You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাম্রাজ্যবাদের নীল-নকশা

প্রথমে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অস্বীকার করা, পরে তাদের আজ্ঞাবহ মােশতাকের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠন করে মীমাংসায় পৌঁছা সম্ভব না হওয়ায় শেষে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে উদ্যত হয়। কিন্তু এসবের কোন কিছুই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারে নি। বলা বাহুল্য, এই পরাজয়কে তারা সহজভাবে নেয় নি। তৎকালিন মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের সহকারী রজার মরিসের ভাষায় : স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় শেখ মুজিবের ক্ষমতায় আসাটা ছিল উদ্যতের মতে, আমেরিকা এবং আমেরিকার তাবেদারদের জন্য এটা প্রকৃত অর্থেই পরাজয়স্বরূপ এবং আমেরিকার প্রশাসনের জন্য এটা খুবই বিব্রতকর ঘটনা … তার (হেনরি কিসিঞ্জার) কাছে বাংলাদেশের ঘটনাবলী ব্যক্তিগত পরাজয় (as a personal defeat) হিসেবে প্রতিভাত হয়। সাম্রাজ্যবাদ কোন পরাজয়কেই সহজে মেনে নেয় না। যে কোন পরাজয়কেই সে ভাবতে চায় সাময়িক এবং বাস্তবেও সাময়িক পরাজয়কে জয়ে পরিণত করার জন্য মারি অরি পারি যে কৌশলে নীতি অবলম্বন করে। সে পথ ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অচিরেই বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।

১৯৬৪ সালের আগে থেকেই আমাদের জন্য বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করা প্রয়ােজন হয়। অর্থাৎ নিজস্ব খাদ্যোৎপাদন দিয়ে দেশের সকল মানুষকে খাইয়ে বাঁচানাের সামর্থ্য দেশ হারিয়ে ফেলে। ১৯৬৯-৭০ অর্থবছরে জনসংখ্যার ১২.৫% ভাগের জন্য খাদ্য আমদানি করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, একই সময়ে দেশ পরিণত ১. নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১১ (পাদটীকা ৭ ও ৮)। ২.  জনৈক মার্কিন ছাত্র কর্তৃক চিলির সালভাদর আয়েন্দের সরকার উৎখাত ও সামরিক অভ্যুত্থানে (১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩) নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাওয়া প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। 

সংযােজিত হতে থাকে এবং অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগ একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমে পরিণত হয় যাতে পরস্পর বিরােধী স্বার্থসম্পন্ন শ্রেণী ও ব্যক্তির সমাবেশ ঘটে। ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ঐসব প্রগতিশীল কর্মসূচি বাস্তবায়নের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠে না, যদিও আন্দোলনের নেতৃত্ব থাকে তারই হাতে। স্বাধিকারের আন্দোলন ১৯৭১ সালে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। সংগ্রামটাকে ভাবা হয়েছিল জাতীয় পরিধিতে সীমাবদ্ধ, অভ্যন্তরীণ ব্যাপার; কিন্তু পরে দেখা গেলাে তা ঠিক নয় এবং বাইরের দুনিয়ার ভূমিকাও এর প্রতি নিরপেক্ষ নয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে মাওবাদী চীন পাকিস্তানের পক্ষে এবং (তৎকালীন) সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয়।মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়েই জনগণ প্রথম প্রকাশ্যে দেখতে পায় বাঙালি-পাকিস্তানী বিরােধে পাকিস্তানী শক্তির সাথে সাম্রাজ্যবাদের গাঁটছড়া বাঁধা রয়েছে। ফলে স্বাধীনতার পর বৈদেশিক ক্ষেত্রে মুজিব ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়’ নীতি ঘােষণা করেও ‘বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু’ এই সত্য মেনে চলতে শুরু করেন। এছাড়া ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’ প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ফোরামে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বক্তব্য (‘দুনিয়া দুই ভাগে বিভক্ত-শােষক এবং শশাষিত; আমি শােষিতের দলে’) দিতে থাকেন। তবে পেটিবুর্জোয়া সীমাবদ্ধতার কারণেই মুজিব সে সময় দেশের সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক জরুরী কর্তব্য কি কি এবং কীভাবে তা সম্পাদন করা যায়, তা সঠিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম হন নি। সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু খাদ্য ও উন্নয়নের জন্য সে আবার সাম্রাজ্যবাদের উপরই নির্ভরশীল। কাজেই সাম্রাজ্যবাদের উপর অর্জিত বিজয়কে বিপদমুক্ত ও অপরিবর্তনীয় (irreversible) করার জন্য প্রয়ােজন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। আর বাংলাদেশের ভাগ্যোন্নয়ন মানে হলাে গ্রামের ভাগ্যোন্নয়ন। এজন্য প্রয়ােজন ছিল গ্রামীণ জীবনের বিকাশের পথ উন্মুক্ত করার জন্য গ্রামীণ সামাজিক কাঠামােতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন।মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মনে সৃষ্টি হয়েছিল বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা, আত্মত্যাগের মনােভাব ও দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থ কাজ করার প্রস্তুতি। সৃষ্টি হয়েছিল যুগান্তকারী সামাজিক পরিবর্তনের সূচনার উপযুক্ত মুহূর্ত। লক্ষাধিক বীর মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য থেকে উপযুক্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গঠন করা যেতাে প্রয়ােজনীয় কর্মীবাহিনী।
কিন্তু স্বাধিকার/স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্তই মুজিবের আন্দোলন সংগ্রামের প্রয়ােজন ছিল। গরীব মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’-এগুলাে তার কাছে যুদ্ধ বা সংগ্রামের বিষয় বলে বিবেচিত হয়নি। তাই তিনি, অস্ত্র জমা দিয়ে যার যার কাজে ফিরে যেতে মুক্তিযােদ্ধাদের আহ্বান জানান। সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে তিনি রচনা করেন সংবিধান, অনুষ্ঠান করেন নির্বাচন এবং সময় ও শক্তি ব্যয় করেন বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয় সাধনে। পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ১৯৬৯-৭০ সালে আওয়ামী প্ল্যাটফরমে পরস্পর বিরােধী স্বার্থসম্পন্ন শ্রেণী ও ব্যক্তির সমাবেশ ঘটে। খন্দকার মােশতাক, শাহ মােয়াজ্জেম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ ছাড়াও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরে অনেকেই সাম্রাজ্যবাদের সমর্থকরা ছিলেন। স্বাধীনতার পর তারা দলের অভ্যন্তরেই ২৬ মার্চের ঘঘাষিত নীতির বিরােধী লবী হিসেবে আবির্ভূত হয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের শক্তিকে অবশ করে দেয়। উপরন্তু, তারা নিজেরা কিংবা তাদের আশীর্বাদপুষ্টরা নিয়ােজিত হন। আত্মস্বার্থ চরিতার্থতায়। পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল, লাইসেন্স-পারমিটবাজী, রেশন ও রিলিফ সামগ্রী চুরি থেকে শুরু করে চোরাচালান, মজুতদারী, কালােবাজারীপনা কিছুই। বাদ পড়লাে না। এসব কারণে ১৯ জন সাংসদ ও ৯ জন মন্ত্রীর পদও বাতিল করা হয়।  যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সৃষ্ট আত্মত্যাগের পটভূমিতে মানুষ মুজিবের ঘােষণা ‘আমি তােমাদের তিন বছর কিছু দিতে পারব না মেনে নিতে সম্মত ছিল। কিন্তু কিছু লােকের দ্রুত পায়ে হাঁটা থেকে মার্সেডিজে আরােহণ’ সাধারণভাবে দেশে একটি দুঃখজনক হতাশার সৃষ্টি করে, স্বাধীনতার ভাবমূর্তি বিনষ্ট করে, সর্বোপরি আওয়ামী লীগের উপর জনগণের আস্থার ফাটল ধরায়।
