নববর্ষে
সদ্য বিদায়ী বঙ্গবর্ষে হাসিকান্নার মধ্য দিয়াই সালতামামী হইয়া গেল। গণতন্ত্রী সমাজবাদী ভারতে ইন্দিরা সরকার গঠিত হওয়ায় ভারতবাসী এবং মিত্র দেশবাসীরা উৎফুল্ল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বৈরতন্ত্রী প্রতিবেশী পাকিস্তানের পূর্ববাংলায় হত্যা, রক্তক্ষয় এ সব শুরু হইয়া গেল। প্রতিবেশীদের বিকট আর্তনাদে, ফরিয়াদে, নারীশিশুর বাঁচিবার চীঙ্কারে আমরা স্তব্ধ হইয়া গেলাম। যদিও প্রতিবেশী আমাদের পররাষ্ট্র কিন্তু ওরাও আদতে আমাদের পর নহে। তারা যে সংকটে পড়িয়াছে, তাদের মনুষ্যত্ব যেভাবে বিপন্ন হইয়াছে সে সব ত চোখ কান বুঝিয়া সহ্য করা চলে না।
আমাদের বুদ্ধি আজ বিমূঢ়, আমাদের বুক বেদনা ভারাক্রান্ত। শরীয়তী রাষ্ট্রের নামে শরীয়ত ও মানবতাকে উদ্দামভাবে পরপারে নাস্তানাবুদ করা হইতেছে। দেশ বিভাগের শােচনীয় অভিশাপে এবং শরীয়তীয় লেবেলের মরীচিকায় সে দেশে চলিতেছে দোজখী লীলাখেলা। | আধুনিক দুনিয়ায় যার কোন তুলনা হয় না। কঙ্গো, আঙ্গোলা, ভিয়েনাম, ইন্দোচীন, ঘানা এ সব দেশেও যাহা ঘটে নাই পাকিস্তানে সে সব অধিকতর বর্বর ভাবে ঘটিয়া চলিয়াছে। আমাদের ঘরের দুয়ারে বীভৎসতা ঘটিতেছে। মা-বােনেরা, দুগ্ধপােষ্য শিশুরা নীল আকাশের দিকে তাকাইয়া কাঁদিতেছে, বর্বরতার পিশাচী লীলায় মাতিয়াছে ঐ দেশের শক্তিমানরা আর করাচী বেতার কেন্দ্র হইতে বন্দী বাঙালী প্রচারকেরা বাংলা ভাষায় পূর্ববাংলার সত্য ঘটনার বিরুদ্ধে মিথ্যার কাসুন্দী গাহিতেছে। | পররাষ্ট্রের ঘরােয়া ব্যাপারে আমাদের রাজনীতিক বক্তব্য নাই সত্য কিন্তু পাশবিকতা, অমানুষিকতা এবং শয়তানী লীলাখেলার বিরুদ্ধে ঘৃণা ও নিন্দা জ্ঞাপন ছাড়াও এই দুনিয়ার মালিকের দরবারে ন্যায় সত্যের
নিবতার কল্যাণে ফরিয়াদ জ্ঞাপনের অধিকার আমাদের রহিয়াছে। এহিয়া-মুজিবুরের গদীর লড়াইর কথা আমরা ভাবিনা, আমরা ভাবি, কিভাবে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ, নিরস্ত্র মানুষ লক্ষ লক্ষ মা-বোেন পুত্র-কন্যা শান্তিতে বাঁচিতে পারে।
আমরা বিশ্বাস করি দুনিয়ায় সভ্যতার দাবীদার প্রত্যেক রাষ্ট্র অবিলম্বে পাকিস্তানের নরমেধযজ্ঞের অবসান ঘটাইতে সেখানে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা দিতে আগাইয়া আসিবেন।
রাষ্ট্র সংঘরূপী মাকাল ফল ইসরাইলী হামলায় যে নপুংসকী ভূমিকা লইয়াছে পূর্ববাংলার আমানুষিক অরাজকতায় সেটারই পুনরাবৃত্তি করিতেছে মাত্র। বাঙ্গালা নববর্ষে আমরা আমাদের প্রতিবেশী পূর্ববাংলায় মানবতার মুক্তি ও কল্যাণ কামনা করি।
সূত্র: আজাদ, ২১ এপ্রিল ১৯৭১