পাকিস্তানী জঙ্গী শাসন ও তার পরিণতি
(এন, জামান বি, এ, শক্তি আশ্রম, গােয়ালপাড়া)
পাকিস্তানের গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার লৌহ মানব সে[শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গী শাসনের অবসান ঘটাবার সুযােগ পেলেন। জঙ্গী শাসক ইয়াহিয়া খানের ধারণা ছিল না যে একদিন বাঙালীদের ভেতর থেকে শেখ মুজিবের মতাে একজন দরদী নেতা বের হয়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি লােকের নেতৃত্ব করতে পারবে। জানলে হয়তাে তিনি এই নির্বাচনের একটা প্রহসন করতেন না। খাঁ সাহেব ভেবেছিলেন হয়তাে তার ডান হাত স্বরূপ অপকৃ ও অস্থির বােধ রাজনীতিবিদ মি. ভূট্টোই নির্বাচনে সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে মন্ত্রী সভা গঠন করতে পারবেন। কিন্তু সে গুড়ে বালি। হাওয়া উলটো দিকে বইল। তাই নানা অজুহাতে দেখিয়ে যাহাতে পাকিস্তানে হট্টগােল ও অশান্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয় যাহাতে নানা অজুহাত দেখিয়ে খাঁ সাহেব আরাে কিছু দিন মদে আসীন থাকতে পারেন তার জন্য হবু চন্দ্র রাজা ও গবু চন্দ্র মন্ত্রী উঠে পড়ে লাগলেন।
বাংলার দরদী জননায়ক, পাকিস্তানের লৌহমানব শেখ মুজিবকে মন্ত্রীসভা গঠন করতে খাঁ সাহেব মঞ্জুর করলেন না। তিনি ডাকিনি যােগিনী সহ আসলেন পূৰ্ব্ববাঙ্গলায় সেখ মুজিবের সঙ্গে একটা আপােষ মােকাবেলার ছলনা নিয়ে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিজের মতে নিশ্চল। তাই খাঁ সাহেব রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে চোরের মতাে পালিয়ে গেল ইসলামাবাদে। সঙ্গে তার চেলা মি. ভূট্টো তাহার আজ্ঞাবহ জল্লাদ টিক্কা খান মারফৎ জঙ্গী হুকুমত জারি করে গেলেন পূর্ববাঙ্গলায়।
খাঁ সাহেব চলে গেলেন ইসলামাবাদে তার সাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু লেলিয়ে দিয়ে গেল হিংস্র ও বুভুক্ষশৃগাল নেকড়ের দলকে। চোখ লােলুপ দৃষ্টি নিয়ে তারা ঝাপিয়ে পড়লাে বাংলার বুকে।
লক্ষ লক্ষ অসহায় ও নিরীহ জন সাধারণকে হত্যা করে চলল। খেতের কাজ করা কিষাণরা, স্কুলের ছাত্র শিক্ষকরা-হাসপাতালের রােগীগণ যারা কোন রাজনীতি জানে না, তারাও খাঁ সাহেবের রাইফেলের সামনে থেকে কামান টেঙ্কের গােলা থেকে অব্যাহতি পেল না। সবাই সােনার বাংলাকে আরাে লাল করে তুলল নিজের রক্ত দিয়ে।
পূৰ্ব্ববাঙ্গলার মা বােনেরা ইজ্জৎ, দুগ্ধ পােষ্য নির্মল শিশুদের প্রাণ সতীর সতীত্ব মাতার মাতৃতু কিছুই শয়তানদের হাত হইতে রক্ষা পেলনা। মন্দির মসজিদ গীর্জা পীঠস্থান, ধর্মানুষ্ঠান দরগা, শিক্ষানুষ্ঠান হাসপাতাল আদি ও জঙ্গী শাসকের শয়তান ভূতেরা ভেঙ্গে চুরে ধুলায় মিশিয়ে চলছে। অবাধে তারা এই হত্যাকাণ্ড ধ্বংসলীলা ও পাশবিক আকাক্ষা চরিতার্থ করিয়ে বিশ্ব ইতিহাস অশুদ্ধ করতে চলছে। খাঁ সাহেবের এই জঘন্য কাণ্ড ইতিহাস কোন দিন ভুলতে পারে না। আজ পূর্ববাংলার আকাশ বাতাস কম্পিত হচ্ছে। অসহায় অবলা নারীর আর্তস্বরে শিশুদের করুণ আর্তনাদে।
