You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.15 | বাংলাদেশ ও ইয়াহিয়া খান | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ ও ইয়াহিয়া খান

ইতিহাসে ইতিপূর্বে এমনতরাে নৃশংস অত্যাচারের নজীর আমরা পাইনি যা আজ চলেছে সারা বাংলাদেশ জুড়ে, পাঁচ মাস যাবত; এই অভূতপূৰ্ব্ব ঘটনার সঙ্গেও ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে থেকে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ যে ধৈৰ্য্য এবং শিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছে তাও বােধহয় ইতিহাসে বিরল। ২৫ শে মার্চের পর থেকে লক্ষ লক্ষ গৃহহীন মানুষ জংগী শাহীর অত্যাচারে উৎপীড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে একটু শান্তি এবং স্বস্তি পাবার আশায়। কিন্তু এই চরম সংকটময় মুহূর্তেও ভারত সরকারের ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটে নাই। ভারতবাসী তাদের সরকারের সংগে বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের সাহায্যকল্পে একমত এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারেও তারা সরকারের সঙ্গে একমত। কাজেই আমার মনে হয় এখনই প্রকৃষ্ট সময় যখন ভারত বাংলাদেশেকে স্বীকৃতি দিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সংকোচ ভেঙ্গে আদর্শ সৃষ্টি করতে পারে।
আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের চিন্তার বুঝি বা আর শেষ নাই। তিনি আর কতদিন যে তার অত্যাচারকে টিকিয়ে রাখতে পারবেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কাজেই যদি ক্ষমতাই গেল ইয়াহিয়ার তবে তিনি তিনি কিই বা করলেন। কিন্তু প্রশ্ন হলাে ইয়াহিয়া কি সত্যিই যথার্থ ক্ষমতায় আসীন? নাকি তিনি তার সেনানীদের হাতে চাবুক ছেড়ে দিয়ে নিজে ঘােড়া সেজেছেন? ক্ষমতা যদি তার অটুটই থাকবে তবে আজ কেন তিনি সারা পৃথিবীময় সাহায্য ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছেন? এইসঙ্গে তাহলে আমরা এই ধরে নিতে পারি যে, বাংলাদেশে যে রক্তবন্যা বয়ে চলেছে, যা পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে মানবিকতার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে তা-খান সাহেবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘটছে। তা হতে পারে। এতে আশ্চর্য হবার কিই বা আছে। যিনি এককালে আয়ুবের কাছে থেকে গদি কেড়ে নেওয়ার পর থেকে পাকিস্তানে হৰ্ত্ত কৰ্ত্তা বিধাতা ছিলেন তার মসনদ আজ টলমল করে কেন? না না! এতে আমরা আশ্চর্য্য হইনি, কারণ চাবুকের শাসন অথবা শােষনে[ণীর বিরুদ্ধে যে কোন দিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তারাই হল ভৃত্যের দল। এই উদাহরণও তাে একাধিক। অতএব খান সাহেব, আপনার গদি গেলে মান গেলে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাও যে অন্তর্নিহিত [অন্তর্হিত হবে তখন কি করবেন বা এতদিন ধরেই বা কি করলেন? গদিটাকে পাকা করে আঁকড়াতে পারলেন না। তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যদিও লাভ নেই তবুও বলি, আয়ুবের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে যদি আপনার প্রতিজ্ঞানুসারে বাংলাদেশের শাসনভার সেই দেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দিতেন তবে বােধহয় আপনার নামে উচ্ছ্বসিত জয়ধ্বনী হতাে, সারা পৃথিবী আপনার প্রশংসায় মুখর হয়ে থাকতাে। কিন্তু তা না করে আপনি কি করলেন? আপনি বাঙালী হত্যার সংকল্প নিয়ে আপনারই বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ মানুষদের লেলিয়ে দিলেন যাদের নেতৃত্বে করলেন ঐ বিক্ষুব্ধ জনতার প্রতি প্রতিনিধি শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু খান সাহেব, আপনি যদি মুজিবের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতেন ঠিক নির্বাচনের পরেই তবে কি আজ আর আপনার দ্রিাহীন রাত্রি যাপন করতে হতাে? কিন্তু কি আর করা যায়। আপনার যে নছিবের দোষ। আপনি ক্ষেপিয়েছেন ক্ষ্যাপা বাঙালীগুলােকে তারপরেও চালাচ্ছেন পাশবিক, হিংস্র অত্যাচার, নারীধর্ষণ ও ধর্মবিরােধী কার্যকলাপ, কত আর বলবাে? ফলে কি হলাে? অগণিত মানুষ আজ ভারতে এসে আশ্রয় নিয়েছে তাে ঠিকই, উপরন্তু ঐ মুজিবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিফৌজে যােগ দিয়ে অত্যাচারে প্রতিশােধ নেওয়ার চেষ্টা প্রবল হয়ে উঠেছে। তারা চায় খান সাহেবেরে শােষণরূপী শাসনকে সমূলে বিনষ্ট করতে। আর তারাতাে করিবেই, কারণ তাতে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। খান সাহেব ভাবছেন বােধহয় নেতা মুজিবকে হত্যা করলেই বুঝি এই সমস্যার সমাধান হবে। আপনার সুখনিদ্রা ফিরে আসবে কিন্তু খান সাহেব বােধহয় জানেন না যে বাংলাদেশের উৎপীড়িত সাড়ে সাতে কোটি মানুষের প্রত্যেকটিই আজ একটি মুজিব হয়ে উঠছে। সিংহের মতাে তেজি, তারা। বজ্রের মতাে দৃঢ় তারা ভাংবে তবু মাথা নােয়বে না তারা চায় বাংলাদেশে সে দেশের নাগরিক শুধু বাঙালীই থাকবে, সে দেশ শাসীসিতি হবে তাদের দ্বারা নির্বাচিত সকল বাঙালী প্রতিনিধির দ্বারাই, আপনার অনুচরেরা সেখান থেকে বিতাড়িত হবে, সুতরাং আপনার মসনদ টলমল।
ইতিহাস বলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে রােধ করার মত ক্ষমতা বিশ্বের সর্বশক্তিশালী দেশেরও নাই। সুতরাং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামের জয় অবশ্যম্ভাবী। যদি মুজিবের মৃত্যু হয় তা হলে সে সংগ্রাম হবে আরও ভয়ংকর আরও প্রলয়ংকর। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের অধিবাসী বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ বলে ঘােষণা করেছে, যার জন্য তারা উন্মুখ হয়ে বসে আছে স্বীকৃতি লাভের আশায়। কিন্তু পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলিও আজ এই স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাবােধ করেছে, সংকোচ বােধ করেছে। তাই আজ ভারতের উচিত স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে পৃথিবীর সংকোচ মুক্ত করে বাংলাদেশের জনগণকে “জয় বাংলা” জয়ধ্বনিতে সহযােগিতা করা। (উম্মর উন্মিয়া)

সূত্র: আজাদ, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১