হাতিয়ার বেইমানি করেনি
স্টাফ রিপাের্টার
সূত্র: আমরা যখন শেওলার মুক্ত অঞ্চলের কাছাকাছি ভারতীয় এলাকায় এসেছি, তখন যুদ্ধ আর চলছে না। শেষ গুলিটুকুও শত্রু সৈন্যের উদ্দেশ্যে বর্ষণ করে মুক্তিসেনারা তখন ক্লান্ত দেহটাকে একটু বিশ্রাম দিতে চাইছেন।
আগের দিন থেকে খাওয়া নেই, ঘুম নেই, দেহের সর্বত্র জল কাদার ছােপ- আমরা যে মুক্তিসেনাটির সাথে কথা বলছিলাম, তার চোখে তখনও প্রতিশােধের আগুন জলছে। নিজ বাসভূমে পরবাসী মুক্তিসেনাটি প্রতিশােধ অনেকটা নিতে পেরেছে বটে।।
পঁচাত্তর জন মুক্তিসেনা যুঝেছে পাঁচ শ পাক সৈন্যের সঙ্গে, খতমও করছে তারা অন্তত পক্ষে সত্তরটি দুশমনকে-সেই সব কথাই বলছিল। না, ওরা কেউ মারা যান নি, একজন খালি আহত হয়েছে। হাতিয়ারে মশলা ছিল না আর, নতুবা মুক্ত অঞ্চলে ওরা আরও থাকতে পারতাে, বললেন। শেওলা পর্যন্ত আবার শিগগির ওরা পাক কবল মুক্ত করবেন, সেই বিষয়ে নিশ্চিত মুক্তিসেনাটি।
আমি শুধু অবাক বিস্ময়ে চাইছিলাম ছেলেটির দিকে। একেবারে সাধারণ গ্রাম্য তরুণ একটি-২০/২১ বছর বয়েস, খালি পা, গেঞ্জি গায়ে, পরনে লুঙ্গি। সৈনিকের পরিচয় ওর মাথায় লােহার হেলমেট, হাতে ব্রেনগান। আমার ভিয়েতনামের মুক্তিযােদ্ধাদের কথা মনে হচ্ছিলাে। আগের দিন রাতে শেওলা যুদ্ধের প্রথম আক্রমণ ওর হাতের ব্রেনগানটি দিয়েই হয়েছিল। অপত্য স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘দুশমনকে মাটিতে ফেলতে হাতিয়ার আমার বেইমানী করে নি।
মুক্তিফৌজে নাম লিখিয়েছেন। বললেন এই বারের হামলা শুরু হবার পর প্রথম সুযােগ মেলা মাত্রই। আক্রমণ কৌশল সম্বন্ধে তার ধারণা যে খুব স্বচ্ছ, তা বুঝতে পারছিলাম সহযােদ্ধা আর এক জনের সাথে যখন সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের ভুল ত্রুটি নিয়ে আলােচনা করছিলেন।
গেরিলা যুদ্ধের রীতি মতন hit and run অনযায়ী মুক্তিসেনারা আক্রমণে আক্রমণে পাক সৈন্য বাহিনীকে বিপর্যস্ত করে যখন নিরাপদ ঘাঁটিতে ফিরে এসেছেন, তখনই পাকিস্তানীরা বিপুল সংখ্যায় আবার আসে, দূর পাল্লার আরও ভারী অস্ত্র নিয়ে। মুক্তিফৌজ তখন নাগালের বাইরে, তাই ভারতের গ্রামে ওরা ঢুকে গুলি করে, আগুন দেয়, লুঠ করে। ‘হাতিয়ার চালাতে পারিনি, মশলা ছিল না বলে। ওরা আমাদের না পেয়েই আপনাদের গ্রামে হামলা করেছে। জবাব আমরা দেবাে, রােজ যেমন দিচ্ছি এখানে ওখানে, ভাববেন ।’
মমতাঘন চোখ দুটোতে আবার আমি প্রতিশােধের আগুন জ্বলতে দেখলাম। এত জ্বালা বুকে, যাদের বুকে, তাদের হাতিয়ার অবশ্যই বেইমানী করে না, করবে না।
সূত্র: যুগশক্তি, ২১ মে ১৯৭১