আমরা ও বাংলাদেশ
(সিলেট হইতে আগত জনৈক মুসলমান)
ধর্মই ছিল পাকিস্তান সৃষ্টির ভিত্তি। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা যদিও সকলদিক থেকে পশ্চিমের মুসলমানদের থেকে আলাদা, তবুও ধর্মের নামে যে ডাক এসেছিল তাতে তারা যােগ দিয়েছিল ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্নে। তখন সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে এমনকি আমরা যে বাংগালী, আমরা যে অনন্য এ ভাব আমাদের মনে উদয় হয় নাই। কিন্তু ধর্ম যে বিভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে একাত্মবােধ সৃষ্টি করতে পারে না, সেই সত্য আমরা পূর্ব বাংলার মুসলমানরা অনেক দেরীতে বুঝেছি। কিন্তু কখন বুঝলাম? এবং কেনই বা এখন স্বাধীনতার বিশবছরেরও পরে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চাইছি? এর কারণ আমাকে এখন আর বলে দিতে হবে না। যারাই পশ্চিমী মুসলমানদের সঙ্গে মিশেছে। এবং থেকেছে, তাদের বুঝতে দেরী হয় নাই যে পশ্চিম মুসলমানরা বাংগালী মুসলমানদের ঘৃণার চোখে দেখে। তারা চায় বাংগালীরা তাদের তাবেদার হয়ে থাকবে আর তারা চালাবে শাসনভার। বাংগালীরা সমগ্র পাকিস্তানে অর্ধেকেরও বেশী সংখ্যায় কিন্তু সরকারী দপ্তরে সামরিক বাহিনীতে ব্যবসা ও বানিণিজ্যে তাদের জোর করে অধস্তন পর্যায়ে ঠেলে রাখা হয়েছে। শুধু ধর্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন জাতি একত্রে বাস করতে পারে না। তাদের মধ্যে চাই একাত্মবােধ এবং মানুষের উপযুক্ত সম্মান। পূৰ্ববংগের বাংগালী মুসলমানরা কি তা পেয়েছে? পায় নাই বলেই পূৰ্ববংগকে পশ্চিমী মুসলমানদের হাত থেকে স্বাধীন করার আজ এই সগ্রাম। আমাদের চরম শিক্ষা হয়ে গেছে এবং শেখ মুজিবুর রহমানই আমাদের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। আমরা যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করেছি, হয়ত এখনও অনেক বাকী। পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মনে ধর্মের ভুয়া ডাক আর কখনই তাদের আকাঙ্ক্ষিত পথ থেকে বিচলিত করতে পারবে না। শত্রুর সঙ্গে যেমন ঘর বাঁধা যায় না এটা যেমন সত্য পশ্চিমী মুসলমানদের সঙ্গে তেমন সমঝােতার কোন কথাই আর উঠতে পারে না। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আমাদের এই সংকট মুহূর্তে আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক মিরজাফর রয়েছে যারা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ সিদ্ধির আশায় আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে ব্যর্থ করার চেষ্টায় লিপ্ত। গত কয়েক মাসের ঘটনা থেকে দেখা যায়, কাছাড়ের সীমান্তবর্তী এলাকায় কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী জঙ্গী শাহী সরকারের তাবেদার আশ্রয় নিয়েছে, বাংলাদেশের মুক্তি সগ্রামকে বাধা দেবার ব্যর্থ প্রচেষ্টায়। জানা গেছে কাছাড় সীমান্তের লামাজুয়ার সেরালিপুর ভূতি গ্রামের কিছু সংখ্যক মুসলমান এই সব অনুচরদের সহায় করছে। কিন্তু তাদের জানা উচিৎ তারাও বাংগালী এবং প্রতিবেশী পূর্ব বাংলার মুসলমানরা তাদের সাহায্য এবং সহানুভূতি চায়।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম অন্যায় এবং অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই সংগ্রামে পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য আছে। এই বিষয়ে কাছাড়বাসী বাংগালী মুসলমানদের কর্তব্য আরও বেশী, কারণ তারা পূর্ববাংলার নিকটতম প্রতিবেশী।
সূত্র: আজাদ, ২৭ অক্টোবর ১৯৭১