স্বাধীনতার পর কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাঙের ছাতার মতাে গজিয়ে উঠা বিভিন্ন সাপ্তাহিক, এনায়েত উল্লাহ খানের ‘হলিডে’, হােসেন ভ্রাতৃদ্বয়ের ইত্তেফাক” প্রভৃতি এবং পরাজিত পাকিস্তান ও মাওপন্থী রাজনীতিবিদরা মাওলানা ভাসানীর ছত্রছায়ায় মিলিত হয়ে আওয়ামী ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদে অবতীর্ণ হয়। এ সময় গোদের উপর বিষফোড়ার ন্যায় ‘মুজিবের ভাবমূর্তির উপর জাসদের প্রচণ্ড আঘাত জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।’ ‘নিজের দলের লােক এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী হওয়ায় তাদের পক্ষে মুজিবের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ করা সহজসাধ্য হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর পরই ভারতের আশ্রয় থেকে দেশে ফেরা প্রায় এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, সমুদ্র বন্দরসমূহের মাইন অপসারণ, রেলসেতুসহ যােগাযোেগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, এক কথায় স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি (১৯৭২ সালে জাতিসংঘের জরীপ অনুযায়ী তখনকার মূল্যে ১২০ কোটি ডলার) কাটিয়ে উঠা ছিল বড় কঠিন।৩. কিন্তু কারচুপি হওয়ায় নির্বাচন জনগণের বিশ্বাসযােগ্যতা অর্জনে সক্ষম হয় নি ইত্তেফাক সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য পরিশিষ্ট ১৫ পড়ুন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুজিব ধীরে হলেও ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন। এ অভিযােগে বেশ ক’জন মন্ত্রী, সাংসদ ও দলীয় কর্মীর সদস্যপদ বাতিল করেন। কিন্তু যতই তাকে উৎখাতের সংগ্রাম তীব্র হয়। ততই তিনি নিজের দলের উপর নির্ভর করেন। ফলে দলকে দুর্নীতিমুক্ত করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় মুজিব বিরােধী নানা ধরনের চুটকিতে দেশ সয়লাব হয়ে যায়
মুজিব ভেবেছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের মতাে সমাজতন্ত্রও সকলকে নিয়েই করা যাবে। যে সব বাঙালি পাকিস্তানী ২২ পরিবার হটে যাওয়ার পর তাদের কলকারখানা, ব্যবসায় দখলের আশায় আওয়ামী লীগে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন, জাতীয়করণ ও সিলিং ঘােষণার নীতিতে তারা অসন্তুষ্ট হয়। শুরুতেই মুজিব তাদের দমন না করে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি প্রাক্তন মালিকদেরই জাতীয়করণকৃত কারখানা পরিচালনায় নিয়োেগ করে উভয়কূল রক্ষার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ভূমি সংস্কারের বেলায়ও একই ফল হলাে। পরিবার প্রতি ১০০ বিঘা সিলিং নির্ধারণ করে উদ্বৃত্ত ভূমি ভূমিহীনদের মধ্যে বন্টনের নীতি ঘােষণা করা হয়। কিন্তু দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের ভিত্তি হলাে মূলত গ্রামের অবস্থাশালী অংশ; যাদের অনেকেই শহরে উকালতিসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়ােজিত কিন্তু গ্রামে নিজের বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে প্রচুর জমিজমার (অনুপস্থিত) মালিক। ২৫ বিঘা পর্যন্ত খাজনা মওকুফের ঘােষণায় তারা খুশী হলেও ১০০ বিঘার ‘সিলিং’ ঘােষণায় তারা অসন্তুষ্ট হয়, (দেশে মানুষের তুলনায় ভূমির পরিমাণ এত কম যে, ১০০ বিঘার সিলিং প্রকৃত অর্থৈ কোন সিলিংই নয়)। কিন্তু তাদের সঙ্গে রাখতে মুজিব পরিবারের সংজ্ঞা পাল্টালেন। ফলে ভূমি সংস্কার হলাে না। অথচ দেশের সামনে উপস্থিত কর্তব্যের বিচারে শিল্পের জাতীয়করণের চাইতেও গ্রামীণ জীবনের বৈপ্লবিক পুনর্গঠন ছিল অধিক জরুরী। অন্যদিকে, ১৯৭৩ সালের (অক্টোবরে শুরু) আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মুদ্রাস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের বিশেষ করে খাদ্যসহ অন্যান্য আমদানিকৃত পণ্যের দাম এক লাফে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মজুতদার-কালােবাজারীরা এর সুযােগ গ্রহণ করে মানুষের জীবন ও দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলে। অবৈধ অস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি এর সাথে যােগ হয়ে দেশ অরাজকতার দিকে এগুতে থাকে।