দিক-দর্শন
আমাদের জোয়ানদের যেমন দেখেছি সেনাবাহিনী সম্পর্কে সাধারণ মানুষের একটা ভীতি আছে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা (যার মধ্যে ভারতীয় সৈন্যরাও ছিল) নাগরিক জীবনে অসামাজিক উচ্ছঙ্খলার যে বন্যার সৃষ্টি করেছিল, মূলতঃ তা থেকেই এই ভীতির জন্ম। গৌহাটি বা শিলচরেও কিছু দিন আগে পর্যাপ্ত সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে সেনা বাহিনীর লােকদের মনােমালিন্য ও পরিমাণে]মে অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদও আছে, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার কারণ অত্যন্ত নগন্য। তবুও এ যুদ্ধেও প্রস্তুতিতে করিমগঞ্জ শহরের বুকে যখন বেশ কিছু সৈন্য সমাবেশ ঘটল, তখন অনেকেই আশঙ্কা বােধ করেছিল, সেই পুরনাে ভয়ের সুত্রে।
বিগত ক’ মাসে শহরবাসী আমাদের সৈন্যদের যে অন্তরঙ্গ পরিচয় পেয়েছেন, তাতে এদের শৃঙ্খলা পরায়ণতা, সৌজন্যবােধ ও পরিচ্ছন্ন নাগরিক চেতনা সম্পর্কে অতি বড় সমালােচকও সােচ্চার না হয়ে পারেন নি। সেনাবাহিনীর আবাসস্থল ছিল শহরের ঠিক মধ্যস্থলে তিনটি প্রতিষ্ঠানে, যার অতি সংলগ্ন মেয়েদের কলেজ এবং একটি মেয়েদের স্কুল। এমন একটি ঘটনাও কেউ উল্লেখ করতে পারেন নি যে জোয়ানদের আচরণে পথচারিণী অজস্র ছাত্রীদের বিব্রতবােধ করার একটি বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্তও আছে। আমাদের জোয়ানদের যুদ্ধ যাত্রা দেখার জন্যে অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ নারীরাও পথের পার্শে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে ভীড় জমাতেন, কোনও দিনই কোনও অশালীন দৃষ্টি তাদের বিব্রত করে নি। প্রাক স্বাধীনতা যুগে একটা ধারণার অতীত ছিল। সেনাবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেছি তারা প্রথমেই জোর দিয়ে বলেছেন যে নাগরিক জীবনের কোনরূপ অস্বাচ্ছন্দ্য ঘটিয়ে কোন সুযােগ তারা নিতে চান না। তাদের অধীনস্থ জোয়ানরা অক্ষরে অক্ষরে সে কথার মর্যাদা রেখেছেন। শহরের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রিক্সাচালক, মুটে-মজুর অনেকের সঙ্গেই সেনাবাহিনীর লােকদের প্রয়ােজনে সংশ্রব রাখতে হয়েছে, কিন্তু কোন ক্ষেত্রে দাপট দেখানাের কোন প্রবণতা দেখা যায় নি। বরঞ্চ জনসাধরেণের কৌতুহলী ভীড় জোয়ানদের কর্তব্য কর্মে কোন কোন সময় অসুবিধা সৃষ্টি করেছে, কিন্তু ওরা হাসিমুখে সেটুকু সহ্য করে যথাসম্ভব জনতার কৌতুহল নিবৃত্তির চেষ্টা করেছেন। জকিগঞ্জ অপারেশনের সময়ে এবং তারপর নদীর পাড়ে অজস্র জনতার ভীড় সেনাবাহিনীকে পয্যাপ্ত ঝামেলায় ফেলেছে, কিন্তু খােদ যুদ্ধের মুখােমুখি দাঁড়িয়েও আমাদের জোয়ানদের সৌজন্যবােধে ঘাটতি দেখি নি।
এ কথাগুলাে সবিস্তারে বলতে হচ্ছে এজন্য যে বৃটিশ সরকার তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার জন্যে ভারতে যে সৈন্যবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন, তাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সহযােগিতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু স্বাধীনতার পর গত ২৩ বৎসরে এই সৈন্যবাহিনী সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক চেতনা দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে জনসাধারণের যথার্থ সেবকে রূপান্তরিত হয়েছেন। যে সমস্ত সমর নায়ক ও অফিসারদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনীর মধ্যে এই চরিত্রিক আমুমূিল পরিবর্তন হয়েছে,তারা আমাদের কৃতঞ্জতার পাত্র। আমাদের সেনাবাহিনীর বীরত্বে গােটা বিশ্ব আজ মুখর, আর আমরা এই সীমান্ত সহরের অধিবাসীরা সেই বীরত্বের সঙ্গে যে বিনম্র সামাজিক চেতনার বিকাশ জোয়ানদের মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি, অকুণ্ঠচিত্তে তার সানন্দ ও সােচ্চার স্বীকৃতি জানাচ্ছি।
