You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.14 | বাংলাদেশ ও ইসলামের দোহাই | আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ ও ইসলামের দোহাই

বাংলাদেশের জাগ্রত জনমতকে এবং গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়মুকুট লাভকারী আওয়ামী লীগ দলকে নস্যাৎ করার জন্য বাংলার] মনীষা; জ্ঞানগরিমা ও যুবশক্তিকে একেবারে কাবু করার জন্য পাকিস্তানের মিলিটারী শাসক গােষ্ঠী গত তিনমাসে কত অপকৰ্ম্ম, নিন্দনীয় আচরণ, মানবতাশূন্য ক্রিয়াকলাপ, বিশ্বের বিস্ময়কর নারকীয় কাণ্ড করিলেন যাহার তুলনা সভ্যতার ইতিহাসে মিলেনা তৎস্বত্বেও নিজেদের অমানুষিক হাজার হাজার কুকৰ্ম্মকে চাপা দিবার জন্য ইসলামের দোহাই তুলিয়া মুসলীম জনমতকে বিভ্রান্ত করার ফন্দি আটিলেন। “জামাতে ইসলাম” নামীয় একটি সংস্থাকে “ইসলাম বিন্ন” জিগিরের বুলি চপকাইয়া মুসলীম ও অমুসলীমদের মনে এবং আচরণে বিভ্রান্তি সৃষ্টির শেষ দাওয়াই হিসাবে চালু করার বেহায়াপনা আকড়াইলেন।
এহিয়াখান-ভুট্টো-টিক্কাখানের মত কসাইস্বভাব মানুষের মুখে ইসলামের দোহাই শােভা পায় কি না সত্যিকার মুসলমানেরা তাহা ভাবুন। কসাইর মানুষ জবাই, পিতার চক্ষের সামনে কন্যার উপর পাশবিকতা, স্বামীর সম্মুখে স্ত্রী ধর্ষণ, মা বাবার সম্মুখে পুত্রকন্যাদেরে বলিদান এত সব হাজার হাজার, লাখ লাখ অপকৰ্ম্ম, কুকৰ্ম্ম, পাশবিকতা, ষণ্ডামী, (ভণ্ডামী) গুণ্ডামী, নরনারী হত্যা মসজিদ মন্দির ধ্বংস, কোরাণ শরিফ অবমাননার পরও তাহারা শান্তির ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে, দোহাই দেয় কোন্ মুখে ?
ইসলাম শান্তি ধর্ম, ইসলামে মানবতার, মান সম্মানের; ইনসানিয়তের স্থান সকলের উপরে। ইসলামে জুলুমের স্থান নাই। ইসলাম বলদর্পে দর্পী জালিমকে সর্বাবস্থায় নিন্দা করিয়াছে। যাহারা ইসলামের ইতিহাস পর্যালােচনা করেন বা জানেন তাহারা স্বীকার করিবেন ইসলাম কখনও দুর্বলের উপর, নারীশি উপর নিরস্ত্রের ও অসহায়ের উপর কোন প্রকার আঘাত দেওয়া নিষেধ করিয়াছে। ইসলাম জালিমকে সহায়তা না করিয়া বিনাশ করিতে শিক্ষা দিয়াছে। নারীজাতির, মাতৃজাতির আসন ও মর্যাদা ইসলাম সর্বাবস্থায় সকল স্তরে সবার উপরে স্থান দিয়াছে। লাখে লাখে মানুষ মারিয়া পূর্ব বাংলাকে সংখ্যালঘু করা ফন্দি কোন ইসলামে শিখাইয়াছে ?