এমতাবস্থায়, ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে অনন্যোপায় হয়ে সশস্ত্র বাহিনী তলব করা হয়। সামরিক-অভিযানে পেশাদার দুষ্কৃতকারীদের সাথে বিপুল সংখ্যক আওয়ামী লীগারও ধরা পড়ে।
স্থানে স্থানে শাসক দলের সাথে সামরিক বাহিনীর বিরােধ দেখা দেয় এবং দলীয় চাপে মুজিব অভিযান অসমাপ্ত রেখেই সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে১৫. একদিকে জাতীয়করণকৃত কল-কারখানা ও ব্যবসায় পরিচালনার সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর কালাে টাকা অর্জন করে তা সাদা করার জন্য ব্যক্তি পুঁজির উপর সিলিং উঠিয়ে দেয়া ও বিদেশী পুঁজির সাথে যৌথ বিনিয়ােগ আইনসঙ্গত করার দাবি জানায়; অন্যদিকে প্রাক্তন বাঙালি পাটকল মালিক সমিতি’ প্রভৃতি গঠন করে ইত্তেফাকের মাধ্যমে জাতীয়করণের কুফল প্রচার করে তা ব্যক্তি মালিকানায় ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। উপরন্তু তারা অন্তর্ঘাতের মাধ্যমে একটি অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। অন্তর্ঘাতের জন্য পরিশিষ্ট ৭ পড়ুন। ১৬. পিতা জীবিতাবস্থায় বিবাহিত-অবিবাহিত সকল পুত্রদের নিয়ে এক পরিবার গণ্য করার বিধান পরিবর্তন করে বিবাহিত পুত্রকে আলাদা পরিবার এবং তার নামেও ১০০ বিঘা জমি রাখার ব্যবস্থা করা হয়। স্মর্তব্য, জন্মকালে আওয়ামী লীগের দাবি ছিল ‘সকল জমি জাতীয় করণ করাফিরিয়ে আনেন। এতে সামরিক বাহিনী অপমানিত বােধ করে এবং জনগণও হতাশ হয়। সামগ্রীকভাবে সরকার, আওয়ামী লীগ ও মুজিবের উপর জনগণের আস্থাহীনতা আরও বৃদ্ধি পায়। এতদিন মুজিবের উপর মানুষের যে একটি শেষ ভরসা’ ছিল তা নষ্ট হয়ে যায়। সামগ্রীক পরিস্থিতির কারণে মুজিবের নিজের নজীরবিহীন সক্রিয় জনসমর্থন পরিণত হয় নিষ্ক্রিয়তায় বা নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এ সুযােগে আওয়ামী লীগের ভেতর ও বাইরের উচ্চাভিলাষীরা ২৬ মার্চ ১৯৭২-এর প্রগতিশীল কর্মসূচিকে চ্যালেঞ্জ করে। এ রকম পরিস্থিতিতে জুন ১৯৭৪ এ শতাব্দির দীর্ঘস্থায়ী প্রলয়ঙ্করী বন্যায় প্লাবিত হয় বাংলাদেশ। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল নিঃশেষিত। সরকারি খাদ্যের গুদাম শূন্য।” ধনবান ব্যক্তিবর্গ ও মজুতদারদের গােলার সংরক্ষিত খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে তা পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ মােকাবেলা করার নৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তি ততদিনে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও ব্যক্তি হিসেবে মুজিবের অবশিষ্ট নেই। সকলের চোখের সামনে অনাহার ক্লিষ্ট অসহায় মানুষ মুখে ফেনা তুলে ঢলে পড়তে লাগলাে মৃত্যুর কোলে। লাশে ছেয়ে গেলাে রংপুর, কুড়িগ্রাম, ঢাকার রাজপথ।
জুলাই মাসে (১৯৭৪) সরকার তার নীতি সংশােধন করে ব্যক্তি পুঁজির সিলিং ২৫ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ৩ কোটি টাকা নির্ধারণ করে, বিদেশী পুঁজির সাথে যৌথ বিনিয়ােগের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় এবং বিশ্ব ব্যাংকের কাছে চিঠি লিখে কনসর্টিয়াম গঠনে তার সম্মতির কথা জানায়। কিন্তু বেকায়দায় পড়ে গৃহিত মুজিবের এসব আপােস সাম্রাজ্যবাদকে খুশী করতে পারে না, বরং এ নাজুক অবস্থা থেকে অধিক সুবিধা আহরণে সে (সাম্রাজ্যবাদ) তৎপর হয়। দুর্ভিক্ষের পর সরকার বা মুজিবের প্রতি মানুষের আর কোনই উৎসাহ রইলাে না। অন্যদিকে, প্রায় তিন বছরের দেশ শাসনের অভিজ্ঞতায় মুজিব দেখলেন, “দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাে তাে দূরের কথা, তিনি তাদের অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকেই বাঁচাতে পারছেন না। