You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতের সেনাবাহিনী সজাগ
পাক অনুপ্রবেশ সহ্য করব না
করিমগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর দৃপ্ত ভাষণ

বিগত ১১ই জুন শুক্রবার অপরাহ্ন বেলা সাড়ে তিন ঘটিকার সময় করিমগঞ্জ গভর্ণমেন্ট হাইয়ার সেকেণ্ডারী স্কুলের খেলার মাঠে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী এক দৃপ্ত ভাষণে বলেন ভারতবর্ষ বিরাট দেশ, ভারতে বহু সম্প্রদায় ও বহু ভাষাভাষী লােকের বাস, ভারতের আয়তনও অনেক বৃহৎ, ভারতের বহু সমস্যা ও অভাব অনটন রয়েছে—তা সত্বেও ভারত-বাংলাদেশের ছিন্নমূল শরণার্থীদের আশ্রয় ও সাহায্য দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তিনি আরও বলেন, দেশের আয়তনের উপর দেশের মহত্ব নির্ভর করে না দেশের মহত্ব নির্ভর করে দেশবাসীর আদর্শ ও চিন্তাধারার উপর। প্রধান মন্ত্রী বলেন যে, কয়েকমাস সরকারের পরিচালনার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচনে বিপুল ভােটাধিক্যে আওয়ামী লীগকে জয়ী করে বাংলাদেশের জনগণ চেয়েছিল তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং এই কামনার ফলে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনীর জঘন্যতম নারকীয় ঘটনাবলী।
বাংলাদেশে পাক জঙ্গীশাহী সরকারের অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে লক্ষ লক্ষ নরনারী তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য ভারতের মাটীতে চলে আসছেন মানবতার খাতিরে আমাদিগকে তাদের আশ্রয় ও সাহায্য দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন বাংলাদেশের সমস্যার উপর সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে পাকিস্তান ভারতে দাঙ্গা বাধাবার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। আমাদের এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ভারতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতেই হবে।
শ্রীমতী গান্ধী আরও বলেন শরণার্থীদের অনুকূলে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠছে। সারা পৃথিবী জুড়ে পাকিস্তানের বর্বর অত্যাচারের কাহিনী প্রচারিত। কিন্তু এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব ভারতকেই বহন করতে হবে। পৃথিবীর গণতান্ত্রিক বিভিন্ন দেশ ভারত সরকার মারফত বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায্য দানে অগ্রসর হয়েছেন। আন্তর্জাতিক সাহায্য আসতে আরম্ভ করেছে, আরও আসবে বলে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বাস করেন। শ্রীমতী গান্ধী আরও বলেন বাংলাদেশে যা ঘটছে তা শুধু পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার নয়, ভারত কোনও অবস্থায় ইহাকে উপেক্ষা করে চলতে পারে না।
শ্ৰীমতী গান্ধী বলেন, আমরা ভারত থেকে দরিদ্রতা দূর করার সঙ্কল্প নিয়েছি—আমাদের এই সকল কর্তব্য ব্রতী হওয়া কালীন পাকিস্তান আমাদের এক বৃহৎ বােঝা চাপিয়ে দিয়েছে। আমাদিগকে সাহসের সহিত এর মােকাবিলা করতে হবে পাকিস্তান আমাদের পবিত্র ভূমির প্রতি কখনও ত্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই আমরা তার সমুচিত জবাব দেব। ভারতীয় এলাকায় পাকসেনার অনুপ্রবেশ কখনও বরদাস্ত করা হবে না, আমাদের সেনাবাহিনী সতত সজাগ রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আসেন ভারতীয় রেডক্রস সােসাইটীর সভাপতি কুমারী শ্ৰীমতী পদ্মজা নাইডু, আসামের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমহেন্দ্র মােহন চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী শ্রী কে, সি, পন্থ।
করিমগঞ্জের জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পূর্বে আসামের মুখ্যমন্ত্রী বর্তমান সংকটজনক পরিস্থিতি কালে প্রধানমন্ত্রীর করিমগঞ্জ পরিদর্শনের জন্য করিমগঞ্জ তথা সমগ্র আসামের জনগণের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন জ্ঞাপন করে বলেন পাকিস্তানের প্ররােচনামূলক উত্তেজনা ও উস্কানি সত্বেও করিমগঞ্জবাসী জনসাধারণ যে সাহস ও ধৈয্যের পরিচয় দিতেছেন তা গৌরবের বিষয়। তিনি আরও বলেন যে শরণার্থীর বেশে কিছু সংখ্যক পাকগুপ্তচর ভারতে প্রবেশ করে ভারতের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ক্ষুন্ন ও সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা বাঁধাবার চেষ্টা করছে এ ব্যাপারে সকলে যেন সতর্ক থাকেন।প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কুম্ভীরগ্রাম বিমান ঘাটি থেকে মােটর যােগে কালীগঞ্জ শরণার্থী শিবির হয়ে দুপুরে করিমগঞ্জ পৌছেন। পথে পেট্রলপাম্পের মােড়ে তাঁকে সহস্র লােক বিপুলভাবে সম্বর্ধনা জানায়।
নারী নাগরিক প্রতিরক্ষা বাহিনীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটী অফিসের সামনে প্রধানমন্ত্রী গাড়ী থামালে ত্রাণ কমিটীর কর্মী শ্রীমিহির রায় একটা পুষ্পস্তবক দান করেন। করিমগঞ্জ সারকিট হাউসে মধ্যাহ্ন ভােজন সমাপনের পর জেলা কংগ্রেস, মহকুমাপরিষদ ও বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটী, পৌরসভা প্রভৃতির পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রী জনসভায় যােগদানের পূর্বে বাংলাদেশ ত্রাণ কমিটীর প্রতিনিধি শ্রীসুরেশ চন্দ্র দেব, নলিনী কান্ত দাস, মন্মথ নাথ দত্ত, ভূপেন্দ্র কুমার সিংহ এবং দক্ষিণা রঞ্জন দেবের সহিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে রুদ্ধদ্বারকক্ষে প্রায় ২০ মিনিট কথা বলেন। অতঃপর শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ থেকে আগত আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে প্রায় দশ মিনিট আলােচনা করে জনসভায় যােগ দেন।
জনসভা অনুষ্ঠান সমাপ্তির পরই শ্রীমতী গান্ধী ঝড় বৃষ্টির মধ্যে শীকে, সি, পন্থ, শ্রীমহেন্দ্র মােহন চৌধুরী ও শ্রীমতী পদ্মজা নাইডু সহ দাসগ্রাম অভিমুখে রওয়ানা হন। দাসগ্রাম শরণার্থী শিবিরে প্রায় আধাঘণ্টা সময় অতিবাহিত করে প্রত্যেক শরণার্থী পরিবারের সহিত মিলিত হওয়ার চেষ্টা করেন এবং শরণার্থীদের মুখে বাংলাদেশে বৰ্ব্বরতার কাহিনী শুনেন। দাসগ্রাম থেকে শিলচর অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার পথে শ্রীমতী গান্ধী পাক-গুলি বিধ্বস্ত সুতারকান্দি অঞ্চল পরিদর্শন করেন এবং স্থানীয় লােকের অবস্থা সম্বন্ধে ব্যক্তিগতভাবে ওয়াকিবহাল হন।

সূত্র: দৃষ্টিপাত, ১৬ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!