোর জন্য ঘোষণা করতে হয়েছিল।
সাইরেন বাজল দু’দিন, প্রথম দিনে একটু হতচকিত ভাব ছিল, কিন্তু কোনরূপ বিশৃঙ্খলা হয় নি। দ্বিতীয় দিনের সাইরেন বাজার পর শহরবাসীর অভিব্যক্তির মধ্যে কোনরূপ আতংকের ভাব ছিল না, যদিও ঐ সময়েই শহরের পাশে এক জনের মৃত্যু ঘটল। শহরবাসীর এই অতি-নিরাপত্তা বােধ এবং তজ্জনিত আত্মতুষ্টি অসামরিক প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালনে বেশ একটু অসুবিধার সৃষ্টি করে, একথাটা অনেকেই ভুলে যান। সঙ্গত অসঙ্গত যে কোনও কারণেই ঘটুক না কেন, জনসাধারণকে এই ধরণের সরকারী নির্দেশ পুরােপুরি মেনে চলা উচিত, কারণ যুদ্ধের সময়ে সুশৃঙ্খল বাবহার করা যুদ্ধ প্রস্তুতিরই একটা অঙ্গ। স্কুলগুলােতে পরীক্ষা হচ্ছে এবং ছাত্র-ছাত্রীরা সাইরেনের শব্দে ট্রেঞ্চে ঢুকছে, আবার অল ক্লিয়ার বাজলে বেরিয়ে এসে পরীক্ষা দিচ্ছে, দৃশ্যটা বেশ অভিনব এবং আনন্দকর।
সূত্র: যুগশক্তি, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১