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিনি ১৯৭৫ সালের শুরুতে নতুন পথে দেশ চালানাের এক বিতর্কিত (বাকশাল) পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। এভাবেই মুজিবকে অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অপসারণের পটভূমি সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ কয়েক বছরের অনুসন্ধান এবং দু’শরও বেশি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মুজিব হত্যার নেপথ্য-কাহিনী সম্পর্কে জনৈক বিদেশী সাংবাদিক বলেন : ১৮…ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসে সে-সময় কর্মরত মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার থেকে এবং অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক অবহিত বাঙালি মহল থেকে পাওয়া নতুন তথ্য থেকে দেখা যায় যে, শুধু যে শেখ মুজিবকে হত্যা এবং উৎখাতকারী এই কু সম্বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব থেকেই অবহিত ছিল, তাই নয়; ঘটনার ছয় মাস১৭. মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশের কেনা গম পাঠাতেও ইচ্ছাকৃত বিলম্ব করে ক্ষুধার আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১০৮আগেই মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত ব্যক্তিদের সাথে শেখ মুজিব উচ্ছেদের এই ষড়যন্ত্রে (Plot) জড়িত ব্যক্তিদের আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের শেষে শেখ মুজিবুর রহমান সরকারকে উৎখাত করতে মনস্থ ব্যক্তিরা আমেরিকান দূতাবাসের সাথে যােগাযােগ করে।…১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির মধ্যে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সাথে তাদের পর পর অনেকগুলাে বৈঠক (a series of meetings) অনুষ্ঠিত হয়।
এরপর কূটনৈতিক এবং বৈদেশিক দপ্তরের কর্মকর্তা পর্যায়ে যােগাযোগটা বিচ্ছিন্ন। করা হলেও এই যােগসাজশটা অধিগ্রহণ করে চালিয়ে যাওয়া হয় আমেরিকান দূতাবাসের সি.আই.এ, স্টেশন-প্রধান ফিলিপ চেরী এবং স্টেশনের অন্য এজেন্টদের মাধ্যমে। তিনি আরও জানান যে, সরকারিভাবে শেখ মুজিব হত্যা এবং তার সরকারের উৎখাতটাকে শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ সামরিক অফিসারদের কাজ বলে চিত্রিত করা হয়। এটা একটা বিশুদ্ধ ‘গল্প’ (Myth), যদিও অনেকের কাছে এই গল্পটাই সত্যের স্থান দখল করে আছে।” কিন্তু প্রকৃত সত্য হলাে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঘাতক মেজরবৃন্দ এবং সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছা ও কর্ম এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে এই নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। কলামবিদ গাছপাথরের (অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী) ভাষায় :শেখ মুজিবুর রহমান যে, একজন সমাজতন্ত্রী ছিলেন এমন দাবি করার দরকার নেই। কিন্তু তিনি যে পূজিবাদের পক্ষে তেমনভাবে কাজ করছিলেন না-যেমনভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদীরা চাইছিল-সেটা মানতেই হবে। তাকে তাই সরে যেতে হয়েছে অতি দ্রুত।১৯. নজরুল ইসলাম, জাসদের রাজনীতি, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১১০ সময় বহিয়া যায়, সংবাদ, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৯০।

সূত্র : বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২-১৯৭৫ – হালিমদাদ খান

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!