You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতীয় মুসলমানের প্রতি পাকিস্তানের দরদ

ভারতীয় মুসলমানদের উপর পাকিস্তান সরকারের দরদের বাহার দেখছেন! বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে তাদের আবেগভরা কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয় ভারতীয় মুসলমানদের উপর মমত্ব দেখিয়ে। ভারতের মুসলমানদের নাকি চরম সংকটতম দুর্দশার মধ্যে দিয়ে দিনক্ষয় করতে হচ্ছে, আর তারই জন্য তাদের মমতা একেবারে উথলিয়ে উঠেছে। তাদের কণ্ঠস্বরে আবেগ আছে, আছে সহানুভূতির কপটস্বর। সেই কপটতাপূর্ণ মিথ্যা মমতৃবােধ দিয়ে বেতারে প্রচারিত হয় ভারত সরকারের প্রতি বিদ্রুপবান। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার উপর কলংক লেপনের মিথ্যা প্রয়াস পাকিস্তান গলাবাজিতে প্রকাশ করতে চায়, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি সকলই ভুয়াে আর সেই ভুয়াে ধর্মনিরপেক্ষতার সুযােগ নিয়ে ভারত সরকার নাকি এখানের সমস্ত মুসলমান। সম্প্রদায়ের উপর চালিয়ে যাচ্ছে অকথ্য অত্যাচার।
সাবাস রেডিও পাকিস্তান! তােমার অপপ্রচারের প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। কিন্তু কি লাভ এই মিথ্যা প্রচারে? প্রকৃত সত্যের দ্বার তাে তােমাদের কাছেও উদঘাটিত হয়ে আছে। তবুও এ মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে কি চাও?
তােমরা যা চাও তা আমরা অর্থাৎ ভারতীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষ জানি। তােমরা মনে কর তােমাদের আবেগ মধুর সুললিত কণ্ঠস্বরে আমরা একেবারে গলে যাব আর আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ দেশের একতাকে ছিন্নভিন্ন করে আমরা ভারতবাসীরা, নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করব। না পাকিস্তান সরকার, তােমাদের উদ্দেশ্য এত সহজে সফল হবে না। অতএব হে পাকিস্তান সরকার তুমি তােমার নিজের চরকায় তেল দাও, আমাদের চরকায় আর তােমাকে তেল দিতে হবে না। পাকিস্তান সরকার এই অপপ্রচার যেমন করে খুশি চালাক, কিন্তু এর আসল সত্যটা তারা খুব ভালভাবেই জানে।
সমগ্র ভারতকে না হয় বাদই দিলাম। কাছাড় ভারতের মধ্যে আসাম প্রদেশের ছােট্ট একটি জেলা। এই জেলার মুসলমানদের সামগ্রিক বিবরণ যদি দেওয়া যায় তাহলে সম্ভবতঃ পাকিস্তান সরকার বিস্মিতই হবে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তার বিস্মিত হবার বিশেষ কোন কারণই থাকতে পারে না, কারণ প্রকৃত সত্য ঙ্গে তাদের অজানা নেই।
কাছাড়ে হিন্দু ও মুসলমান ছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক খ্রিষ্টানও বাস করে। এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যদিও হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তবুও আমাদের সম্প্রদায়ের তুলনায় তাদের সংখ্যা খুব বেশী নয়। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আছি আমরা মুসলমানরা এবং অবশিষ্ট খৃষ্টান। আশা করি পাঠক সমাজ নিশ্চয়ই অবহিত আছেন যে কোন স্বাধীন দেশের ধর্ম নিরপেক্ষতার সাম্যতা নিশ্চয়ই অবহিত আছেন যে কোন স্বাধীন দেশের ধৰ্ম্ম নিরপেক্ষতার সাম্যতা নির্ভর করে সামাজিক, শিক্ষাগত ও সরকারী মহলে অধিকৃত স্থানের উপর। ভারতবর্ষ সেইরূপ একটি দেশ যে দেশে চলছে পরিপূর্ণ ধৰ্ম্ম-নিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। সুতরাং এইবার দেখুন কাছাড়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্থান অন্যান্য সম্প্রদায় অপেক্ষা কতখানি উঁচুতে। কাছাড়ে মােট এম-এল-এ আসন সংখ্যা ১৪। এর মধ্যে আমাদের সম্প্রদায় লাভ করেছে ছয়টি। যার মধ্যে দুইজন মন্ত্রী, আমাদের এই ছােট্ট জেলা থেকেই আমাদের সম্প্রদায়ের একজনকে করা হয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। গ্রাম্য শাসন ব্যবস্থায় আমাদের যথেষ্ট প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হয়েছে। কাছাড়ের ১৩ জন আঞ্চলিক সভাপতির মধ্যে ৭ জন সভাপতিই আমাদের সমাজের। কৃষির ক্ষেত্রে সত্তর ভাগ মাটি আমাদের। এই ভাবে যদি আরও চুলচেরা বিচার করা যায় তবে দেখা যাবে প্রতিক্ষেত্রেই আমরা সম-অধিকার লাভ করে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত যথেষ্ট সুখে আছি। চাকুরির ক্ষেত্রে বিচার করলে আমরা অন্যান্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমভাবে এগিয়ে চলেছি, দেশের সুখ দুঃখের সমান অধিকারী হয়ে।
এরপরও কি কেউ বলতে পারেন আমরা আমাদের ধর্মকে যথাযথ উপভােগ করতে পারছি না? প্রতিটি ভারতীয় মুসলমানই একথা স্বীকার করেন যে আমরা কোন ক্ষেত্রেই অন্যান্য সম্প্রদায় হতে পিছিয়ে নেই।
কিস্তান সরকার? পাকিস্তান সরকারও খুব ভালভাবেই এই চরম সত্য সম্বন্ধে অবহিত। তবুও তারা অপপ্রচার চালাবেই। তাতেই বােধ হয় তারা শান্তি পায়।
কিন্তু পাকিস্তান সরকার তার দেশবাসী সম্বন্ধে কি কিছু বলবে? আট মাস পার হয়ে গেল পূর্ববাংলার জনতা আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানী পাঞ্জাবী সৈন্যদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। এই বিক্ষোভের কারণ আজ আর পৃথিবীর কোন লােকেরই অজানা নয়, বিশেষতঃ কাছাড়বাসীর কাছে যারা আজ পূৰ্ব্ব-বাংলার লক্ষ লক্ষ অধিবাসীকে ঠাই দিয়েছেনঃ তাদের সমস্ত ভার মাথা পেতে গ্রহণ করেছেন এবং তাদের সুখে দুঃখে আপনভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। কিন্তু নিজের দেশবাসীর জন্য পাকিস্তান সরকার কি করেছে বা কিই বা করছে? যা করেছে তাও আর অজানা নয় কারণ কাছাড়বাসী পূৰ্ব্ব-বাংলার তথা বাংলাদেশের অতি নিকটতম প্রতিবেশী। সুতরাং কাছাড়বাসীর কর্তব্য তারা নিজেরাই স্থির করবেন। কিন্তু পাকিস্তানী অপপ্রচার বােধহয় কোন দিনই ক্ষান্ত হবেনা। না হলেও কিছু আসে যায় না, কারণ সারমেয় হাতির পিছন পিছন ডেকে গলায় ব্যথা বাড়ালেও হাতির কিছু আসে যায় না।
৫-১১-৭১ ইং
এম, আবদুল মতিন, করিমগঞ্জ

সূত্র: আজাদ, ৮ ডিসেম্বর ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!