এহিয়া ভুট্টো, টিক্কাখান আকবরখান পরিচালিত জল্লাদবাহিনী কত নির্মম নির্লজ্জ ও নিদারুণভাবে বাংলার মা বােনদের, দুগ্ধপােষ্য শিশুদেরে হত্যা করিয়াছে, নারীদের মাদের মর্যাদা, সতীত্ব বন্যপশুর অধম জীবদের ন্যায় ধূলায় লুণ্ঠিত করিয়াছে।
তাহারা আবার ইসলামের দোহাই দেয়, ইসলাম রাষ্ট্র বলিয়া পাকিস্তানের নামে পরিচয় দেয়। যাহারা লজ্জা—সরম, মনুষ্যত্ব বলি দিয়াছে তাহারা আবার মানবতার বা ইসলামের নাম মুখে তুলে? পাক জঙ্গীশাহীদের পেটোয়া “জাতে ইসলামী” [জামাতে ইসলামী] নামে এক ভূয়া প্রতিষ্ঠানকে ইসলামের নামে জিগির দিতে ঢাকঢােল পিটাইতে ব্যবহার করে। যাহাদের লাজলজ্জার জ্ঞান ধর্মাধরুমের জ্ঞান লােপ পাইয়াছে তাহারা ইসলামের নাম ব্যবহার করে। মুখে মদের গ্লাস লাগাইয়া বিবস্ত্র নারীদের চুল আকড়াইয়া তাহারা আবার ইসলামের নাম মুখে লইবার সাহস রাখে। দুনিয়ার ইতিহাস বাদ দিলেও ভারতের ইতিহাস; ভারতের শেখ মােগল পাঠান রাজত্বের পাঁচশত বৎসরের ইতিহাস কি তাহারা শােনে নাই, পড়ে নাই?
শেখ-মােগল-পাঠান এরা প্রায় পাঁচশত বৎসর ভারত শাসন করিয়াছেন ভারতবাসী সকল শ্রেণীর লােককে পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়া। মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, জৈন নির্বিশেষে ভারতবাসীদের শাসন করিয়াছে, সেবা করিয়াছে মােগল পাঠান শাসকেরা। তাঁহারা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ উপদেষ্টা, মন্ত্রী, সেনাপতি সভাসদ প্রভৃতি স্তরের রাজকর্মচারীদের সহায়তায় সহযােগিতায় এবং বিশ্বস্ততায় ধর্মকে তাহারা ব্যক্তিগত মর্যাদা দিতে কখনও পিছপা হন নাই। অমুসলমানদের মধ্যে হইতে যােগ্য পণ্ডিত জ্ঞানী, চিন্তাবিদ লেখক বুদ্ধিজীবী কুশলী এই সকল নানা স্তরের লােকদেরে লইয়া যােগ্য অমুসলমানদেরে সেনাপতি তহবিলদার উজির নাজির পেসকার খাজাঞ্চি নিয়ােগ করিয়া। অমুসলমানদের মন্দির মঠ বিদ্যায়তন ধর্মস্থান ধর্মানুষ্ঠান গুলিকে পরিপূর্ণ সুযােগ ও সাহায্য দিয়া।
মােগল রাজত্বকালে ভারতবাসীরা ধর্ম নিয়া ধর্মস্থান নিয়া হামলা মামলা রেষারেষি করে নাই। পাঁচশত বৎসর মােগল পাঠান শাসনকালে ভারতে সাম্প্রদায়িক টানাহেচড়া নাই। মুসলমান রাজত্বের দীর্ঘ পাঁচশত বৎসর ভারত ইতিহাসে মানবতার স্বর্ণযুগ ছিল। ঐ সময়ের ইতিহাস অনুধাবন করিলে মুসলীম অমুসলীম মিলনের কথা ভাবিলে মন আনন্দে ভরিয়া উঠে। সত্য বটে তখন মুখ্য দেশশাসক ছিলেন মুসলমান নবাব বাদশাহ এরা তাই বলিয়া অমুসলমান রাজামহারাজা বুদ্ধিজীবী সেনাপতি এরা যথা মর্যাদায় মহান ভারতের মিলন সৌধ গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। সত্য বটে দু চারজন খামখেয়ালী মুসলমান শাসক ছিলেন কিন্তু তাহারা ব্যক্তিগতভাবে হয়ত খেয়ালীপনা করিয়াছিলেন মুসলীম অমুসলীম মিলন সৌধ তাহারা নষ্ট করার চেষ্টা করেন নাই। তখনকার মুসলীমরাজত্ব কালে গড়িয়া উঠিয়াছিল ভারতে সাহিত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার স্মরণী সৌধ। অমুসলমানেরা তখন কদাচ নিজেদেরে নিজ বাসভূমে পরবাসী ভাবিতেন না।
আর আজ ইসলামের নমে [নামে] পাকিস্তানের পশ্চিম মুলুকে এবং পূর্বপাকিস্তান কি দেখি ? কতিপয় মতলববাজ স্বার্থপর নেতা বা তাদের আশ্রিত লােক, যাহারা নিজেদের বিলাসবাসনের জন্য সারা দেশবাসীকে কাঙ্গাল করিতেছে। ইহার নগ্ন চিত্র ফুটিয়াছে পূর্ববাংলায়।
ইসলামের জিগির তুলিয়া পাঠানী চক্র প্রথমে অমুসলীমদেরে করিয়াছে বঞ্চিত বিতাড়িত আর আজ কাল তাহারা বাঙালী মুসলমানদেরে নানাভাবে নিষ্পেষিত বঞ্চিত করিয়া দেশ ত্যাগে বাধ্য করিয়াছে।
আজ আমরা জিজ্ঞাসা করি- পাক শাসক গােষ্ঠী এবং তাহাদের তল্লীবাহক কোন কোন দল কোন মুখে। ইসলামের নাম মুখে লন ? তাবাদের (তাহাদের) ইসলাম কি আর কোন পৃথক ধম নাকি ?
দোহাই তাদের, তাহারা পবিত্র শান্তির ধরুম ইসলামকে যেন কলঙ্কিত না করেন।
আর আমরা আমাদেরে মুসলিম ভাইদেরে কাতরভাবে অনুরােধ করি তাহারা পাকিস্তানী অপপ্রচারে ও ভুয়া ইসলামী জিগিরে বিভ্রান্ত হইয়া যেন নিজেদেরে দৃষ্টিভঙ্গী বিব্রত না করেন যাহার পরিণাম কখনও সুফলদায়ক হইবার কথা নহে।
আরােও আশ্চর্যের বিষয় পাকিস্তানের স্বয়ংসিদ্ধ জঙ্গীশাসক এহিয়াখান গত ২৮শে জুন তারিখে বেতার ভাষণে যে দাম্ভিকতা দেখাইয়া আবার ইসলামের দোহাই দিয়াছেন তাহাতে হাসিও পায় ঘৃণাও হয়। ভূতের মুখে রাম নাম বা ইবলিসের মুখে আল্লার নাম ইহাকেই বলে।
পাকিস্তানী ধােকামূলক প্রচারণা হইতে কান ফিরাইয়া রাখাই ভারতের প্রত্যেক সৎ নাগরিকেরই কর্তব্য। সামাজ্যবাদী কায়েমী স্বার্থ পুষ্ট যে কয়টি বড় বড় কোন … ভারতের অগ্রগতির পরিপন্থী এবং সাম্যবাদের মুখােশধারী যে রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মিলনকে দুচোখে দেখিতে পারে না তাহারা দুমুখাে রাজনীতি ও পররাষ্ট্র নীতির খেল দেখাইয়া এই উপমহাদেশকে বিব্রত রাখার যে সকল হীন প্রচেষ্টা চালাইতেছে সেসকল বিষয়ে সচকিত থাকা ভারতবাসীর প্রধান কর্তব্য।
বর্তমান জটিল যুগসন্ধিক্ষণে বিজ্ঞতার সহিত ভারতে জাতীয় নেতৃত্বের উপর আস্থা রাখিয়া চলা ভারতীয় মুসলিমদের পক্ষে দূরদর্শিতার ও বিজ্ঞতার পরিচায়ক হইবে ইহা বলাই বাহুল্য।

সূত্র: আজাদ, ১৪ জুলাই ১৯৭১