খাঁ সাহেবের এই জল্লাদী পাশবিক কার্যের প্রতিরােধকল্পে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গলার দরদী জননায়ক শেখ মুজিব বাঙ্গলার জনগণকে বজ্ৰদীপ্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালেন। তাহার আহ্বানে সাড়া দিয়ে আজ পূর্ব বাঙ্গলার সাড়ে সাত কোটি লােক বুকে বল বেঁধে সিংহ নিনাদে ঝাপিয়ে পড়ল পশ্চিমী হিংস্র শৃগালের পালের উপর। কিন্তু তারা যে নিরস্ত্র। অস্ত্র যে তাদের হাতে নাই। সুতরাং লক্ষ লক্ষ লােক প্রাণ দিতে চলল জঙ্গী বাহিনীর নির্মম আক্রমণের মুখে। সিংহ হৃদয় সেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে হিন্দু মুসলমান আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই বাংলার জন্য নিজের স্বাধীনতা রক্ষার হেতু নাগরিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রাণ উৎসর্গ করতে চলেছে। ইতিহাস এদেরকে ভূভুলিতে পারে না। কারণ এরাই শহীদ। এই মুক্তি সংগ্রামে যােগ দিয়ে । প্রাণ দিতেছে তারা শহীদ হিসাবে বাঙ্গলা দেশের মানুষের অন্তরে অঙ্কিত হয়ে থাকবে। যারা জয়ী হয়ে ফিরে আসবে তারা গাজী আখ্যা পাবে ও তাদের নাম ইতিহাসে শাশ্বত হয়ে থাকবে। আমিও দূর থেকে সেসব শহিদ ও গাজীদেরকে ও বাংলার জননায়ক লৌহ মানব শেখ মুজিবকে বৎসরের প্রথম দিবসে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা সশ্রদ্ধ অভিনন্দন ও অজস্র ছালাম জানাচ্ছি।
শেখ মুজিব সত্যই কি চেয়েছিলাে যে সে পূৰ্ব্বাঙ্গলাকে পাকিস্তান হইতে কেটে নিয়ে একটা সার্বভৌম স্বাধীন দেশ গঠন করবে? না তিনি তাহা চান নি। জমিন চেয়েছিলেন, জনসাধারণের মতামতের ওপর ভিত্তি করে একটা খাঁটি গণতন্ত্র দেশ হিসাবে পাকিস্তানকে তৈয়ার করা। কিন্তু ইয়াহিয়া খা চেয়েছিল একটা খেলাে নির্বাচনের প্রহসন করে দেশে একটা অশান্তি সৃষ্টি করে তাহার ইয়াহিয়া শাহী মসনদ আরাে পাকা-পােক্ত করা। কিন্তু শেখ মুজিবের সূক্ষ্মতম বিচার বুদ্ধিতে খাঁ সাহেবের মােট পরিকল্পনা ধরা পড়ে গেল। তাই ২০/২২ বৎসরের পুঞ্জীভূত দুঃখ দৈন্য ও নির্যাতন বিপ্লব আকার ধারণ করে বিস্ফোরিত হয়ে গেল। তার আগুন সারা পূৰ্ববাঙ্গলায় ছড়িয়ে পড়লাে।
খাঁ সাহেবরা আরও এক জায়গায় ভুল করে গেল। তারা ভাবতে পারেনি যে বার শত মাইল ব্যবধান অবস্থিত দুইটি খণ্ড রাষ্ট্র কেবল ধর্মের উপর ভিত্তি করিয়াই একটা পূর্ণ রাষ্ট্র গঠন করার চেষ্টা অপচেষ্টা বই আর কিছু নয়। ধর্মের দোহাই দিয়ে দুই খণ্ড রাষ্ট্রের জনগণের ভিতর জাতীয়তা বােধ, সংহতি ও ঐক্য ভাব জাগরিত হয় না। ধর্মের উপরেও ভাষা শিক্ষা সংস্কৃতি কৃষ্টি রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয় সামঞ্জস্য থাকলে উপরােক্ত ভাবগুলাে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাগরিত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে, কেবল ধর্মের বাহিরে আর কোন বিষয়েই তাদের সামঞ্জস্য দেখতে পাওয়া যায় না। সেই জন্য সৃষ্টি থেকে তাদের ভিতর মতানৈক্য ও মতভেদ। পশ্চিমী সৰ্ব্বদাই চাচ্ছে শাসক হতে পূর্ব দলকে দলন ও শােষণ করে। কিন্তু তাহা হতে পারে না। আজ বঙ্গবাসী জাগিয়াছে শেখ সাহেবের অমােঘ মন্ত্রে।
পূর্ববাংলার গণহত্যা শিশুহত্যা ও নারী নির্যাতন চলতে থাকলাে। শুধু তাই নয়। পশ্চিমী শয়তানেরা অস্থি চর্মসার কুকুরদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে বাঙালীদের উচ্ছিষ্ট ভক্ষণ করতে। ফলে শত শত পশ্চিমী চোর ছেড়ে আসা বাঙালীর সম্পদ লুঠতরাজ করে চলছে। তারা এখন ক্ষেতে মাঠে বিষ ছাড়িয়ে দিয়ে মাঠের ফসল ধ্বংস করে চলছে। সােনার বাংলা শ্মশান হতে চলছে। পূর্ববাংলা থেকে আজ হাজার হাজার উদ্বাস্তুর আগমনে ও বর্ণনায় জঙ্গী শাসকদের গুণ গরিমার কথা বেশ ভালােভাবেই জানতে পারা যায়। যারা আসছে তাদের ঘরদোর সব জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে খাঁ সাহেবের চেলারা। আজ বাংলার শিল্পীর কণ্ঠ রুদ্ধ, লেখকদের লিখনি বন্ধ। সবাই আজ শেখ মুজিবের আহ্বানে দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন কোরবাণী দিচ্ছে। | আজ গােটা পৃথিবীটাই খাঁ সাহেবের এই নির্মম ও জঘন্য জল্লাদী কর্মের জন্য নিন্দা করছে, ধিক্কার দিচ্ছে ভারতেও তার প্রতিধ্বনি হয়েছে। কিন্তু ধিক্কার দেওয়া ও নিন্দা করলেই চলবে না। সাড়ে সাত কোটি অসহায় ও নিরস্ত্র মানুষের মুখের দিকে চেয়ে বাংলার লৌহ মানব শেখ মুজিবের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া একান্ত কর্তব্য। আমরা প্রতিবেশী হিসাবে বিশ্ব দরবারে ও পশ্চিমী সকল শক্তিশালী দেশ সমূহের কাছে দাবী করতে হবে, নতুন বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে, খাঁ সাহেবের অত্যাচারী ফৌজদেরকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করতে, যে সকল দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপাইয়া পড়িয়াছে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে হবে। অনেক দেশ থেকে ইহাকে আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আভ্যন্তরীণ ঘটনা হলাে বলেই কি কোনাে একটি দেশের জন্য প্রতিকারের কোনাে উপায় নাই? প্রতিবেশী দেশবাসী হিসাবে আমরা এই হত্যাকাণ্ড নীরব দর্শক হয়ে উপভােগ করতে পারিনা। ভারতের প্রত্যেক কোনায় আজ খা …. নিন্দার হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেবল নিন্দা করলেই কি এই নির্মম হত্যাকণ্ডের প্রতিকার হবে ? কেবল নিন্দাই নহে। আমাদেরকে দাবী তুলতে হবে বিশ্ববাসীর কাছে, শেখ মুজিবের সরকারকে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র সমূহ দ্বারা স্বীকৃতি দেওয়া হউক। এবং খাঁ সাহেবকে বিশ্বের বিচার মজলিসে অপরাধী করে তার বিচার করা হউক। অগনন নরহত্যা, শিশুহত্যা, নারী হত্যা, নারী নির্যাতন ও নারী ধর্ষণ অপরাধে সে অপরাধী। তাই আমরা তার বিচার চাই, আমাদের এ বিচার করতেই হবে। জল্লাদকে শাস্তি দিতেই হবে।
সূত্র: আজাদ, ১২ মে ১৯৭১