১৯৭১- একটি গুরুত্বপূর্ণ বৎসরের অবসান
১৯৭১ সালের সমাপ্তিতে আমরা আগ্রহভরা চিত্তে নবাগত বৎসরকে স্বাগত জানাইতেছি। যে বৎসরটি আমরা পিছনে ফেলিয়া আসিলাম নানা কারণে তাহা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, বস্তুতঃ স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর জাতীয় জীবনে। এত গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী ঘটনা প্রবাহে সমৃদ্ধ বৎসর আর আসে নাই। ৭১ সালের মার্চ মাসে লােকসভার অন্তবর্তী নির্বাচনে দেশের জনসাধারণ অকুণ্ঠ চিত্তে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর উপর জাতীয় নেতৃত্বেও দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছিল। অতঃপর ২৫শে মার্চের পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ, এক কোটি উদ্বাস্তুর বােঝা, পাকিস্তানী রণপ্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাকিস্তানী জঙ্গীশাহীর বর্বর আক্রমণ আমাদের জাতীয় জীবনকে সম্পূর্ণ বিপৰ্য্যস্ত করিয়া তােলার উপক্রম করিয়াছিল। সৌভাগ্যবশতঃ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এবং আপামর দেশবাসীর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তায় এই দুৰ্যোগকে আমরা যথার্থভাবে মােকাবিলা করিতে সক্ষম হইয়াছি এবং বিগত বৎসরের অন্তিম লগ্নটিতে ভারতবর্ষের ভাগ্যাকাশে নূতন আলাের সঞ্চার আমরা দেখিতেছি। বিগত বৎসর ভারতবর্ষকে আত্মবিশ্বাস এবং বাস্তবমুখিতার ভিত্তির উপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। বিশের শােচনীয়তম উদ্বাস্তু সমস্যাকে স্বীয় আর্থিক ক্ষমতায়ই আমরা মানবিক আশ্রয় দিয়াছি, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের সংকটকে আমরা নিজস্ব শক্তিতেই ন্যায়নিষ্ঠ সমাধানে অনুপ্রাণিত করিয়াছি, সর্বোপরি ভারতবর্ষ বিশ্ব রাজনীতির দাবা খেলায় এখন যে আর অসহায় দর্শকের ভূমিকায় বসিয়া থাকিতে রাজী নয় তাহা সন্দেহাতীত রূপে প্রমাণ করিয়াছি। বৃহৎ শক্তি গােষ্ঠির ভ্রকুঞ্চন এবং আর্থিক সাহায্য বন্ধের হুমকি যে একটি সাবালক এবং মৰ্য্যাদাসম্পন্ন জাতির পক্ষে কোন দুরতিক্রম বাধা নয়, বিশ্বের দরবারে তাহাও প্রমাণিত হইয়াছে। দুইশত বৎসরের পরাধীনতা এবং তৎপরবর্তী ২৪ বৎসরের অতি সতর্ক বৈদেশিক নীতির জাঁতাকলে আমরা বিশ্বের দরবারে প্রায় এলে বেলের পর্যায়ে পৌছিয়াছিলাম, বিগত বৎসরের ঘটনা প্রবাহে সেই দুর্গতির অবসান হইয়াছে, ভারত আজ আবার জগৎ সভায় সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। আগামী বৎসরে দেশবাসীকে হয়তাে আরাে গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হইতে হইবে, কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে নূতন ভাবধারায় অনুপ্রাণিত জাতি আভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক যে কোনও ধরণের সংকটের মােকাবিলা করিতে আজ সম্পূর্ণ প্রস্তুত, কারণ আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং আদর্শ নিষ্ঠা আজ বাস্তব ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।
সূত্র: যুগশক্তি, ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭১