বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্ত্রী শ্রী আলতাফ হােসেন মজুমদার
পূর্ব বাংলার ঘটনাবলী সম্পর্কে আসাম বিধান সভায় বিতর্ককালে পূর্তমন্ত্রী শ্রী আলতাফ হােসেন মজুমদার তীব্র ভাষায় ঘটনাবলীর সমালােচনা করেন।
তিনি বলেন, আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করতে চাচ্ছি সেটা আন্তর্জাতিক সমস্যাই নয় এটা আসামের সমস্যা বটে। এটা এখন আর পাকিস্তানের আভ্যন্তরিক সমস্যা নয়। সীমান্তের অপর পারে মহিলা শিশু নির্বিশেষে নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় আমরা কিছুতেই নির্লিপ্ত থাকতে পারি না। সকলেরই নিশ্চয়ই স্মরণে থাকবে আয়ুব খার নিকট থেকে ইয়াহিয়া খা যখন পাকিস্তানের এক নায়কত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন তখন তিনি বলেছিলেন আমি যদিও শাসনভার গ্রহণ কচ্ছি তবু আমার উদ্দেশ্য হবে গণতান্ত্রিক কোন সরকারের কাছে এটার দায়িত্ব অর্পণ করা। তার এ ঘােষণায় জনসাধারণ সেদিন অবাক হয়ে ভেবেছিল জঙ্গী শাসক কি সত্যিই এভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন? কোন স্বেচ্ছাচারী রাজা কি কখনাে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা চাইতে পারেন? জনসাধারণ যখন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছয় জঙ্গী শাসন তখন টিকে থাকতে পারেনা ইতিহাসই বার বার তার সাক্ষ্য দিয়েছে যে স্বৈরাচারী রাজ্য বারবার বিলােপ হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে।
পাকিস্তানের বিশেষ করে বাংলাদেশের জনসাধারণ মানসিক দিক দিয়ে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিক দিয়ে প্রস্তুত এবং তাদের জয় অবশ্যম্ভাবী শ্রীরথীন্দ্রনাথ সেন সঙ্গতভাবেই বলেছেন ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের জনসাধারণ তথা গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সুদীর্ঘ আলােচনা করেন। শেখ মুজিবুর দাবী করলেন নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করতে হবে। কিন্তু আপনারা জানেন ইয়াহিয়া খান একটা সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর সৈন্যবাহিনী মেয়ে শিশু সহ হাজার হাজার নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করল।
ব্যাপারটা ঘটে গেল আমাদের প্রতিবেশী রাজ্যে। তবে এটা অত্যন্ত আনন্দের কথা আসামের জনসাধারণ পত্র পত্রিকা, জনসভা এবং বিধানসভার মাধ্যমে তাদের অসন্তোষ উদ্বিগ্নতা ও ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।
আমি আরাে আনন্দিত হয়েছি যে শেখ মুজিবুর রহমান প্রমাণ করে দিয়েছেন সংস্কৃতি ও প্রশাসন ক্ষেত্রে ধৰ্ম্ম কখনই বাধ সাধতে পারে না। দ্বিজাতি ততৃত্তি] ও ধর্মের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনসাধারণকে বুঝিয়ে দিয়েছেন জাতি গঠনে ধৰ্ম্মই সব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানী তথা জঙ্গী একনায়কত্ব এটা পছন্দ করছেন না। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ হয়ে উঠবে জঙ্গী শাসকরা তা পছন্দ করেন না। আমরা আশা করব সুদিন আসুক আর দুই দেশের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে উঠুক। আমি বিশ্বাস করি মুজিবুর রহমানের অনুগামীরা অর্থাৎ বাংলাদেশের জনগণ যে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সংগ্রামে নেমেছেন তার জয় হবেই।
এই সংগ্রাম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ভারতীয় জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছে। ইতিহাসে নজীরবিহীন বাংলাদেশে এই অত্যাচারে মাননীয় সদস্যরা সম্ভাবতঃই উত্তেজিত বােধ করবেন। আমি সদস্যদের সঙ্গে একমত যে ভারতের শুধুমাত্র নৈতিক সমর্থনই এ কাজের জন্য যথেষ্ট নয়। এই উপমহাদেশে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতের সর্বোতভাবে সাহায্য করা প্রয়ােজন।
রাজনীতিবীদ এবং জঙ্গী শাসকদের এই থেকে শিক্ষণীয় যে বন্দুকের নল থেকে শক্তির সঞ্চার হয় না। শক্তি আসে জনসাধারণের একাগ্রতা ও আদর্শবাদ থেকে আমি বিশ্বাস করি জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলার সাড়ে সাত কোটী সন্তানের সংগ্রাম যে সকল বীর সন্তান এর জন্য লড়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভূতি জানাচ্ছি। সবুজ প্রান্তরে বাংলায় এই তাদের অভিসিক্ত স্বাধীনতা এনে দেবেই। যারা এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রাণ হারালেন আর বাংলার এ সকল বীর সন্তানদের ঝড়া রক্ত কখনই বিফল যেতে পারে না। তা থেকেই জন্ম নেবে নতুন জাতি। ইতিহাস নতুন গতিপথে এগিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র দীর্ঘজীবি হউক।
সূত্র: দৃষ্টিপাত, ২৮ এপ্রিল ১৯৭১